২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রাষ্ট্র : সংবিধান ও ভবিষ্যৎ নাগরিক

রাষ্ট্র : সংবিধান ও ভবিষ্যৎ নাগরিক - ছবি : নয়া দিগন্ত

ভিন্ন ভিন্ন সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থায় শিশুর বয়স নির্ধারণ নিয়ে ব্যতিক্রম থাকলেও ভালোমন্দ বা জৈবিক চাহিদা বুঝে ওঠার আগেই কোনো কোনো শিশু অপরাধী থেকে ভয়ঙ্কর অপরাধীতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। এ সম্পর্কে ১৪০০ সাল থেকেই মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে অনেক তথ্য আবিষ্কার করলেও এর সঠিক কারণ এখনো আবিষ্কার কিংবা প্রতিকারের সঠিক পন্থা উদ্ভাবন করা যায়নি। শিশুদের প্রথাগত অপরাধ, অসৌজন্যমূলক আচরণ যা একটি সমাজ স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয় না, এ ধরনের শিশু আচরণকে উইলিয়াম কক্সসন ১৪৮৪ সালে উবষরহয়ঁবহপু নামে অভিহিত করেছেন। খধঃরহ শব্দ উবষরহয়ঁবৎব থেকে উবষরহয়ঁবহপু শব্দের উৎপত্তি। খধঃরহ শব্দ ফব অর্থ ধাবিত হওয়া বা চলে যাওয়া (অধিু) এবং খরহয়ঁবৎব অর্থ পরিত্যক্ত (অনধহফড়হবফ)। এর অর্থ মোটা দাগে বলতে হয় যে, সমাজ কর্তৃক পরিত্যক্ত অবস্থার দিকে ধাবিত হওয়া শিশু বা কিশোর।

সমাজসংস্কারকেরা মনে করতেন, উবষরহয়ঁবহপু পড়হংরংঃবফ ড়ভ ংড়পরধষষু ঁহধপপবঢ়ঃবফ ধপঃং অর্থাৎ সমাজ যা গ্রহণ করে না তা-ই উবষরহয়ঁবহপু। মনস্তত্ববিদ মনে করছেন, উবারধঃবং ভৎড়স ঃযব হড়ৎসধষ অর্থাৎ অস্বাভাবিক আচরণই উবষরহয়ঁবহপু. সমাজবিজ্ঞানী ডব্লিউ এইচ শেলডন মনে করেছেন, উরংধঢ়ঢ়ড়রহঃরহম নবুড়হফ ৎবধংড়হধনষব বীঢ়বপঃধঃরড়হ অর্থাৎ শিশুদের এমন একটি আচরণ বা ব্যবহার যা যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রত্যাশা করা যায় না। সিরিল বার মনে করতেন যে, ঙঁমযঃ ঃড় নবপড়সব ঃযব ংঁনলবপঃ ড়ভ ড়ভভরপরধষ অপঃ অর্থাৎ শিশুদের এমন কোনো আচরণ যার জন্য কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়।

শিশুদের কোন কার্যটি উবষরহয়ঁবহপু বা বখাটে হওয়া, সে সম্পর্কে আইনগত ব্যাখ্যা ১৮৯৯ সালের আগে কোনো রাষ্ট্র বা আইনগত সংস্থা দেয়নি। আমেরিকার ইলিনয় রাজ্যে (ঝঃধঃব) সর্বপ্রথম উবষরহয়ঁবহপু কে আইনগত ফৌজদারি অপরাধের আওতাভুক্ত করা হয়। আমেরিকার অন্য একটি রাজ্যে, তথা নিউ মেক্সিকোতে ‘বখাটে’ শিশুর সংজ্ঞায় উল্লেখ করা হয় যে, অ পযরষফ ধং ড়হব যিড়, নু যধনরঃঁধষষু ৎবভঁংরহম ঃড় ড়নবু ঃযব ৎবধংড়হধনষব ধহফ ষধভিঁষ পড়সসধহফ ড়ভ যরং ঢ়ধৎবহঃং ড়ৎ ড়ঃযবৎ ঢ়বৎংড়হং ড়ভ ষধভিঁষ ধঁঃযড়ৎরঃু রং ফববসবফ ঃড় নব যধনরঃঁধষষু ঁহপড়হঃৎড়ষষবফ, যধনরঃঁধষষু ফরংড়নবফরবহঃ ড়ৎ যধনরঃঁধষষু ধিুধিৎফ, ড়ৎ যিড় যধনরঃঁধষষু রং ধ ঃৎঁধহঃ ভৎড়স যড়সব ড়ৎ ংপযড়ড়ষ ড়ৎ যিড় যধনরঃঁধষষু ংড় ফবঢ়ড়ৎঃং যরসংবষভ ধং ঃড় রহলঁৎব ড়ৎ বহফধহমবৎ ঃযব সড়ৎধষং, যবধষঃয ড়ৎ বিধষঃয ড়ৎ বিষভধৎব ড়ভ যরসংবষভ ড়ৎ ড়ঃযবৎং. তবে শিশুরা কেন বখাটে হয় এ মর্মে সবার গ্রহণযোগ্য নিশ্চিত কোনো সংজ্ঞা এখনো পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের মূল জনগোষ্ঠীর অর্ধেক জনসংখ্যার বয়স ১৮ বছরের নিচে।

নিজে জীবনে অনেকবার কারাভোগ করেছি। ২০১৭ নভেম্বর মাসে সরকারের দেয়া ‘গায়েবি’ নাশকতা মামলায় নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে কিছু দিন আটক ছিলাম। সেখানে দেখলাম, প্রায় ৫০ শতাংশ আসামির বয়স ১৮ বছরের নিচে। জেল সুপারের সম্মতি নিয়ে তাদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে আলাপ করে জানতে পারলাম, ওদের প্রায় সবাই নেশাগ্রস্ত।

ইয়াবা বিক্রি বা ইয়াবা, ফেনসিডিল খাওয়ার দায়ে গ্রেফতার হয়েছে। বাংলাদেশে এখন খুবই কম পরিবার রয়েছে যেখানে নেশাগ্রস্ত শিশু-কিশোর যুবক নেই। তবে স্বস্তির বিষয় হলো, লেখাপড়া করে, ভবিষ্যৎযোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য যে প্রস্তুতি নেয়া দরকার সেভাবেই গড়ে উঠছে এমন শিশু-কিশোরদের সংখ্যানুপাত বাড়ছে, যদিও আজো সন্তোষজনক নয়। এ জন্য পরিবেশ ও পারিবারিক শিক্ষাই প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশবাসীর মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রচারণার জোরে অনেক মিথ্যাকেই সত্য বলে সাময়িকভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। এদিকে অভাবের তাড়নায় পিতা-মাতা সন্তানদের হত্যা করছে। বাংলাদেশের সম্পদ মাত্র ১-২ শতাংশ মানুষের হস্তগত হয়েছে। জীবিকার তাড়নায় সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অভাবী মানুষেরা সাগরে ডুবে মরছে। এমন ঘটনা বেড়েই চলছে। অসচ্ছল পরিবার- যাদের নুন আনতে পানতা ফুরায়- তাদের সন্তানেরা স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে জীবিকার তাগিদে কর্মজীবনে জড়িয়ে পড়ে এবং হাতে কাঁচা পয়সা পেয়ে নেশার জগতে প্রবেশ করে। এটাই শিশুদের বখাটে হওয়ার একমাত্র কারণ নয়। অন্য দিকে, সচ্ছল পরিবারের শিশু-কিশোরদের বখাটে হওয়ার কারণ ঠিক উল্টো। ভোগ-বিলাসের জীবন কাটাতে গিয়ে, চাওয়ার আগেই হাতের নাগালে ভোগ্যসামগ্রী পেয়ে যাওয়া এবং পিতা-মাতার আচরণই এর মূল কারণ।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি থাকে, অন্য দিকে, স্কলার ছাত্রও পাওয়া যায় এবং যারা স্কলার তারা যে খুবই সচ্ছল পরিবারের সন্তান, তা নয়। পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও ইচ্ছাশক্তিই এখানে মূল ফ্যাক্টর। দেখা যাচ্ছে, ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা শিক্ষা ক্ষেত্রে এগিয়ে। কারণ সামাজিক প্রেক্ষাপটে মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের বখাটে হওয়ার সুযোগ বেশি।

