২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চামড়াশিল্পকে বাঁচাতে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

-

দেশের গুরুত্বপূর্ণ রফতানি খাত চামড়াশিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। চামড়াশিল্পের বিকাশে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অভাব, চামড়া শিল্পনগরীতে না করা সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি, বর্জ্য ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন (সিইটিপি), আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ট্যানারি মালিকদের কারসাজি, আন্তর্জাতিক বাজারে দরপতন, ব্যাংকঋণ প্রাপ্তি ও আদায়ে দীর্ঘসূত্রতা, প্রভৃতি কারণে চামড়াশিল্পে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলো সিন্ডিকেটের হাতে বন্দী। ধান, পাট, শেয়ারবাজার, ঠিকাদারিÑ সবখানে এক শ্রেণীর দুর্বৃত্তের অবাধ বিচরণ। বাজার ওঠা-নামার পেছনেও তাদের হাত সক্রিয়। কোনো কোনো স্থানে গরুর চামড়া সর্বনি¤œ ৫০ এবং ছাগলের চামড়া মাত্র ২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু বিশ^াসের মতে, চামড়ার দাম অবিশ^াস্য হারে কমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে ব্যবসায়ীদের কারসাজি। জানা দরকার ৫০ বছরের ইতিহাসে এটাই চামড়ার সর্বনি¤œ রেট।
সরকারের পক্ষ থেকে এবার গরুর কাঁচা চামড়ার দাম ঢাকায় নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রতি বর্গফুট ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। আর ঢাকার বাইরে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। সারা দেশে খাসির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৩ থেকে ১৫ টাকা। বিগত সাত বছরের মধ্যে সরকার নির্ধারিত এটাই সর্বনি¤œ রেট। ২০১৩ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল সর্বনি¤œ ৮৫ আর সর্বোচ্চ ৯০ টাকা। একইভাবে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়ার দর নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল সর্বনি¤œ ৫০ আর সর্বোচ্চ ৫৫ টাকা। কিন্তু কোনো আড়তদার বা ট্যানারির মালিক এ দামে চামড়া কিনতে সম্মত হননি। আমাদের দেশের চেয়ে ভারতে চামড়ার মূল্য বেশি।
ন্যায্য দাম না পেয়ে ঢাকার লালবাগ, কুমিল্লা, সিলেট, মৌলভীবাজার, রাজশাহী, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষ কোরবানির চামড়া রাস্তায় রেখে গেছে; ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে অথবা মাটিতে পুঁতে ফেলেছে। সিলেট পৌর কর্তৃপক্ষ ১০ টন চামড়া ভাগাড়ে নিক্ষেপ করেছে। মৌলভীবাজারে এক লাখ চামড়া পচে গেছে। অনেকে চামড়াকে লোমমুক্ত করে রান্না করে খাওয়ার সচিত্র বর্ণনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে চট্টগ্রামে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। অস্বাভাবিক দরপতনের কারণে আড়তদারদের কাছে চামড়া বিক্রি করতে না পেরে নগরীর বিভিন্ন স্থানে এক লাখেরও বেশি কোরবানির পশুর চামড়া বাধ্য হয়ে রাস্তায় ফেলে দেন মওসুমি ব্যবসায়ীরা। রাস্তা থেকে সেই পচা চামড়া ট্রাকে করে দুটি আবর্জনার ভাগাড়ে ফেলেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। এ অবস্থায় মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনও অনেকটা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, এ ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক ও নজিরবিহীন। এর পেছনে কোনো চক্রান্ত আছে কি না, তদন্ত হওয়া উচিত। তাই প্রশ্ন উঠেছে, চামড়ার বাজার ধ্বংসের পেছনে সিন্ডিকেট কাদের স্বার্থে কাজ করছে? অপর দিকে, আড়তদারদের বক্তব্য হলোÑ ট্যানারি মালিকদের কাছে তাদের ৫০ কোটি টাকা বকেয়া পাওনা থাকায় অর্থাভাবে তারা চামড়া কিনতে পারেননি। উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে আড়তদারের সংখ্যা ২৬২। ইতোমধ্যে বেশ কিছু ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেছে।
চামড়াশিল্পে বিপর্যয় নেমে আসার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মওসুমি কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন এতিমখানা কর্তৃপক্ষ। ব্যবসায়ীরা পুঁজি হারিয়ে পথে বসে গেছেন। চামড়া বিক্রি করলে তা অনাথ, এতিম, দরিদ্র ও দুস্থদের দান করাই শরিয়তের বিধান। এই স্বেচ্ছাদানের মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক মাদরাসা, হিফজখানা ও এতিমখানার লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের শিক্ষার্থীদের খাবার জোগান দেয়া হয়। বিক্রি করতে না পেরে তাদের অনেকে চামড়া পুঁতে ফেলতে বাধ্য হয়েছে। অনেকে লবণ মেখে সংরক্ষণ করেছেন যাতে পরবর্তীকালে কোনো সময় দাম পাওয়া গেলে বিক্রির আশায়।
বিদেশে চামড়া রফতানি করে বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকা আয় করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, দেশে বিভিন্ন প্রয়োজনে মাসে ৫০ লাখ বর্গফুট চামড়া বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। অথচ রফতানি করার পরও ১১ কোটি ঘনফুট চামড়া আমাদের দেশে অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। দেশে চামড়াজাত দ্রব্যের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে ২২ কোটি ঘনফুট চামড়া রফতানি করা যায়। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে ১১৩ কোটি ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে চামড়া খাত থেকে আয় হয় ৮৩ কোটি ৭১ লাখ ডলার। ছয় বছরে ৩০ কোটি টাকা হ্রাস পেয়েছে এই আয়।
বাংলাদেশে সারা বছরই পশু জবাই হয়। শহর, নগর ও গ্রামের বাজারে সর্বত্র গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার গোশত বিক্রি করা হয়। এতে জনগণের দৈনিক পুষ্টির চাহিদা যেমন মিটে, তেমনি চামড়ার উৎপাদনও বাড়ে। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, সারা বছর এ দেশে প্রায় দুই কোটি ৩১ লাখ গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া জবাই হচ্ছে। এর অর্ধেকই হয় কোরবানির ঈদে। গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া মিলিয়ে দেশে এ বছর কোরবানি হয়েছে প্রায় এক কোটি ১৬ লাখ পশু। বাংলাদেশের ২২০টি ট্যানারি থেকে বছরে প্রায় ২৫০ কোটি বর্গফুট কাঁচা চামড়া (হাইড ও স্কিন) প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এর মধ্যে ৬৩ দশমিক ৯৮ শতাংশই গরুর চামড়া। ছাগলের চামড়া ৩২ দশমিক ৭৪ শতাংশ ও মহিষের চামড়া ২ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং ভেড়ার চামড়া রয়েছে ১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। প্রক্রিয়াজাত চামড়ার মধ্যে ৭৬ শতাংশের বেশি রফতানি করা হয়। বাংলাদেশের ৯৩টি বড় নিবন্ধিত জুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বছরে প্রায় ৩৭ কোটি ৮০ লাখের বেশি জোড়া জুতা তৈরি করে থাকে।
চীন বাংলাদেশী চামড়ার অন্যতম প্রধান আমদানিকারক। এটা দিয়ে তারা জুতা, স্যান্ডেল, পার্স, ব্যাগ, বেল্ট তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পাঠাত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক ধার্যের হুমকি দিলে চীনের আমদানিকারকরা আগের দামে চামড়া কিনতে আগ্রহী নন। ফলে বাংলাদেশের চামড়া রফতানি বাণিজ্যে শুরু হয়েছে ভাটার টান।
দরপতনের কারণে বিপুল পরিমাণ চামড়া চোরাই পথে পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতে পাচার হয়ে যায়। ভারত চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজার ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। প্রতি বছর ৫১ মিলিয়ন গরু, ১২৮ মিলিয়ন ছাগল ও ভেড়ার চামড়া উন্নত দেশে রফতানি করে ভারত আয় করে ৬৭৭ মিলিয়ন ডলার। এর আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, হংকং, চীন, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ভিয়েতনাম। ভারতীয় চামড়ার বাজার ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে এটা।
বাংলাদেশের ট্যানারিগুলো আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর না হওয়ায় এবং সিইটিপি সুবিধাসংবলিত পর্যাপ্ত বর্জ্যশোধনাগার গড়ে না ওঠায় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য কেনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশী গরু, মহিষ, ভেড়া ও ছাগলের চামড়ার কদর রয়েছে।
‘আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার চাহিদা নেই, ট্যানারিগুলোতে আগের বছরের ৫০ শতাংশ চামড়া অবিক্রীত অবস্থায় রয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমান অবস্থায় এত চামড়ার চাহিদা নেই, চামড়া কেনার জন্য পর্যাপ্ত ব্যাংক ঋণ পাওয়া যায়নি, ইত্যাদি কারণ দেখিয়ে এতদিন ট্যানারিমালিকরাই কাঁচা চামড়া কেনার প্রতি অনাগ্রহ দেখিয়ে এসেছেন। ফলে এ বছর কোরবানির ঈদের পর সারা দেশে কাঁচা চামড়া বিক্রিতে ধস নামে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য গত ১৩ আগস্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত মূল্যে কাঁচা চামড়া ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে না। তাই চামড়ার উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করতে সরকার কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ এ বিষয়ে চামড়া শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের দায়িত্বশীল হওয়ারও আহ্বান জানানো হয়।
সরকারের কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্তের পর নড়েচড়ে বসেন ট্যানারি মালিকরা। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) এবং বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএলএলএফইএ) ১৪ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে সরে আসার দাবি জানায়। এতে দেশীয় ট্যানারিগুলো কাঁচা চামড়ার সঙ্কটে পড়বে বলে তাদের অভিযোগ। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এখনো চামড়া রফতানির সিদ্ধান্তে অটল কূটনৈতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশকে চামড়ার বাজার খুঁজতে হবে। সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চামড়াজাত দ্রব্য রফতানির কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এই সিদ্ধান্তটি আগেভাগে নিলে মাঠপর্যায়ের মওসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচতে পারতেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সাথে বসে সমস্যা চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধানের পথ বের না করলে ঐতিহ্যসমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময় চামড়াশিল্প ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। হ
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ওমরগণি
এমইএস কলেজ, চট্টগ্রাম।


আরো সংবাদ



premium cement
রাজশাহীতে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়াল যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ভিসা সহজ করার আহ্বান প্রবাসী প্রতিমন্ত্রীর চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে অংশীদার হওয়া উচিত : শি জিনপিং ওকাব সভাপতি নজরুল ইসলাম, সম্পাদক জুলহাস আলম পাবনায় ১০ কোটি টাকার অনিয়মে ৩ ব্যাংক কর্মকর্তা কারাগারে চুয়েট ১১ মে পর্যন্ত বন্ধ, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত নরসিংদীতে হিট স্ট্রোকে শিশুর মৃত্যু হিলিতে ভটভটি-মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে নিহত ২ ‘গাজার ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করতে ১৪ বছর লাগতে পারে’ সখীপুরে ছাগল চুরির মামলায় মা-ছেলে কারাগারে ‘অন্যায়ের সাথে নয়া দিগন্তের সাংবাদিকরা কখনোই আপোষ করেন না’

সকল