২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের সিলভার লাইন

অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের সিলভার লাইন - ছবি : নয়া দিগন্ত

নির্বাচন কমিশনের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেশবাসীর চোখে যখন রঙ-বেরঙের একটার পর একটা শঙ্কা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস প্রভৃতি সব মিলিয়ে ধূম্রজাল অবচেতন মনে পাগলা হাওয়ার মতো বইতে শুরু করেছে, তখনই হঠাৎ প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলে উঠলেন, ‘ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে এ কথা আমরা বলি নাই’, ঝড়ো হাওয়াতে কুপিবাতি যেমন ধপ করে নিভে যায়, তেমনি সিইসির বক্তব্যে আসন্ন নির্বাচনের চিন্তায় সুতার যেন একটা হ্যাচকা টান পড়ল। এমনিতেই নির্বাচন কমিশনকে দেশের মানুষ গৃহপালিত দফতর মনে করে, যদিও সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১১৮ (৪) মোতাবেক ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন’ এ রকম স্বাধীনতা বিচার বিভাগকেও দেয়া হয়েছে, যার নমুনা বিচার প্রার্থী জনগণসহ দেশবাসী হারে হারে টের পাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন কতটুকু স্বাধীন তা তাদের আচরণ এবং বেগতিক কথা বললেই রাজধমকের পর ধমক খেয়ে সুবোধ বালকের মতো চুপসে যাওয়ার সংস্কৃতি থেকেই তা সহজে অনুমান করা যায়। জাতির এত বড় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব শুধু আমলাদের ওপর ছেড়ে দেয়া কতটুকু নির্ভরশীল হতে পারে তাও বিবেচনার বিষয়। 

দেশটি দুইবার স্বাধীন (১৯৪৭ ও ১৯৭১) হওয়ার পরও গণমানুষ যখন তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হলো তখন থেকেই অবিশ্বাস, আত্মবঞ্চনা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকে সাধারণ মানুষ এ দাবি নিয়েই রাজপথ রঞ্জিত করল, যা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। ঐকমত্যের ভিত্তিতে ৫৮ক ধারা সংশোধন করে সংবিধানে প্রতিস্থাপন হলো ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন’। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০১১ সালে ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন ২০১১ ইং ২১’ ধারা পাস করার পর সংবিধানের ৫৮ক ধারা বিলুপ্তি করা হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান আর রইল না তখন থেকেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে বড় দুই রাজনৈতিক দলই সফল হয়েছিল। অর্থাৎ মন্ত্রিসভা গঠন করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি প্রথমে জামায়াতে ইসলামী উপস্থাপন করলে আওয়ামী লীগ, বাম দল যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে ও পারস্পরিক আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে সংবিধান সংশোধিত হয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে সংযোজিত হয়েছিল, যা ছিল একটি আন্দোলনের ফসল, কিন্তু রাতারাতি সংবিধান থেকে ‘তত্ত্বাবধায়ক’ প্রভিশন মুছে ফেলা ছিল একদলীয় শাসনব্যবস্থার বহিঃপ্রকাশ, যা আওয়ামী লীগের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার একটি অভিলাষ মাত্র।

গত ১৪ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের সভায় অন্যতম কমিশনার মাহবুব তালুকদারের প্রদত্ত বিষয়বস্তুর ওপর আলোচনা করতে না দেয়ায় তিনি ওয়াকআউট করেছেন। তার প্রস্তাবিত আলোচনার বিষয়বস্তু যতটুকু জানা যায় তা নি¤œরূপÑ ক. জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনা মোতায়েন : আগের নির্বাচনগুলোতে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম মূল্যায়ন করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিভাবে তাদের ব্যবহার করা যায়, তা ঠিক করতে হবে; খ. অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন : অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে নির্বাচনে অনিয়মের পথ বন্ধ হয়। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ না হলে তা গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশকে সমর্থন করে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কমিশন দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে আলোচনা করতে পারে; গ. নির্বাচনে নিরপেক্ষতা : নির্বাচনের নিরপেক্ষতা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের ওপর নির্ভর করে নির্বাচনকালে সংসদ সদস্যদের নিষ্ক্রিয় রাখা নির্বাচন কমিশনের একার ওপর নির্ভর করে না। এতে সরকারের সহযোগিতা দরকার; ঘ. নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি : নির্বাচন কমিশনের যথেষ্ট ক্ষমতা আছে। কিন্তু ক্ষমতা প্রয়োগে সীমাবদ্ধতাও আছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে, রাজনৈতিক বাস্তবতায় কমিশন ক্ষমতা প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ওপর খুব একটা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। ক্ষমতা প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে কিভাবে আরো নিয়ন্ত্রণাধীন করা যায় তা দেখা উচিত, এবং ঙ. সরকারের সাথে সংলাপ : জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার নির্বাচন কমিশনের বড় অংশীজন। সংলাপে দেখা যায়, কিছু বিষয় রাজনৈতিক বা সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। এসব বিষয়ে সরকারের সাথে সংলাপ আবশ্যক।

মাহবুব তালুকদারের ওয়াকআউট বা তার প্রস্তাবিত বিষয়গুলোর ওপর আলোচনা করতে না দেয়ার পেছনে সরকারের প্রভাব অস্বীকার করার জো নেই। ওই বিষয়গুলো একটি গ্রহণযোগ্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে ছিল কি, ছিল না? জনগণ অবশ্যই ওই প্রস্তাবগুলোকে বিশ্লেষণ করে দেখবে। ইতঃপূর্বেও ইভিএম-সংক্রান্ত বিষয়ে মাহবুব তালুকদার দ্বিমত করেছিলেন। সেখানেও তার বক্তব্য গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি মুখ্য বিষয় নয়, বরং আলোচনা না করতে দেয়াই সন্দেহের জন্ম দেয়।

সরকার হাসিমুখে যেসব কঠিন আইন পাস করছে তার পরিণাম কী হতে পারে? একদলীয় শাসনব্যবস্থা না রাজতন্ত্র, তা অগ্রিম চিন্তা করাও আবান্তর হবে বলে মনে হয় কি? মিথ্যা তথ্য দেয়া বা মিথ্যা কথা বলা বা সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক কথা বললে যেমন অপরাধ হবে, সরকার যখন পুলিশ দিয়ে বিএনপি ও বিরোধী দলের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দেয় তার জন্য কোনো শাস্তির বিধান রাখলে সরকারের স্বচ্ছতার প্রমাণ মিলত। কিন্তু সরকার মিথ্যা এজাহার দেবে অথচ সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না বা সমালোচনা করা যাবে না, তাতো হয় না।

দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) নির্বাচন কমিশনের মতোই একটি স্বাধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সরকার যখন কারো প্রতি বিরাগভাজন হয় তখনই দুদক তার ওপর চড়াও হয়। যেমন- তারেক রহমানকে খালাস দেয়া বিচারক মোতাহার হোসেনকে দুদক তখন পর্যন্ত খোঁজেনি যতক্ষণ পর্যন্ত সরকারের বিরাগভাজন হননি। যেমনটি হয়েছে জোরপূর্বক পদত্যাগী প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, আমীর খসরু মাহমুদের বেলায়। এখন দেখা যাক ডা: জাফরউল্ল্যাহর ভাগ্যে কী জোটে? সবে কোটি টাকার চাঁদাবাজির আসামি হয়েছেন। সরকারের পক্ষে থাকলেই সাত খুন মাফ, আর বিরোধিতা করলে ‘স্বাধীন’ প্রতিষ্ঠানগুলো বিরোধীদের পিছু নেয়। স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, স্বাধীন দুদক সব ‘স্বাধীন’ মিলিয়ে পরাধীনতার যে নমুনা জনগণ দেখছে, তা থেকে এটাই প্রতীমান হয়, সরকারের ইচ্ছার বাইরে কোনো কাজ এ দেশে হবে না, তা যা-ই হোক না কেন, জাতীয় নির্বাচন তো অনেক দূরের কথা।

‘কোটি টাকার বউ’ নামে একটি সিনেমা রিলিজ হয়েছিল। এখন দেখছি জাতীয় নির্বাচনের জন্য ৭০০ কোটি টাকা বাজেট দিয়েছে, যা এ দেশের কৃষক জনতার মাথার ঘাম পায়ে ফেলানো কষ্টার্জিত অর্থ থেকে ব্যয় হবে। অথচ যাদের ট্যাক্সের অর্থে নির্বাচনী বাজেট পূরণ হবে, তাদের ভোট তারা কাক্সিক্ষত প্রার্থীকে দেয়ার মতো অবস্থান এখনো দৃশ্যমান নয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেই বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না এ নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না।

বিএনপির সামনে এখন কঠিন পরীক্ষা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে যে কারণে বিএনপি অংশ নেয়নি, সেই একই কারণ নিষ্পত্তি না করে বিএনপি যদি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তবে এত নেতাকর্মী যারা জেল, পঙ্গুত্ব বরণ করেছে; তাদের নিকট জবাব কী? দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি না হলে লেভেল প্লেইং ফিল্ডের কোনো নমুনা দৃশ্যপটে আসে না। তা ছাড়া, লেভেল প্লেইং ফিল্ড নিশ্চিত না করে নির্বাচনে অংশ নেয়ার নামান্তর হবে সরকারের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশের বৈধতা দেয়া।

সংবিধানের ৫৮(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিলে বা স্বীয় পদে বহাল না থাকিলে মন্ত্রীদের প্রত্যেককে পদত্যাগ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে, তবে এই পরিচ্ছেদের বিধানবলী সাপেক্ষে তাহাদের উত্তারাধিকারীগণ কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তাহারা স্বপদে বহাল থাকিবেন।’ এ ছাড়াও চলমান সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচনকালীন সময়েও জাতীয় সংসদ সদস্যরা স্বীয় পদে বহাল থেকেই নির্বাচন করতে পারবেন। আর প্রধানমন্ত্রী ও তার দল বা সরকার সংবিধান থেকে এক চুল পরিমাণ নড়বেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন, যেমনটি সেনাপ্রধান আইয়ুব, ইয়াহিয়া, এরশাদের মুখ থেকে দেশবাসী শুনেছে।

তারপরও তাদের নড়তে হয়েছিল বটে, তবে এ জন্য জাতিকে অনেক তেল-মরিচের ঝাল পোহাতে হয়েছে। এটাই এখন বলা বাহুল্য, চলমান সংবিধান মোতাবেক লেভেল প্লেইং ফিল্ড থাকার কোনো সুযোগ নেই। জাতি ঐক্যফ্রন্টের দিকে তাকিয়ে আছে, ঐক্যফ্রন্ট যদি তাদের দাবিতে অনড় থাকে, কোনো প্রকার আপস না করে বা কোনো কোনো নেতা বা দল তলে তলে আতাত না করে তবে সরকারের পক্ষে নৌকা দিয়ে এত বড় কণ্টকময় সাগর পাড়ি দেয়া দুরূহ হবে। ঐক্যফ্রন্টের দৃঢ়তা ও ঈমানী শক্তির ওপরই নির্ভর করছে অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের সিলভার লাইন। 
লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement