২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কোয়ারেন্টিন

-

করোনার সময়টায় রাফসানকে বাড়িতে আটকে রাখতে আমার রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছেÑ আমি একেবারে হাঁপিয়ে উঠছি। একটু পরপরই বাইরে যেতে চায়, একটু হেঁটে আসতে চায়। আসলে দোষ দিয়েই বা কী হবে, যে লোকটার সারাদিন দোকান-খদ্দের আর হুলস্থূলে-হুল্লোড়ে কাটে, তার জন্য একদম ঝিম ধরে ঘরে বসে থাকা কঠিন কাজ। তারপর আবার করোনা সংক্রমণের পর ব্যবসার সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে ভেবে ভেবে মানুষটা আমার আরো চুপচাপ হয়েছে। নাপিতের অভাবে সবাই যখন চুল ফেলে টাক হয়ে যাচ্ছে, বৈশাখের গরমেও তখন নেচে নেচে চুল বড় করেছে! আমি বারবার বলছি, এত ভেবে কিছু হবে না, কিন্তু কে শুনে কার কথা!
তবে, আমি ওকে ব্যস্ত রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছি। বাড়ির সামনে আমার করা ছোট ফুলবাগান আর ডজনখানেক কবুতরের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি কিছু দিনের জন্য ওর হাতে দিয়ে দিয়েছিলাম। সকাল হলেই নিজ উদ্যোগে গাছে পানি দিয়েছেÑ কবুতরের খাবার দিয়েছে। পিঁড়ি পেতে পাশে বসে রান্নার জন্য তরকারি কেটে দেয়ার চেষ্টাও করেছে মাঝে মাঝে। তো এসব অল্পবিস্তর কাজ করে সকালবেলাটা দ্রুত গড়িয়ে গেলেও দুপুর থেকে ধীরে ধীরে তার মুখ গম্ভীর হতে শুরু করে। আমার তো সয়ে গেছে, আমার সারা বছরই হোম কোয়ারেন্টিন। খুব প্রয়োজন ছাড়া আমি এমনিতেও বাড়ি থেকে তেমন একটা বের হই না। কিন্তু রাফসান বরাবরই ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসে। সেই সকালে নাশতা করে বের হবেÑ দুপুরে কিছু সময়ের জন্য খেতে আসবে তারপর আবার দোকানে চলে যাবেÑ আসবে একদম রাতে। আসলে কী বলব, এসব কারণে রাফসানকে হঠাৎ করে অনেকটা সময় কাছে পাওয়ায় আমার ভালোই লেগেছে। আমরা তিনবেলা একসাথে বসে খাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। তারপর নিজেদের খাওয়া শেষে কিছু খাবার রাস্তার কয়টা কুকুরের জন্য দিয়ে আসতাম। বিকেল হলে একসাথে এক কাপ লেবু-ওয়ালা আদা চা হাতে ছাদে গিয়ে বসতাম আর একটু গল্প করতাম। গলা নামিয়ে একটা দুইটা গান শুনাতাম ওকে। আশপাশের ছাদগুলোতে ছোট্ট ছেলেরা নানা রঙের ঘুড়ি ওড়ায়। আমরা ঘুড়ি কাটাকাটি দেখি। সন্ধ্যা হলে রাফসান নিয়ম করে আমার একমাত্র জীবিত খালা শাশুড়িকে একটা ফোনকল দিত। তার খোঁজখবর নিত। অনেক বয়স হয়েছে, চোখেও ভালো দেখেন না আজকাল, থাকেন নরসিংদীর শিবপুরে, তার ছেলেদের সাথে। করোনায় বয়স্ক মানুষের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই তার জন্য রাফসান বেশ দুশ্চিন্তা করত। এই একজন খালা ছাড়া রাফসানের আপনজন আর কেউ দুনিয়াতে নেই। তার গড়ন-গায়ের রঙ প্রায় সবটাই নাকি আমার শাশুড়ির মতো। অসম্ভব স্নেহ করেন রাফসানকে। ও খুব চাইত খালাকে আমাদের বাসায় আনিয়ে কিছুদিন রাখার। একটু যতœ করার আর একটা ভালো চোখের ডাক্তার দেখানোরও পরিকল্পনা ছিল। কিছুদিন পরই ও নরসিংদী যেত, তাকে সাথে করে নিয়ে আসত। কিন্তু করোনা সব গণ্ডগোল পাকিয়ে দিলো। মনটা বড় খারাপ হতো। বড্ড অসহায় লাগত। বুকের মধ্যে কেমন একটা লাগত। ভাবতাম, ভালো দিনগুলো আবার ফিরে আসবে তো? বিকেলবেলায় আবার ফুচকা খেতে যেতে পারব তো?
আসলে কী বলব, জীবনটা বড্ড সুন্দর! রোগে শোকে কষ্ট পেয়ে মরে যেতে তাই একটুও ইচ্ছে হয় না। রাফসানের মাথার পাকা চুল বেছে দেয়ার জন্য হলেও কয়টা দিন বেশি বাঁচার ইচ্ছা হয়। ওর কাছ থেকে একজোড়া নতুন কানের দুল উপহার পাওয়ার জন্য হলেও কয়টা দিন বেশি বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয়। হ


আরো সংবাদ



premium cement