২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নিশিরাত্রির দ্বিপ্রহর

-

‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ কবির এ বর্ণনার মর্মার্থের অভিজ্ঞতা বহু আগেই জনগণের হয়েছে। কথা ও কাজের সমন্বয় না থাকলেও শুধু কথামালার ফুলঝুরি উড়িয়ে দেশ শাসনসহ তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বুদ্ধিজীবী বা দেশপ্রেমিক বা দক্ষ শাসক বা প্রশাসক উপাধি পাওয়ায় আমাদের দেশে স্রোতের বিপরীতে মত প্রকাশ খুবই কণ্টকময়। বড় বড় রাজনৈতিক দলেও স্রোতের বাইরে যাওয়া বা প্রতিবাদ করা খুবই কষ্টদায়ক। কচুরিপানার মতো স্রোতের টানে ভেসে যাওয়ার ইতিহাস অনেক লম্বা। তবে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তর-সত্তরের স্বাধিকার আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, সর্বশেষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবির আন্দোলনে জাতি যে ভূমিকা রেখেছিল, বর্তমান সরকার ও রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে তেমনি অবস্থান আর দেখা যাচ্ছে না।

কেনই বা এ অবস্থার সৃষ্টি হলো তা গবেষণা তো দূরে থাক, বিষয়টি রাজনৈতিক মহলে, বিশেষ করে নিজ দলীয় মহলে পর্যালোচনা করতে গেলেও ব্যর্থতার দায় যে নেতার ওপর বর্তায় সে নেতাই সমালোচকের ওপর কালীমূর্তি ধারণ করেন। সভা শুরু হওয়ার আগেই বলা হয়, নেগেটিভ কোনো বক্তব্য দেয়া যাবে না। অর্থাৎ তেলের বাটি ঠোঁটে নিয়ে বক্তব্য শুরু থেকে শেষ করতে হবে। যাতে থলের বিড়াল আর প্রকাশ না পায়। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম সম্পাদন করার চর্চা দেশের চলমান রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রেই একটি অপসংস্কৃতি হিসেবে গড়ে উঠেছে, যা এখন পাকাপোক্ত রেওয়াজে পরিণত। এ অবস্থা শুধু রাজনৈতিক দলে নয় বরং সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাঠামোতে আরো বেশি, এ মর্মে বিচার বিভাগ নিয়ে কোনো কথা বলার অপেক্ষা রাখে না বা বলতে চাই না।

বহু কাক্সিক্ষত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী ৩০ ডিসেম্বর হতে যাচ্ছে। জনগণের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্বাচন, যার দিকে শুধু জাতি নয় গোটা বিশ্ব তাকিয়ে। কারণ, জনসংখ্যা ছাড়াও ভৌগোলিক পরিমণ্ডলে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ অত্যন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। বৈচিত্র্যময় এ দেশে রাজনীতির মাপকাঠিতে অনেক রাষ্ট্রের চেয়ে এ দেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশি মাত্রায় রাজনৈতিক উত্তাপ বিতরণ করে। যদি বাংলাদেশের রাজনীতি প্রতিহিংসাপরায়ণ না হতো, তবে রাজনীতির অনুশীলনের জন্য পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র থেকে রাজনীতির কৌশল নিয়ে হাতেখড়ি নিতে বাংলাদেশে আসত। বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে বাংলাদেশের সৃষ্টি। প্রকৃতির দিক থেকে দেশটি যেমন বৈচিত্র্যময় ঠিক তেমনি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল দিক থেকেও দেশটি অনেক বৈচিত্র্যময়। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতির ভাগ্যাকাশে কোন ‘তারা’ কখন প্রজ্বলিত হয় তা কেউ আঁচ করতে পারে না, এমনকি জ্যোতিষ বিদ্যাও এখানে অকৃতকার্য হতে বাধ্য। জোয়ার-ভাটার বৈচিত্র্যময় এ দেশে সকালের খবর বিকেলে মিথ্যা, বিকেলের খবর সকালে উল্টোভাবে প্রকাশ পায়। ফলে এটা বৈচিত্র্যের নিষ্ঠুরতা হোক বা উদারতা হোক তা উপভোগ করাই দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচার একটি নির্ভরযোগ্য অবলম্বন।

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন কতটুকু বৈচিত্র্যময় হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের দ্বিধাবিভক্তিসহ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনের বক্তব্যে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য মোতাবেক খুবই শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। একজন কমিশনার বর্তমানে চলমান সহিংসতাকে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখছেন। তার মতে, বিয়েবাড়ির উত্তাপের মতো এ সহিংসতাকে তিনি মনে করছেন। অথচ বর্তমান প্রেক্ষাপটে তার বক্তব্য একজন মূর্খের বক্তব্য না বললেও তাকে জ্ঞানপাপী না বললে অন্যায় করা হবে। কারণ, বাস্তবতা হচ্ছেÑ সহিংসতার জন্য বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা মাঠে নামতে পারছে না, প্রতিদিনই তাদের গাড়ি-বাড়িতে হামলা হচ্ছে, আঘাত ও মামলা দুটোই বিরোধী দলের কাঁধে। প্রার্থীরা শারীরিক আঘাতের শিকার হচ্ছেন।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, নির্বাচন চলাকালীন কোনো হয়রানি বা গ্রেফতার বা মামলা করা হবে না; অথচ ১৬ জন বিরোধীদলীয় প্রার্থী এখন গায়েবি মামলায় কারাগারে। হাজার হাজার নেতাকর্মী বাড়িঘর ছাড়া, যাদের এখন স্থায়ী অবস্থান হাইকোর্টের বারান্দা। সুপ্রিম কোর্ট শীতকালীন অবকাশে থাকায় ভ্যাকেশন বেঞ্চ থেকে আগাম জামিন নিতেও মামলায় অভিযুক্তদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিধিবাম হলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় সে অবস্থাই চলছে এখন বাংলাদেশে সরকারবিরোধীদের। তবে নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মুখ থেকে যে সুবাতাস বের হচ্ছে, তার সাথে বাস্তবতার ন্যূনতম সামঞ্জস্য নেই।

মানুষ আশায় ছিল, সেনাবাহিনী মাঠে থেকে তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করবে। প্রার্থীরা বিনা হামলা-মামলায় প্রচার অভিযান চালাতে পারবেন। সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা প্রদানের জন্য ঐক্যফ্রন্ট থেকে জোর দাবি করা হয়েছিল। সরকারের ভাষা অনুসরণে নির্বাচন কমিশন তা প্রত্যাখ্যান করেছে। সেনাবাহিনী জাতির জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ও আস্থাশীল প্রতিষ্ঠান। সেনাবাহিনী মাঠে থাকার পরও নির্বাচনী মাঠ যদি সমতল না হয়, তবে এর দায়ভার সেনাবাহিনীকেই বইতে হবে।

সরকারের সদিচ্ছা চাড়া কোনো কাজই শান্তিপূর্ণ বা সুষ্ঠু হতে পারে না। কারণ, সরকারের হাতে রয়েছে রেজিস্টার্ড লাঠিয়ালবাহিনী এবং আইন-আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করে জনগণের অধিকার হরণের একটি কৌশলিক ব্যবস্থাপনা সরকার অবলম্বন করেছে। এভাবে জাতিকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছে শুধু গালভরা বুলি আওড়িয়ে নিজেদের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে জনসমর্থন আদায়ের জন্য। অথচ গোটা দেশবাসীই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল, স্বাধীনতাবিরোধী ছিল হাতেগোনা ক’জন, যাদের সংখ্যা দুরবিন দিয়ে দেখার মতো। ৪৭ বছর আগে দেশ স্বাধীন হয়েছে, অথচ পাকিস্তান পাকিস্তান আতঙ্ক ছড়াচ্ছে সরকারি ঘরানার কিছু বুদ্ধিজীবী। এর কারণ তারা স্বাধীনতার সোল এজেন্ট হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।

যারা স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানের গন্ধ খুঁজে পান, তাদের নৈতিকতাবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলা দরকার। পাকিস্তান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র, মাত্র ২৪ বছরের মাথায় পাকিস্তান তার সুজলা সফলা শস্য শ্যামল একটি ভূখণ্ডকে ধরে রাখতে পারেনি শুধু বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য।

কলকাতামনস্ক কথিত মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবী সমাজ অভিনব পন্থায় বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ খুঁজে পায় এবং খোঁজার অনবরত চেষ্টা করে। অথচ বাংলাদেশ জাতীয়ভাবে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত একটি রাষ্ট্র। অন্য দিকে জনগোষ্ঠীর ৯২ শতাংশ মুসলমান হলেও এটা নিশ্চিত, ইসলাম সাম্প্রদায়িকতাকে সমর্থন করে না। ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবদ্দশায় সাম্প্রদায়িকতার কোনো ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়নি। ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে কারো ওপর তার নির্যাতন করার ইতিহাস আমাদের জানা নেই। তারপর জোরগলায় ইসলাম ধর্মের কথা বললে এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী সাম্প্রদায়িকতার জন্য মুসলমানদের দায়ী করে। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্ম, অধর্ম, ধর্মনিরপেক্ষতা বা ধর্মহীনতার পক্ষপাতিত্বহীন একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ব্যাপক আলোচনাভিত্তিক রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রকাশ করা অত্যন্ত জরুরি। নতুবা স্বার্থান্বেষী মহল এর অপব্যাখ্যার সুযোগ সৃষ্টি করছে অনবরত। ফলে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থেকেই যাচ্ছে, যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে সাধারণ নাগরিকদের কোনো ধরনের সম্মান প্রদর্শন করা হয় না। সরকারের সমালোচনা করলে বা সরকারে যাওয়ার চেষ্টা করলে রাষ্ট্র প্রতিপক্ষকে অনৈতিকভাবে নির্যাতন করে। কারণ, রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করে তাদের মর্জিমাফিক রাষ্ট্র পরিচালনায় যখন নিপীড়কের রূপ ধারণ করে তখন তাদের রাষ্ট্রযন্ত্র অর্থাৎ পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর নির্ভর করা ছাড়া অন্য কোনো পন্থা খোলা থাকে না। আদর্শভিত্তিক কর্মীবাহিনী গড়ে তোলাই একটি রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। কিন্তু দলীয় কর্মীবাহিনী তৈরি হচ্ছে পুলিশ ও প্রশাসন থেকে। ফলে লাভবান হচ্ছে দলীয় সরকার। পক্ষান্তরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের জনগণ এবং গণমানুষ হারাচ্ছে তাদের ন্যায্য অধিকার।

হিংসা থেকে প্রতিহিংসা এবং প্রতিহিংসা সহিংসতাকে জন্ম দেয়। ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশে এর পরিমাণ ও পরিমাপ জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। হিংসার আগুন জাতিকে জ্বালাচ্ছে শুধু ক্ষমতা আর ক্ষমতার জন্য। কিন্তু রাষ্ট্রীয় দখলদারিত্ব সম্পূর্ণভাবে একপেশে হওয়ায় হিংসার আগুন থেকে নিস্তার পাওয়ার আশায় আলো খুব সম্ভবনাময় বলে ধারণা করা যাচ্ছে না। সমাধানের সদিচ্ছা থাকলে সমাধান হওয়া কোনো কঠিন বিষয় নয়। তবে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। যদি তা না হয় হিংসা-প্রতিহিংসা ও সহিংসতার গজব থেকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়টি পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার ওপরই ছেড়ে দিতে হবে। ফলে নিশিরাত্রির দ্বিপ্রহর কখন উদয় হবে কে জানে? তবে জাতির স্বার্থে হতে হবে। নতুবা উন্নয়ন অনেক হবে, কিন্তু জাতি হারাবে তার নিজস্ব স্বকীয়তা।
লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী (আপিল বিভাগ)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement