২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জুন : ১৭৫৭ থেকে ২০১৯

- ফাইল ছবি

১৭৫৭ সালের জুন মাস থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ২৬২ বছরের ইতিহাস। আমাদের দেশটি দু’বার স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু সময় কেটে যাচ্ছে স্বাধীনতা-পরাধীনতার পর্যালোচনায়। এ নিবন্ধ লেখার সময় অর্থমন্ত্রীর জাতীয় সংসদে প্রদত্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট মোতাবেক খেলাপি ও অকার্যকর ঋণের পরিমাণ দুই লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা; যার মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। বাকি এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে বিভিন্ন আদালতের আদেশে আটকে আছে ৮০ হাজার কোটি টাকা। অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী ঋণখেলাপিদের নাম উল্লেখ করেননি।

এমনকি বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ এক আদেশে ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশের নির্দেশ দিলেও খেলাপিদের নাম আদালতে দাখিল করা হয়নি। বরং আশঙ্কা, ঋণখেলাপিদের রক্ষাসহ আরো লুটের সুযোগ করে দেয়ার অভিলাষ ব্যাহত হয়েছে হাইকোর্টের যুগান্তকারী নির্দেশে, যার কার্যক্রম আরো দুই মাস সরকারের নির্দেশে স্থগিত থাকবে। সংসদে প্রকাশিত অর্থমন্ত্রীর প্রতিবেদন বা অ্যাটর্নি জেনারেল কর্তৃক হাইকোর্টে সিলগালাকৃত প্রতিবেদনেও দুই লাখ হাজার কোটি টাকা লুটেরাদের সংবাদ জাতি বা জনগণ অর্থাৎ যারা অর্থের মালিক, তারা জানতেই পারল না, ব্যাংকে গচ্ছিত জনগণের টাকা কারা লুট করে নিলো। তবে ওদের সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে, যা ৩০২ জন (উল্লেখ্য দণ্ডবিধির বিধান মোতাবেক খুনের আসামিকে ৩০২ ধারায় অভিযুক্ত করা হয়। জাতিকে যারা ‘অর্থনৈতিকভাবে খুন’ করল তাদের সংখ্যার সাথে দণ্ডবিধির খুনের ধারা একই সংখ্যা, যদিও এটা কাকতালীয়)। অন্য দিকে বলা যায়, যদি খেলাপিরা এমনিভাবে অর্থাৎ ১০ বছরের জন্য ঋণ পুনঃ তফসিলের সুযোগ পায় তবে তারা সে সুযোগ নেবে না কেন?

সরকার কথায় কথায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলে আসছে। দুদক এক ধাপ এগিয়ে যেখানে সেখানে হানা দিচ্ছে। কিন্তু জনগণের টাকা লুটেরাদের বিরুদ্ধে প্রত্যাশিত পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না, একই দলের সরকার বিগত ২০০৮ সাল থেকে অদ্যাবধি ক্ষমতায়। ব্যাংকের চেয়ারম্যান, মহাব্যবস্থাপক ও পরিচালক সবই নিয়োগ পাচ্ছেন রাজনৈতিক বিবেচনায়। এ কারণেই বলা চলে, সরকারি ঘরানার লোকেরাই ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। তবে লুটেরাদের কোনো ধর্ম নেই, যেখানেই সুযোগ পায় সেখানে লুট করে। জনগণের অর্থ লুণ্ঠন যেন একটি ফ্যাশন এবং লাজলজ্জার এখানে কোনো বালাই নেই। কাপড়চোপড়ে তারা খুবই সাদা, যাদের বলা হয় যিরঃব পড়ষড়ঁৎ . কিন্তু কাপড় পরলেই কি শুধু লজ্জা নিবারণ করা যায়?

সমাজ, সংস্কৃতি, কৃষ্টি সবই কি বদলে যাবে? ভারতে বাসে ও ট্রেনে গণধর্ষণের খবর কিছুদিন আগে প্রকাশ পায়। কিন্তু বাংলাদেশে হালে গণপরিবহনে গণধর্ষণের মহামারীতে পরিণত হয়েছে। পশ্চিম বাংলাসহ ভারতে ট্রেন, বাসসহ বিভিন্ন পরিবহনে নারী, প্রতিবন্ধী ও সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য আসন সংরক্ষিত থাকে। সংরক্ষিত আসনে কেউ যদি আসন গ্রহণ করে সেখানে একজন নারী, প্রতিবন্ধী বা সিনিয়র সিটিজেন দেখা মাত্রই বসে থাকা যাত্রী নিজ নিজ আসন ছেড়ে দিয়ে যাদের জন্য আসনটি সংরক্ষিত তাদের জন্য ছেড়ে দেন। এটা নৈতিকতার বিষয়, যা একটি শক্তিশালী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। অনুসরণ যদি করতেই হয় তবে আমরা কেন নৈতিকতাপূর্ণ বিষয়টি অনুকরণ করতে পারছি না? ভারতে সিনিয়র সিটিজেনদের চিকিৎসায় বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটি বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। আমাদের দেশের হাসপাতালগুলো কিন্তু সে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি। পরিবহনে ধর্ষণের অনুকরণ না করে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে অনুসৃত নৈতিকতার বিষয়টি আমাদের সমাজে অনুসরণ করা হচ্ছে না কেন? ভারতে আইন করে খেলাপিদের নিকট থেকে জনগণের অর্থ আদায় করা হচ্ছে অথচ বাংলাদেশে হচ্ছে এর উল্টো। হাইকোর্ট যদি হস্তক্ষেপ না করতেন তবে খেলাপিদের পোয়াবারো হয়ে যেত; ঋণের নামে অর্থলুটের আরেকটি সুযোগ হয়ে যেত। বিভিন্ন আলোচনায় ঋণখেলাপিদের ভিন্ন ভিন্ন নামে চিহ্নিত করা হচ্ছে, যেমন বর্ণাঢ্য ঋণখেলাপি, ডরষষভঁষ ঘৃণ্য খেলাপি এবং ওহহড়পবহঃ ঋণখেলাপি।

একই পরিবারভুক্ত বা একই প্রতিষ্ঠান এক ব্যবসায় ঋণখেলাপি হয়ে নাম পাল্টিয়ে অন্য ব্যবসার নামে ঋণ নিচ্ছে। ব্যাংকের টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে হয় না, এটা ধরে নিয়েই ঋণ নিয়ে তা আত্মসাৎ করা হচ্ছে। সৎভাবে ব্যবসা করতে যেয়ে কেউ যদি খেলাপি হয়ে থাকে তার কথা আলাদা, কিন্তু তাদের সংখ্যা কত? কিন্তু একজন দিনমজুরকে (যেমন জাহালম) যখন স্যুট-টাই পরিয়ে এনে তার অনুকূলে কোটি কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়, তার পেছনে কারা কলকাঠি নাড়ে, তাও কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রকাশ করতে সরকার ব্যর্থ। মানুষকে হত্যা করে মৃতব্যক্তির পেটে হেরোইন ঢুকিয়ে পাচার করার কথা দেশবাসী শুনেছে। কিন্তু এর চেয়েও বিস্ময়কর হলো, যখন একজন দিনমজুরকে কোটি কোটি টাকা ঋণের জালে ফেলা হয়। জাল-জালিয়াতি কতটুকু গড়িয়েছে, তা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যাংকের অর্থ রক্ষা করার দায়িত্ব যাদের, সেই বড় শ্বেতহস্তীদের লালন-পালনে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়, অধিকন্তু রয়েছে বাড়ি-গাড়ির সুবিধা। তারপরও খেলাপিদের বারবার ঋণ দিয়ে লোপাটের সুযোগ দিয়ে কর্মকর্তারা জাতির সাথে গাদ্দারি করছেন, যার সুযোগ করে দিচ্ছে মূলত সরকারের দুর্বলতা।

সুইস ব্যাংকে বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশীদের সর্বাধিক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা হয়েছে বলে মিডিয়ায় প্রচার পেয়েছে। এ ছাড়াও মালয়েশিয়া, কানাডা, আমেরিকা ও লন্ডনে বহু বাংলাদেশীর ‘সেকেন্ড হোম রয়েছে’। এগুলোর পেছনে রয়েছে ঘুষ বা ঋণের টাকা। এ মর্মে বহুবার কথা উঠলেও সরকারিভাবে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কি না, জনগণ জানতে পারেনি। সেকেন্ড হোম বা বিদেশে বাড়ি-গাড়ি করার জন্য ঋণ দেয়া হয় না বরং দেশের কাঁচামাল সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে মজবুত করা, অন্য দিকে শিল্পকারখানা সৃষ্টি করে বেকার সমস্যার সমাধান করাই বিভিন্ন প্রজেক্টের প্রোফাইলের ওপর ভিত্তি করে ঋণ মঞ্জুর করার উদ্দেশ্য। কিন্তু সে উদ্দেশ্য ব্যাহত করছে সরকার মনোনীত পরিচালনা পর্ষদের অর্থ আত্মসাতের মনোবৃত্তি; অন্য দিকে রয়েছে ব্যাংকের এমডি থেকে শুরু করে বড় কর্মকর্তাদের কমিশন ভক্ষণসহ উচ্চাভিলাষ।

বাংলাদেশে লিভার ট্রান্সফার করা অবশ্যই একটি সুসংবাদ। তবে এ দেশবাসী দেশীয় চিকিৎসকদের ওপর কেন আস্থা রাখতে পারছেন না, তাও পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনার দাবি রাখে। চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া রোগীদের সাথে আলাপ করে স্থির বিশ্বাস জন্মেছে, তারা দেশীয় চিকিৎসকদের প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না বলেই বিদেশে পাড়ি জন্মাচ্ছেন। চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকটা পিছিয়ে। কারণ দেশবাসী মনে করে ‘সেবা’ বলতে যা বুঝায় তা দেশে অনুপস্থিত। বাইরের চিকিৎসকেরা রোগীকে যে সময় দেন তা বাংলাদেশের ডাক্তাররা দেন না বলে রোগীদের অভিযোগ। এসব কিছুই নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের মন-মানসিকতার ওপর। অন্য দিকে, সরকারি চাকরিরত বাংলাদেশের ডাক্তাররা যেভাবে সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন, অন্য কোথাও এটা নেই। ফলে রোগীদের সেবা করার সময় ও সুযোগও ভিনদেশের ডাক্তারদের অনেক। লজ্জার বিষয় এই যে, কথায় কথায় যাতে সিজারিয়ান করতে না হয়, এ জন্য বাংলাদেশে হাইকোর্টের শরণাপন্ন হতে হয়েছে।

দুদক দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মচারী স্বামী ও স্ত্রী (আবজাল ও রুবিনা) ২৮৪ কোটি টাকা পাচার করেছে বলে দুদক অভিযোগ করেছে। তদুপরি দুদকের মতে, ওদের ৩৬ কোটি টাকা আয়বহির্ভূত সম্পদ রয়েছে। অথচ দুদকের চোখের সামনে তারা দেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায় পালিয়ে গেল, এ জন্য দুদকের কোনো মাথাব্যথা নেই। যেখানে বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদদের দেশ ছাড়তে বা এয়ারপোর্ট অতিক্রম করতে এত বাধা, সেখানে এ দুর্নীতিবাজ দম্পতি কোটি কোটি টাকার অবৈধ উপার্জনের অভিযোগ মাথায় নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয়ার বিষয়ে দুদকের দায়িত্ববোধ কোথায়? ক্ষমতার চেয়ারে বসে অনেক কথাই বলা যায় কিন্তু আয়নায় নিজের চেহারা দেখে স্বচ্ছ উপলব্ধি হলে সবার লজ্জা হওয়া উচিত। ডিআইজি মিজানের বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দুদক কর্মকর্তাদের অনেকে যে কেমন ধোয়া তুলসী পাতা, তার স্পষ্ট প্রমাণ মেলে। পাক-ভারত উপমহাদেশের দু’জন স্বাধীন শাসক বাহাদুর শাহ জাফর এবং সিরাজউদ্দৌলা দালালি বা আত্মসমর্পণ করেননি। প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে বাহাদুর শাহ জাফরকে ব্রিটিশ শাসকরা খতম করেছে, অন্য দিকে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করেছে নিজ দেশীয় দালালরা।

ইতিহাসবিদদের মতে, পাক-ভারত উপমহাদেশে ঘুষ প্রথা চালু হয়েছিল কুখ্যাত লর্ড ক্লাইভের আমলে। ক্লাইভ কত টাকা ঘুষ খেয়েছিলেন এবং কত অর্থ ও স্বর্ণ, হীরা, মূল্যবান সম্পদ এ দেশ থেকে ব্রিটেনে পাচার করেছিলেন তারও হিসাব ইতিহাসবিদরা দিয়েছেন। আজ স্বাধীন রাষ্ট্রে ঘুষ একটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। ঘুষ ছাড়া ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত হওয়ার কথা মানুষ ভুলেই গেছে। ঘুষদাতা ও গ্রহীতা দু’জনই চরম দোষী। ঘুষবাণিজ্যে দাতাই লাভবান, কিন্তু বিচার হয় শুধু গ্রহীতার, যদি ক্ষমতা থাকে গ্রহীতাকে দুদক স্পর্শ করে না, বরং ধিংয ড়ঁঃ এবং পষবধহ করে দেয়। ‘বিচার বিভাগ ঘুমিয়ে আছে’ অভিযোগ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ২৮ জুন মানববন্ধন করেছে। তবে বিচার বিভাগ অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে, আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে তারা আরো একটু এগিয়ে এলে জনগণ হাফ ছেড়ে বাঁচত।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন মুর্শিদাবাদের পলাশীর যুদ্ধের ময়দানে তদানীন্তন প্রধান সেনাপতি মীরজাফর আলী খানের নেতৃত্বে ছিল ৬৫০০০ সৈন্য। অন্য দিকে ক্লাইভের নেতৃত্বে ছিল মাত্র ৩৫০০ সৈন্য। মীরজাফর নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধ করেননি। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে মীরজাফর আলী খানের ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত ছিল, সে দায়িত্ব পালন করেননি, তিনি ব্রিটিশের কাছে বিক্রি হয়েছিলেন পরবর্তী নবাবির আশায়। কিন্তু তার দায়িত্বে অবহেলার কারণেই বাংলার স্বাধীনতার শেষ সূর্য ২৩ জুন ১৭৫৭ অস্তমিত হয়ে যায়। এখনো কি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ঈমানদারির সাথে পালিত হচ্ছে? বর্তমানে যারা দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলা করে জাতির সাথে ‘মীরজাফরি’ করছে, তাদের কি এত সাধু সাজা মানায়?

লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement