২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সুশাসন

সম্পদের অপচয় আর কতকাল?

সম্পদের অপচয় আর কতকাল? - নয়া দিগন্ত

রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। জনগণের দেয়া করের অর্থেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় রাষ্ট্রের কোষাগারে সঞ্চিত অর্থ দু’ভাবে ব্যয় হয়ে থাকে। এর একটি হলো রাজস্ব ব্যয়; অপরটি উন্নয়ন ব্যয়। রাজস্ব ব্যয় দ্বারা রাষ্ট্রের কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বেতনভাতা ও সুযোগ-সুবিধা নির্বাহ করা হয়। অপর দিকে, উন্নয়ন ব্যয় দ্বারা রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করা হয়। সুদৃঢ় সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য একান্ত অপরিহার্য।

প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব ধরনের বিদ্যালয়, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে জেলা হাসপাতালসহ স্বাস্থ্যসেবাদানকারী সব ধরনের প্রতিষ্ঠান সামাজিক অবকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে চলাফেরা ও যাতায়াতের জন্য সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা এবং বহিঃরাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ রক্ষায় ব্যবহৃত স্থাপনাগুলো অর্থনৈতিক অবকাঠামোর পরিধির আওতাধীন। উভয় ধরনের অবকাঠামো নিশ্চিতকরণের প্রাথমিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়।

এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের মূল ভূমিকা হলো প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ জোগানের ব্যবস্থা করা এবং রাষ্ট্রস্থ বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে প্রকল্প কাজের তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধন। প্রকল্প কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব বিভিন্ন বেসরকারি নির্মাণপ্রতিষ্ঠান বা ঠিকাদারকে দেয়া হয়ে থাকে এবং সচরাচর দেখা যায়, দরপত্রে অংশগ্রহণকারী সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি কার্যাদেশ লাভ করে থাকে।

তবে বিগত তিন দশকেরও অধিক সময় ধরে দরপত্রে অংশগ্রহণকারীদের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগাভাগি করে নেয়া অথবা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অন্যদের বঞ্চিত করে কাজ নেয়ার প্রবণতা এত ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে যে, সর্বনিম্ন দরদাতার কাজ পাওয়ার নজির এখন শুধুই ইতিহাস।

কাজ পাওয়ার সাথে রাজনৈতিক প্রভাব যুক্ত হওয়ার পর থেকে কাজ পেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের কার্যাদেশ পাওয়ার পরক্ষণেই সামগ্রিক কাজের মূল্যের একটি অংশ- সাধারণত কাজভেদে শতকরা ৫ থেকে ২০ ভাগ রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের দিয়ে দিতে হয়। এরপর কার্যাদেশপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিজ লাভ এবং বিভাগীয় কর্মকর্তাদের প্রতিটি বিলের বিপরীতে যে পরিমাণ অর্থ দিতে হয় তা বিবেচনায় নিলে অতি সহজেই অনুমান করা যায়, কাজের সামগ্রিক মূল্যের কত শতাংশ অর্থ দ্বারা কাজটি সমাধা করা হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, কাজভেদে কার্যাদেশপ্রাপ্ত ঠিকাদার বা নির্মাণপ্রতিষ্ঠান প্রকল্প ব্যয়ের শতকরা ১০ থেকে ৬০ ভাগ পর্যন্ত ভাগাভাগি করে অবশিষ্ট অর্থ দিয়ে কাজগুলো সমাধা করে থাকে।

রাষ্ট্রস্থ সরকারের বেশির ভাগ বিভাগে দরপত্রের মাধ্যমে কাজপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে অশুভ শক্তি নির্ণায়ক হওয়ায় কাজের মান কাক্সিক্ষত মাত্রার অনেক নিম্নে। তা সত্ত্বেও এটা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কারো কোনো ধরনের মাথাব্যথা নেই। আর এ কারণেই রাষ্ট্রের অর্থ ও তদসংশ্লেষে প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণ এবং এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে সরাসরি যেসব প্রাকৃতিক সম্পদ অথবা প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে প্রস্তুতকৃত সামগ্রীর প্রয়োজন পড়ে তা হলো- ইট, পাথর, বালু, সিমেন্ট, লোহা, কাঠ, বাঁশ প্রভৃতি।

স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করা হলে প্রকৃতি কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হয় না যেমন- বৃষ্টির কারণে পাহাড় থেকে পাথর ও বালু গড়িয়ে নদীর তলদেশে সঞ্চিত হয় এবং সেখান থেকে প্রতি বছর পাথর ও বালু সংগ্রহ করা হলে নদীর প্রবাহ কোনোভাবে বিঘ্নিত হয় না। কিন্তু প্রকৃতিকে বাধাগ্রস্ত করে যদি পাথর, বালু কিংবা অন্যান্য খনিজসম্পদ আহরণ করা হয়, সে ক্ষেত্রে প্রকৃতি নানাভাবে বৈরী পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে থাকে।

যেমন- পাহাড় কেটে বা পাহাড়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে যদি বালি বা পাথর সংগ্রহ করা হয়, সে ক্ষেত্রে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে চতুর্মুখী বিপর্যয় দেখা দেয়। তাই প্রকৃতিকে বাধাগ্রস্ত না করে, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্রকৃতি থেকে সম্পদ আহরণ করা হলে প্রকৃতির পক্ষ থেকে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা ক্ষীণ।
আমাদের দেশে যে হারে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোসংশ্লিষ্ট নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তার জন্য এবং বিদ্যমান অবকাঠামোকে উপযোগী রাখার জন্য যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ প্রয়োজন, তা আমরা প্রকৃতি থেকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আহরিত সম্পদ দ্বারা সম্পন্ন করতে পারছি না। চাহিদা ও জোগানের এ সমন্বয়হীনতার কারণে বাধ্য হয়েই আমাদেরকে বিকল্প পন্থায় সম্পদ আহরণে উদ্যোগী হতে হচ্ছে। আর এ বিকল্প পন্থায় সম্পদ আহরণ অভ্যন্তরীণ উৎস বা আমদানি যেভাবেই হোক না কেন, তাতে প্রকৃতি বাধাগ্রস্ত হয়।

আমাদের দেশে পাথর সহজলভ্য না হওয়ায় অবকাঠামো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে বিপুল ইটের প্রয়োজন হয়। দেশে এমন কোনো উপজেলা পাওয়া যাবে না, যেখানে দু-চার-দশটি ইটভাটা নেই। ইট পোড়ানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ১৯৮৯ এবং ইট পোড়ানো (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ১৯৮৯-এ যদিও শহর ও বনভূমির সন্নিকটে ইটভাটা স্থাপনের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দেয়া আছে; কিন্তু আইন ও বিধিটি যে যথাযথভাবে প্রতিপালন হয় না, তা ইটভাটাগুলোর অবস্থানের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে স্পষ্টভাবেই প্রতিভাত হয়।

ইট প্রস্তুত করার প্রধান কাঁচামাল মাটি এবং এ মাটি ইটভাটার পাশের ফসলি জমি থেকে সংগ্রহ করা হয়। এতে দেখা যায়, এক দিকে ফসলি জমির উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং অপর দিকে, মাটি উত্তোলনের কারণে ফসলি জমি নিম্নভূমিতে রূপান্তরিত হয়ে পতিত ভূমিতে পরিণত হচ্ছে। কয়লা দিয়ে ইট পোড়ানো কাঠ দিয়ে পোড়ানোর চেয়ে ব্যয়বহুল বিধায় ইটভাটা মালিকেরা অধিক লাভের আশায় আইন লঙ্ঘন করে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানোর ব্যাপারে অধিক আগ্রহী হন।

এতে আমাদের সীমিত বনজসম্পদ উজাড় হয়ে যাচ্ছে। উচ্চমানের কয়লা দিয়ে ইট পোড়ানো হলে ইটের মান যতটা উন্নত হয়, সে অনুপাতে লাভ কম হওয়ায় ইটভাটা মালিকদের নিম্নমানের কয়লা ও কাঠ দিয়ে ইট পোড়াতে উদ্যোগী হতে দেখা যায়। এ কারণে বেশির ভাগ নির্মাণকাজে যে ইট ব্যবহার করা হয় তার মান তেমন উন্নত নয়।

পাথরেরও মানভেদ রয়েছে। নির্মাণপ্রতিষ্ঠানের মালিক ও ঠিকাদারেরা অধিক লাভের আশায় নিম্ন বা মাঝারি মানের পাথর দিয়ে দায়সারাভাবে কাজ সম্পন্ন করতে চান। ইট ও পাথরের মতো বালুরও প্রকারভেদ রয়েছে। ভালো মানের বালু গাঁথুনিকে শক্তভাবে ধরে রাখে এবং এটি অপেক্ষাকৃত ব্যয়বহুল। তাই বালুর ক্ষেত্রেও নির্মাণপ্রতিষ্ঠানের মালিক ও ঠিকাদাররা লাভের বিষয়টি মাথায় রেখে নিম্ন বা মাঝারি মানের বালু ব্যবহারেই অধিক আগ্রহী।

কোন ধরনের কাজে সিমেন্ট ও বালুর মিশ্রণের অনুপাত কী হবে এবং ঢালাই কাজের ক্ষেত্রে সিমেন্ট ও বালুর সাথে ইট বা পাথরের খোয়ার পরিমাণ কী হবে, তার মাত্রা নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, লাভের কথা মুখ্য ভেবে সিমেন্টের অনুপাত কম দিয়ে বালু ও ইট বা পাথরের খোয়ার অনুপাত বেশি দেয়া হয়। এ ভারসাম্যহীনতার কারণে অনেক কাজই স্থায়িত্ব পাওয়া দূরের কথা, বছর না ঘুরতেই ধসে বা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়।

আমাদের বিভিন্ন শহরের সড়ক ও ফুটপাথ নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে প্রস্তুত করায় স্বল্প সময়ের মধ্যেই তা বিনষ্ট হয়ে চলাচলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। সিমেন্ট, বালু, ইট বা পাথরের খোয়ার সমন্বয়ে কংক্রিটের ঢালাই দ্বারা নির্মিত সড়ক ও ফুটপাথের দিকে তাকালে দেখা যায়, নির্মাণ-পরবর্তী অল্প কিছু দিনের মধ্যে ঢালাইয়ের খোয়া উঠে গিয়ে সড়ক ও ফুটপাথে গর্তের সৃষ্টি হয়ে, এবড়োখেবড়ো রূপ ধারণ করে চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

একই সামগ্রী দিয়ে নির্মিত সড়ক ও ফুটপাথ বিদেশে দীর্ঘ দিনেও নষ্ট হয় না। এর কারণ একটি; আর তা হলো, সেখানে কাজের মান ভালো। বিদেশে বিশেষ করে উন্নত দেশে দেখা যায় সেখানে ফুটপাথের উপরিভাগ প্যাচওয়ার্ক (patch work)-এর মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। কংক্রিটের ঢালাইয়ের সাথে প্যাচওয়ার্কের পার্থক্য হলো- ঢালাইয়ের খোয়া উঠে গেলে ঢালাই নতুনভাবে করতে হয়; কিন্তু প্যাচওয়ার্কের ক্ষেত্রে যতটুকু জায়গায় কাজ নিচের দিকে দেবে বা অন্য কোনোভাবে বিনষ্ট হয়, ততটুকু মেরামত করলেই চলে।

২০০২ সালে বিচারপতি নঈমুদ্দিন সমেত মস্কো সফরকালে প্যাচওয়ার্কের মাধ্যমে নির্মিত ফুটপাথের মেরামত দেখে তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আমাদের দেশে প্যাচওয়ার্কের মাধ্যমে ফুটপাথ নির্মাণ করা হলে রাষ্ট্রের অর্থ ও প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় রোধ করা সম্ভব হতো। বিচারপতি নঈম আজ বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে তিনি হয়তো দেখতেন তার সে আক্ষেপ বিলম্বে হলেও বাস্তবে রূপ পাচ্ছে। এখন ঢাকা শহরের অনেক ফুটপাথের নির্মাণ প্যাচওয়ার্কের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হচ্ছে এবং দেশবাসী ইতোমধ্যে এর সুফল লাভ করছেন।

প্রকৃতি যেভাবে আমাদের জীবনকে সুন্দরভাবে উপভোগ করার জন্য অবিরাম প্রতিটি সামগ্রীর জোগান দিয়ে চলছে, সরবরাহ ও চাহিদার সমন্বয়হীনতার কারণে সে জোগানে যেন ভাটা না পড়ে, এ বিষয়ে প্রকৃতির প্রতি আমাদের দায়ভার রয়েছে। এ দায়ভার আমরা তখনই মেটাতে পারব যখন কোনো ধরনের অবকাঠামো নির্মাণে লাভের কথাকে মুখ্য না ভেবে কাজের মান আর প্রাকৃতিক সম্পদের মানের বিষয়গুলো মুখ্য মনে করা হবে।

যেকোনো অবকাঠামোর কাজের মান এবং তাতে ব্যবহৃত প্রাকৃতিক সম্পদের মান নিম্ন বা মাঝারি হলে তা সময়ের সীমারেখায় উত্তীর্ণ হতে পারবে না। এর অর্থ দাঁড়ায় অবকাঠামোকে ব্যবহার উপযোগী রাখার জন্য রক্ষণাবেক্ষণের নামে পুনঃপুন অর্থ ব্যয়। এভাবে রক্ষণাবেক্ষণে আগের ধারা অব্যাহত থাকলে এ চক্র থেকে বের হয়ে আসা খুব সহজ হয় না। আর বের হয়ে না আসতে পারলে, রাষ্ট্রের অর্থ ও প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় আর কতকাল চলবে, সে কথা ভেবে দেশবাসী উদ্বিগ্ন।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com

দেখুন:

আরো সংবাদ



premium cement