২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ডেঙ্গু, দুর্যোগ ও কিছু ভাবনা

- ফাইল ছবি

দেশের মোট জেলা ৬৪টি। সব ক’টি জেলায়ই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। দেশের দক্ষিণ ও উত্তর অঞ্চলের ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্ত পাঁচ কোটি মানুষ। এক কথায় ডেঙ্গু এখন মহামারী রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশে দুই মাস বর্ষাকাল থাকে- এই সময় ডেঙ্গুসহ নানাবিধ সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। ডেঙ্গু রোগ তার মধ্যে অন্যতম বলা যায়। প্রশ্ন হলো- রোগ বিস্তারের আগে সরকার কেন সতর্কতা অবলম্বন করেনি। আমাদের দেশে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সেটা খুন, গুম, নাশকতা, গণপিটুনি, ধর্ষণ এবং ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার লাভের পর সবার টনক নড়ে। শুরু হয় দোষারোপের রাজনীতি।

সরকারি দল বলছে এটা গুজব, আসলে বিএনপি এটা ছড়িয়েছে। ৪৮ বছর আমরা এ সংস্কৃতি দেখেছি, যা চলমান এখনো। সরকার থাকে মাঠের বিরোধী দল নিয়ে, অন্য দিকে ক্ষমতাসীনেরা বলতে থাকে গুজবে কান দেবেন না। বিরোধী দল গুজব ছড়াচ্ছে। গুজবের অফিস পল্টনে। রোগীর সেবা না করে বন্যাকবলিত মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে শব্দযুদ্ধ শুরু করেছে। এসব নিয়ে ইলেকট্রনিকস ও প্রিন্ট মিডিয়া থাকে সোচ্চার- মূল ঘটনা প্রচার না করে তারা সরকারি মহলকে বেশি কাভারেজ দেয়। আমরা যে জনসচেতনতায় একেবারে কৃপণ এবং জনগণের চেয়ে ক্ষমতাসীনদের বেশি মূল্য দিয়ে থাকি, তা মিডিয়া দেখলেই আমরা বুঝতে পারব।

কেউ কেউ একে বলেন, এক পেশে সংবাদ। হাইকোর্ট এ ব্যাপারে সোচ্চার- কিন্তু সরকারি মহলের সাথে কেউ পেরে উঠছে না। এর ফলে প্রকৃত সত্য প্রকাশ হচ্ছে না এবং সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমছে না। উচিত কথা বলে বিপদ, এ কারণে সৎ মানুষগুলো পালিয়ে বেড়ান। বাঁচার এ এক অদ্ভুদ কৌশল। সম্প্রতি দু’বার পুরান ঢাকায় গিয়েছিলাম ব্যক্তিগত কাজে। তবে ভিন্ন পথে অর্থাৎ মোহাম্মদপুর থেকে সায়েন্স ল্যাব হয়ে শাহবাগ, প্রেস ক্লাব সর্বশেষ গুলিস্তান ও মতিঝিল শাপলা চত্বর। এই রুটে আমার মতো সাধারণ মানুষ যাওয়া-আসা করেন।

তবে এবার আমি বেড়িবাঁধ, যে বাঁধের কথা মনে উঠলেই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কথা মনে ওঠে, সেই বাঁধ দিয়ে ঢাকায় বিশেষ করে পুরান ঢাকায় আসা-যাওয়া করা খুবই সহজ হয়েছে বলে আমার কাছে মনে হলো। গাবতলী-আমিন বাজার থেকে বাবুবাজার-ঢাকা পর্যন্ত এর গন্তব্য পথ। সময় লাগে প্রায় দুই ঘণ্টা। এই রুটে যেসব পরিবহন চলাচল করে তা দেখলে মনে হবে- আমরা একটি নিকৃষ্ট নগরীর নিকৃষ্ট মানুষ হিসেবে খাতা-কলমে লিপিবদ্ধ আছি। এই রুট একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট- কারণ, আমিন বাজার, ঢাকা উদ্যান, বছিলা, বধ্যভূমি, বুদ্ধিজীবীদের কবরস্থান (১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১- স্বাধীনতার পূর্বক্ষণে যারা নিহত হয়েছিলেন তাদের সমাধিস্থল) এবং জাতীয় কবরস্থান, হাজারীবাগ, সোয়ারীঘাট, কামরাঙ্গীরচর, কেরানীগঞ্জ- এসব এলাকার মানুষের জন্য এই রুটটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রুট বলে আমার কাছে মনে হলো।

কিন্তু যাতায়াত ব্যবস্থা এতই খারাপ যে, সাধারণ নাগরিকেরাও এ পথে দ্বিধাবোধ করেন চলাচলে। দেখলাম বেড়িবাঁধসংলগ্ন এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ময়লার ভাগাড়। মনে হলো ঢাকার তিন কোটি ঘনবসতিপূর্ণ মানুষগুলোর যত ময়লা আবর্জনা আছে, নিত্যদিন এখানে এনে ফেলা হয়। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, যা থেকে পথচারী এবং গাড়ির যাত্রীদেরই ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি হয়। কামরাঙ্গীরচরজুড়ে যে নদী এবং তুরাগ নদী, যা বুড়িগঙ্গার সাথে মিলেছে, সেটা এখন অস্তিত্বহীন বলে মনে হলো।

আমরাই এই নদীকে ময়লা বর্জ্যে ভরাট করে ফেলেছি। আমি সবিনয়ে সংশ্লিষ্ট মহল এবং যারা পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন তাদের আহ্বান জানাব, চর্মচোখে বিষয়টি অনুধাবন করতে। প্রায় পাঁচ কিলোমিটারজুড়ে বর্জ্যরে পাহাড় কিভাবে গড়ে উঠেছে- না দেখলে লিখে তা বোঝানো যাবে না। এডিস মশার প্রজনন তো এখানেই জন্ম নিচ্ছে। জ্যামে যখন গাড়ি আটকে যায় তখন অনুভব করা যায় এই মশার বিষাক্ত দর্শন। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল- পরিবেশ নিয়ে প্রায় ছয়টি বই যখন লিখেছি, এ ব্যাপারে আরো জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন। সে জন্যই আমি বাসে এবং হেঁটে এসব এলাকায় যাই।

চর্মচোখে এলাকার প্রকৃত অবস্থা জানতে গিয়ে হতাশ হয়ে ভাবি- এর পরিত্রাণ কিভাবে হবে যারা দিবা-নিশি মরহুম নেতাদের কীর্তন নিয়ে (৩৬৫ দিন) সময় ক্ষেপণ করেন। নেতা আসবে যাবে- তাদের বন্দনায় যদি আমরা দিনের বেশির ভাগ সময় ক্ষেপণ করি তা হলে ঢাকার চিত্র বদলাবে না। দুই সিটি করপোরেশন দলীয় নেতারা উল্লিখিত এলাকায় গিয়ে ফটোসেশন করে (মিডিয়া কভারেজ পাওয়ার জন্য) থাকেন। এতে মূল সমস্যার সমাধান কখনোই হয় না। মালয়েশিয়ার পুত্রজায়ার মতো একটি প্রশাসনিক ‘উপশহর’ গড়ে তুলতে পারবেন না। সিঙ্গাপুর ঢাকার চেয়ে দ্বিগুণ বড় কিন্তু লোক সংখ্যা মাত্র ৫৬ লাখ। অন্য দিকে, ঢাকা সিঙ্গাপুরের চেয়ে অনেক ছোট কিন্তু লোকসংখ্যা প্রায় চার কোটি।

ঢাকার জনসংখ্যা সিঙ্গাপুরের তুলনায় সাত গুণের চেয়ে বেশি। ৪৮ বছর ধরে শাসকগোষ্ঠী এই বাস্তবতা অনুধাবন করেও তার প্রকৃত ব্যবস্থা নেননি। ঢাকায় কেন জনস্রোত বাড়ছে, নিশ্চয় এর উত্তর তাদের অজানা থাকার কথা নয়। আমরা দেখেছি দু’জন নেতা জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়ে সফলতার পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। যেমন- জিয়া গ্রামসরকার এবং এরশাদ উপজেলা সরকার উন্নয়ন করলে এবং সেই পথে অগ্রসর হলে ঢাকায় মানুষ স্রোতের মতো ধাবমান হতো না। বহু মানুষের সাথে আলাপ করে জেনেছি তাদের ঢাকায় আসার কারণ।

বেশির ভাগ মানুষ বলেছে, গ্রামে কাজ নেই। যতটুকু আছে তা দিয়ে সংসার নির্বাহ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের চাপ আরো বেড়ে যাবে- যখন পদ্মা সেতু চালু হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ ইতোমধ্যেই ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। সিডর, আইলা নিয়ে মোট চারটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছেন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। নদী পাড়সংলগ্ন সড়ক পথগুলো নষ্ট হয়ে গেছে, মেরামতহীন অবস্থায় থাকার কারণে। ২০১৮ সালে পটুয়াখালী শহর এবং এর আশপাশ এলাকা চর্মচোখে দেখার জন্য গিয়ে হতবাক হয়ে যাই। কুয়াকাটায় বৃক্ষসমাজ ও চির হরিৎ বনাঞ্চল গড়ে না তুলে আবাসন নির্মাণের প্রতিযোগিতায় উঠে পড়ে লেগেছে- দেশের আবাসন কোম্পানিগুলো ঢাকায় ইট-পাথরের বস্তি নির্মাণে নেশায় যেভাবে মেতে উঠেছিল, এখন এর বিস্তার সমুদ্রবেষ্টিত সাগরসৈকত পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে।

যদি দেশকে প্রকৃত অর্থে ভালোবাসতাম, তাহলে সিঙ্গাপুরে মাথাপিছু আয় প্রায় ৭৭ হাজার ইউএস ডলার আর আমাদের অবস্থা ৪৮ বছরে দাঁড়িয়েছে মাত্র এক হাজার ৮০০ ইউএস ডলার, এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হতো। এটা কেন হয়নি। উত্তর- বৃক্ষ নিধন, নদী ভরাট ও দখল এবং অনৈতিক পথে অর্থ উপাজনের সব পথ উন্মুক্ত করে দেয়ার কারণে, বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে ধীরগতিতে ধাবমান হয়েছে। এশিয়ার দুটি দেশ- সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া দুর্নীতি দমনে সফল হয়েছিল। এ কারণে এশিয়ার এ দুটি দেশে মাথাপিছু আয় বেড়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ, জনসংখ্যা এসব বিষয়ে জিরো টলারেন্স থিম নিয়ে অগ্রসর হয়েছিল। আজ তারা বহু ইউরোপীয় দেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে।

ভাবলে অবাক হতে হয়- খাদ্যে ভেজালবিরোধী অভিযানে জরিমানা আদায় হচ্ছে। এর ফলে কি খাদ্যে ভেজাল কমেছে। জরিমানা করে আরো উৎসাহিত করা হয়েছে এদের। নতুন নতুন কৌশলের পথে তারা এগোচ্ছে। ‘খাদ্যে বিষক্রিয়া পরিত্রাণের উপায় কী’- এই বইটি আমি জনস্বার্থে রচনা করি ২০১৫ সালে। এসব বইয়ের পাঠক নেই। প্রকাশক আমাকে বললেন- পাঠক নেই- কিন্তু ‘কলকাতায় বইমেলায় গিয়ে ভালো ফল পেয়েছি। আপনার সব বই কলকাতা বইমেলায় বিক্রি হয়েছে। প্রকাশক বললেন- বাংলাদেশের মানুষ দেশ নিয়ে ভাবে নাÑ যতটা ভাবে ভারতের মানুষ। গল্প উপন্যাসের চেয়ে দেশভিত্তিক প্রবন্ধ/নিবন্ধ গবেষণামূলক বই বেশি কেনে।

২০১৭ সালে ভারত সফরে গিয়ে ২৭ দিন ছিলাম। এ সময়টায় বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে একটি ধারণা আমার মধ্যে জন্ম নেয়। সেটা হলো- ওদের মধ্যে দেশপ্রেম ব্যাপক এবং আমাদের মতো এতটা অনুকরণপ্রিয় নয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা রাস্তায় বসে ‘সুন্দরবন’ নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন- এ বিষয় নিয়ে কাজ করি বিধায় একটা ধাক্কা অন্তরের মধ্যে উপলব্ধি করি। তারা কী নিয়ে কথা বলছে শুনলাম- তারা বলছে সুন্দরবনের আশপাশে কোনো মিলকারখানা হতে পারবে না। তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রশ্নই ওঠে না। এসব কারণে ভারতীয় অংশে এসব স্থাপনা তৈরি করার সুযোগ ঘটেনি। আমার হাতে একটি বই ছিল, বইটির নাম ‘বৃক্ষ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে।’

আমার রচিত বইটি দেখে তাদেরই একজন কিছু কথা বলার জন্য মঞ্চে দাঁড় করালে আমি ১০ মিনিটের বক্তব্যে বলেছিলাম, যারা কার্বন গিলে খায় এবং অক্সিজেন মানুষের জন্য তৈরি করে বেঁচে থাকার জন্য, তাদের ধ্বংস যারা করে, তারা মানুষ নয়- পশুর সমতুল্য। তারা আমার সাক্ষাৎকার নিলো- দাদা আপনার ফোন নম্বর ও ঠিকানা দিন, যোগাযোগ করব। আপনার রচিত বই কলকাতা বইমেলা থেকে সংগ্রহ করেছি। ভবিষ্যতেও আশা থাকল। ভাবলাম এরা আমাদের চেয়ে অনেক দেশপ্রেমিক। তাদের অংশে সুন্দরবন এলাকাজুড়ে চার শতাধিক বাঘ রয়েছে। আর আমাদের সুন্দরবনে ১১০টি। অথচ আমাদের সুন্দরবন অংশ ভারতের চেয়ে বড়। বিষয়টি এ কারণে বললাম, দেশপ্রেমিকতায় তাদের চেয়ে আমরা কত পিছিয়ে আছি। আমরা ঢাকার সবচেয়ে বড় বেড়িবাঁধ এলাকা বর্জ্যমুক্ত করতে পারিনি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কজুড়ে আবর্জ্যনার ভাগাড়। ময়লার দুর্গন্ধে মহাসড়কজুড়ে যাতায়াতকারী যাত্রীদের দুর্ভোগ এখন চরমে।

লেখক : গ্রন্থকার ও গবেষক
e-mail : harunrashidar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement