২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দলবদল : সব সময়ই ক্ষমতাপ্রিয় এক বাবুল

- ছবি : সংগৃহীত

ক্ষমতার বৃত্ত থেকে সরে গেলেই দলবদল করেন বাবুল সুপ্রিয়। তিনি এই পথে হেঁটেই তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। সাত বছর ধরে নরেন্দ্র মোদি সরকারের মন্ত্রী। তারপর যেই মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়লেন, তখনই সংসদ পদ, এমনকি রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার ঘোষণাও দেন তিনি।

তারপর অমিত শাহ, জে পি নাড্ডার সাথে বৈঠক করার পর বাবুলের সিদ্ধান্ত-বদল, তিনি সাংসদ পদ ছাড়বেন না। তার কিছু দিনের মধ্যেই দলবদল করে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে তৃণমূলের পতাকা তুলে নিলেন তিনি। যে অভিষেকের বিরুদ্ধে কিছু দিন আগে কথার লড়াইয়ে নেমেছিলেন, তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, আজ সেই অভিষেকের কাছ থেকে পতাকা নিয়ে সবিনয়ে নতুন দলে নাম লেখালেন বলিউডের প্লেব্যাক গাইয়ে, অভিনেতা এবং রাজনীতিবিদ।

তৃণমূলে যোগ দিয়ে তার প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে বাবুল একেবারে স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন, ‘আমাকে প্রথম একাদশে সুযোগ দেয়ার জন্য ধন্যবাদ’।

তিনি বলেছেন, ‘খেলার সুযোগ না পেয়ে আমি বিজেপি ছেড়েছি। আমি সবসময় প্রথম একাদশেই থাকতে চাই। সেই কারণে আমি বলব, আমায় প্রথম একাদশে রাখার জন্য দিদি ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ জানাই।’

সত্যি কথাটা সহজভাবেই বলেছেন বাবুল। নরেন্দ্র মোদি তাকে সংসদ সদস্য করেছিলেন। মন্ত্রীও করেন। মানে মোদি-শাহের প্রথম একাদশের ধারে কাছে না থাকার ফলে তিনি সোজা ডাইভ দিয়ে চলে এলেন তৃণমূলে।

বামেরা অভিযোগ করেন, তৃণমূল ও বিজেপি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। কিন্তু মতাদর্শগতভাবে অন্তত খাতা কলমে তো বিজেপি ও তৃণমূল দুই বিপরীত মেরুতে। আবার প্রমাণ হলো, রাজনীতিতে কত সহজেই না মেরু ও মতাদর্শ বদল করা যায়। এই কাজ নতুন নয়। অতীতে কংগ্রেস, তৃণমূল, বামসহ বিভিন্ন দল থেকে বিজেপিতে গিয়ে অনেক সংসদ, বিধায়ক যেমন হিন্দুত্বে দীক্ষিত হয়েছেন, তেমনই আবার বিজেপি থেকে বেরিয়ে এসে অনেকেই এর উল্টো ধারায় স্নান করে অতীত ধুয়ে ফেলেন। অতীতে অন্য দল থেকে কংগ্রেসে যেতেন রাজনীতিকরা। বাবুলও সেটাই করলেন। সুবিধাবাদী রাজনীতিতে আবার চক্ষুলজ্জা বলে কোনো বিষয় থাকে নাকি!

রাজনীতি করাই তো ক্ষমতার জন্য। ক্ষমতাতেই যদি থাকতে না পারলেন, প্রথম একাদশেই যদি ঠাই না হলো, তাহলে রাজনীতি করার তো কোনো অর্থ হয়না। তাই দলবদল। তৃণমূল অবশ্য এখনো বলেনি, বাবুলকে কেমন করে প্রথম একাদশে রাখা হবে? তিনি সংসদে থাকবেন, না কি রাজ্য বিধানসভায়। রাজ্যে মন্ত্রী করা হবে, নাকি সংগঠনে দায়িত্ব দেয়া হবে? তাই প্রথম একাদশ মানেটা এখনো অস্পষ্ট। কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি পেয়েই তো তার এই দলত্যাগ। বিনিময়ে তাকেও তো নতুন দলের হয়ে কাজ করতে হবে।

তার প্রধান কাজ তো এখনই শুরু হয়ে গেছে। সাংবাদিক সম্মেলনে বাবুল বলেছেন, ২০২৪-এ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। কারণ, মমতা সব চেয়ে জনপ্রিয় নেতা। ২০১৪ সালে মোদি ছিলেন, ২০২৪-এ দিদি হবেন। এ সব কথা খুবই প্রত্যাশিত। কিন্তু এতদিন উল্টো কথা বলে এসে রাতারাতি তার এই বোধদয়ে নিঃসন্দেহে মমতা খুশি হবেন, তার শ্লাঘাবোধও হবে। কারণ, মোদি মন্ত্রিসভা থেকে সদ্যপ্রাক্তন হওয়া বাবুল সুপ্রিয় তো নরেন্দ্র মোদির জয়ের সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দিদিকে ২০১৪-এ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেখছেন। এই বার্তাটা দেয়ার জন্যই তো বাবুলকে তৃণমূলে নেয়া। তবে বাবুলের এই কথায়, নরেন্দ্র মোদির একটাও ভোট কমবে বা মমতার বাড়বে কি না সন্দেহ।

প্রশ্নটা হলো, কথাটা কে বলছেন? গানের সুবাদে বাবুলের একটা পরিচিতি আছে। শোনা যায়, বাবা রামদেবের হস্তক্ষেপে তার বিজেপি-তে প্রবেশ ও উপরে ওঠা। রাজনীতিক বাবুল এতদিন যখন মোদির প্রথম একাদশে ছিলেন, তখন প্রতিমন্ত্রী হিসাবে ছিলেন। আসানসোল থেকে দুই বার জিতে এসেছেন। তারপর গত বিধানসভা নির্বাচনে টালিগঞ্জে গোহারা হেরেছেন। বিজেপি-তে থাকার সময় নিয়মিত রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের সঙ্গে লড়াই করেছেন। মন্ত্রী থাকার সময় বাংলার জন্য কিছু করেছেন কি না, সেটা তিনিই বলতে পারবেন। প্রতিমন্ত্রীদের অবশ্য করারও বিশেষ কিছু থাকে না। তারপর বাদ পড়ে তৃণমূলে নাম লিখিয়ে ফেলেছেন।

এক সময় কিছু কংগ্রেস নেতাকে তরমুজ বলা হতো। তারা নাকি বাইরে সবুজ, কিন্তু ভেতরে লাল ছিলেন। তেমনই এখন দেখা যাচ্ছে, কিছু নেতা বাইরে গেরুয়া, ভেতরে নীল।

বাবুল না হয় এই পদক্ষেপ নিতেই পারেন, কিন্তু তৃণমূল কেন বাবুলকে নিল? সেটাও সমান সুবিধাবাদী সিদ্ধান্ত। সাত বছর ধরে বিজেপি-র মন্ত্রী থাকা বাবুল এখন মোদির বিরুদ্ধে ও মমতার সমর্থনে কথা বলতে পারবেন। তার তারকা ভাবমূর্তি দিয়ে বাংলার বাইরে কয়েকবার সংবাদমাধ্যমে জায়গা করে নিতে পারবেন। তাকে দিয়ে প্রচার করালে ভিড় হতে পারে। কিন্তু তার কথা বিশ্বাসযোগ্য হবে কি? কাল বিজেপি-তে থাকা বাবুল আজ তৃণমূলে এসে দিদির জয়গান গাইলে তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য হবে?

অভিনয় করতে গেলে স্ক্রিপ্ট অনুসারে কথা বলতে হয়। সেই ভাবে অভিনয় করতে হয়। রাজনীতিতে সেটা খুব বেশি চলে না। আজ এক স্ক্রিপ্ট, কাল রাতারাতি অন্য স্ক্রিপ্ট অনুসারে কথা বললে, মানুষের কাছে সেই কথার খুব বেশি গুরুত্ব থাকে না। বাবুল খুব সহজেই বলতে পারেন, অভিষেকের সাথে তিনি বাক্সবদল করে নেবেন। অভিষেক যে চিঠিগুলো দিয়েছিলেন তা ফেরত দেবেন। আর অভিষেককে যে পত্রাঘাত করেছিলেন তা ফেরত নিয়ে নেবেন। খুবই সরল অঙ্ক।

কিন্তু এত সহজে কি সুবিধাবাদ মুছে ফেলা যায়? যায় না। তাই বাবুল, তৃণমূল এবং বিজেপিসহ প্রায় সব দল যে সুবিধাবাদী রাজনীতির খেলা খেলছে। রাজনীতি সম্পর্কে এমনিতেই আমজনতার মনোভাব খুবই খারাপ। সেটা আরো খারাপ হবে। বিতৃষ্ণা এলেও বলার কিছু নেই।

সূত্র : ডয়চে ভেলে


আরো সংবাদ



premium cement