জাতিসঙ্ঘের জরিপ মোতাবেক বস্তিবাসীর দিক থেকে ঢাকা পৃথিবীর অন্যতম প্রধান শহর এবং ঘন বসতির দিক থেকে এর প্রাধান্য রয়েছে। নদীভাঙন, বাঁধ ভেঙে বাড়িঘর ফসল তলিয়ে যাওয়া, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, খরা প্রভৃতির কারণে মানুষ যখন অসহায় হয়ে পড়ে তখনই জীবন জীবিকা অন্বেষণে কর্মসংস্থানের জন্য ঢাকামুখী হতে বাধ্য হয়। ফলে রাজধানীতে বস্তিবাসীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বস্তিগুলো নেশার জগৎকে সম্প্রসারিত করার জন্য বিরাট ভূমিকা রাখছে যাতে জড়িত রয়েছে প্রভাবশালী মহল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপথগামী সদস্যরা।

শিশু-কিশোরকে দিয়ে- বিশেষ করে নেশাগ্রস্ত শিশুকে দিয়ে যে কাজ সহজে ও অল্প পয়সা দিয়ে করানো যায়, অনুরূপ অপরাধ একজন বয়স্ক মানুষকে দিয়ে করাতে হলে বেশি পারিশ্রমিক দিতে হয়। অন্য দিকে, একজন বখাটে শিশু-কিশোর যত সহজে অপরাধ সংঘটনের ঝুঁকি নেয়, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক তা নেয় না। ফলে অপরাধ জগতের যারা হোতা বা এড়ফ ঋধঃযবৎ তারা শিশু-কিশোরদেরই বেছে নেয়। ফলে শিশু-কিশোর অপরাধ দিন দিন বেড়েই চলেছে, যা মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে।

সরকার প্রাথমিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে উপ-বৃত্তি দিয়ে শিশুদের শিক্ষার পথ প্রশস্ত করেছে বটে। কিন্তু সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে শিশুদের শিক্ষার আওতায় আনার বাধ্যতামূলক কোনো কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে পারেনি। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৭তে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা (ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য, (খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য ও (গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও রাষ্ট্র সংবিধানের মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। যেমন সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদে পরিষ্কার লেখা রয়েছে যে, ‘গণিকাবৃত্তি ও জুয়া খেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন’; অথচ এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রে ১৮টি রেজিস্টার্ড পতিতালয় রয়েছে এবং আনরেজিস্টার্ড পতিতালয় কত, এর হিসাব-নিকাশ নেই। রেজিস্টার্ড ও আনরেজিস্টার্ড পতিতালয়ে বহু শিশু-কিশোরী যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করছে, কেউ পরিস্থিতির শিকার হয়ে বা কেউ অভাবের তাড়নায়।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও এবং রাষ্ট্র ভবিষ্যৎ নাগরিকদের যোগ্য নাগরিক অর্থাৎ রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবারের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে- এমনিভাবে শিশুকে পরিচর্যা ও লালন পালনের দায়িত্ব থাকলেও বিভিন্ন প্রতিকূলতা, বিশেষ করে সম্পদের সুষমবণ্টনের অব্যবস্থাই এ জন্য দায়ী। সরকারের প্রশ্রয়ে রাষ্ট্রের সম্পদ ১-২ শতাংশ লোকের হাতে বন্দী হয়ে পড়ায় জাতীয় অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনায় গোটা সমাজব্যবস্থাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এর অন্যতম প্রধান ভিকটিম শিশু-কিশোররা, যাদের হতে হবে দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। কবির ভাষায় বলতে হয়, ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’ সরকারের উন্নয়নের বয়ান যতই বাগাড়ম্বর হোক না কেন, শিশু-কিশোর উন্নয়ন সামগ্রিকভাবে অবিলম্বে হওয়া বাঞ্ছনীয়।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থা, সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতি


আরো সংবাদ



premium cement