৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


এক পিস পেস্ট্রি কেক

এক পিস পেস্ট্রি কেক -


আমার ডাক পড়েছে। মামা আমার সাথে কিছু কথা বলবেন। কি ব্যাপারে বলবেন, জানাননি। তবে সে কথার বিষয়বস্তু সম্পর্কে আমি স্পষ্ট ধারণা করতে পারছি। কিন্তু এ সংক্রান্ত আলোচনায় শরিক হওয়ার কিংবা কথা শোনার কোনো শক্তি আমার শরীর বা মন- কোথাও অবশিষ্ট নেই। আজকে আমার এসএসসির রেজাল্ট বেরিয়েছে এবং তাতে আমি এ প্লাস মিস করেছি। মিস বলতে খুব ভালো মতো মিস। রেজাল্ট যখন হাতে পেয়েছি তখন দুপুরের শেষ, বিকেলের শুরু। ড্রয়িং রুমে বসে মোবাইলে রেজাল্ট উদ্ধার করার জন্য ছোটখাটো যুদ্ধ করছি। যে মুহূর্তে রেজাল্ট হাতে পেলাম আর আম্মুকে জিপিএ বললাম, আম্মু কয়েক সেকেন্ডের তফাতে একদম ভয়ানক রূপ ধারণ করলেন। দৌড়ে রান্না ঘর থেকে রুটি বানানোর বেলান এনে সেটি দিয়ে আমাকে এলোপাতাড়ি মারতে থাকলেন। আমি নড়লাম না। প্রচণ্ড অবাক হয়ে গেলাম আম্মুর এমন আচরণে। সেখানেই বসে থাকলাম। মারতে মারতে একটা সময় ক্লান্ত হয়ে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লেন আম্মু। এর পর রীতিমতো হাউমাউ করে কান্না করতে থাকলেন অনেকটা সময়। না, আমি আগুনে পুড়ে মরে যাইনি। আমি রাস্তায় এক্সিডেন্ট করে হাত-পা খোয়াইনি। বোর্ড পরীক্ষায় আমি তথাকথিত ভালো করতে পারিনি। তাতে এতটা প্রতিক্রিয়া দেখানোর কী আছে আমি সত্যিই জানি না। হ্যাঁ, আত্মীয় এবং পড়শিদের মধ্যে কিছু মানুষ বেশ বিনোদন নেয়ার চেষ্টা করবে। সামনে বড় মায়া দেখিয়ে পেছনে খুব খুশি হবে। কিন্তু আম্মু কেন এত প্যানিক করবেন!

আমার মনে পড়ে না এমন এক লহমার কথা যখন আম্মুর আমাকে দরকার ছিল কিন্তু আমি আম্মুর পাশে আমি ছিলাম না। কয়টা দিন আগে, এসএসসি পরীক্ষা যখন চলে, ফিজিক্স পরীক্ষার আগের দিনের কথা। দুপুরের খাবার খাচ্ছি আর পড়া রিভিশন দিচ্ছি। এরই মধ্যে হুট করে পিপড়ার সমান ক্ষুদ্র কোনো এক কারণে আব্বু-আম্মুর মধ্যে তুমুল কথা কাটাকাটি লেগে গেল, তাও আবার আমার ঘরে। অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গেল, যেকোনো সময় খুব বিধ্বংসী কিছু একটা হয়ে যাবে! আমি অনেকটা সময় চুপ থেকে শুধু একবার বললাম, ‘তোমরা একটু চুপ করো, আমি পড়তেছি।’ আর তার পর মুহূর্তেই আব্বু তার শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে আমার মুখে দেদার ঘুষি বসাতে থাকলেন। আমার সামনের দাঁত ভেঙে রক্তে ভেসে গেল। তার পর দিন আমি ফিজিক্স পরীক্ষায় বসলাম। আমার চোখের পানিতে ওএমআর শিট ভিজে একাকার। হতবাক হকচকিত ইনভিজিলেটর দ্রুত আমার জন্য নতুন আরেকটি ওএমআর শিটের বন্দোবস্ত করে দিলেন। সে দিন কি লিখলাম কি না লিখলাম কে জানে! সব কিছু জেনেও আম্মু আমাকে এভাবে মারলেন কেন?

এসব শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম। দুই তলা সিঁড়ি বেয়ে মামার বাসায় যাওয়ার কোনো আগ্রহই আমার নেই। তবুও আমার অন্ধকার ঘরের পাথর শক্ত খাটের কাঁথার গুহা ফুড়ে বেরিয়ে নিচে নেমে মামার বাসায় এসেছি। সিঁড়ি দিয়ে নামার পথে গুনে গুনে পা ফেলেছি যাতে কোনো প্রকার সাড়া শব্দ না হয়। বলা যায়, চোরের মতো লুকিয়ে সোজা মামা-মামীর বেডরুমে এসে দাঁড়িয়েছি। উনাদের ঘরটির মূল আকর্ষণ বিশাল চকচকে ফকফকে একটি টিভি সেট। খুব সম্ভবত অতি আনন্দের কোনো হিন্দি গান বাজছে। ভাষাটা আমি বুঝি না তেমন, তবে নায়ক-নায়িকার অঙ্গভঙ্গি আর হাসি দেখে এতটুকু কনফার্ম বলে দেয়া যায় যে- তাদের মনে বেজায় আনন্দ। নেচে-কুদে কূল পাচ্ছে না! মনে মনে গানের ব্যবচ্ছেদ করছি আর ততক্ষণে আমার সামনে এক পিস পেস্ট্রি কেক রাখা হয়েছে। কেকের ওপর টুকটুকে লাল চেরি ফল স্বগৌরবে বসে আছে। এই পেস্ট্রি কেক খাবারটা আমার চরমতর পছন্দের। যদিও চাইলেই খুব একটা খাওয়ার সুযোগ বা সামর্থ্য হয় না। মামী সুন্দর কাচের পিরিচে করে, সাথে চামচ দিয়ে কেকটা আমার সামনে এনে রেখেছেন।

‘জাহরা, এসেছিস? বস।’
মামা টিভিটা বন্ধ করলেন। আমি খাটের পাশের কাঠের চেয়ারটায় কাপড়ের পোটলার মতো গুটিশুটি দিয়ে বসে পড়লাম। এরপর মামা ঠিক কী বলেছিলেন আমার মনে নেই। ওই মোটিভেশনাল কথা। কিন্তু খুব বেশি আন্তরিক গলায়। একদম আপনা লোক হয়ে। আমার রূহের ভেতর যে কষ্ট ছিল তার অনেকটাই যেন চুপচাপ গলে গেল। বড় হালকা হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ কাঁদলাম। মামা এক আসমান সমান স্নেহ নিয়ে আমাকে বুঝিয়ে গেলেন। শান্ত করার চেষ্টা করলেন। হাসালেন। সব শেষে আমি চোখের পানি ফেলতে ফেলতে কেক খেয়ে নিলাম।
সেই এক পিস পেস্ট্রি কেক আর মামার এক দেড় ঘণ্টার দেনা শোধ করার সাধ্য আমার নেই। কখনোই হবে মনে হয় না। কারণ, নিখাঁদ স্নেহের পাওনা মেটানো যায় না।
আঙ্কারা, তুর্কিয়ে

 


আরো সংবাদ



premium cement