ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের পদত্যাগ প্রসঙ্গে জামায়াতের আন্দোলন ও রাজনীতির নিবিড় পর্যবেক্ষক সাবেক সচিব শাহ আব্দুল হান্নান বলেছেন, জামায়াতের মধ্যে কোন সংস্কার হয়নি বলে উল্লিখিত বক্তব্য সঠিক নয়। এর মধ্যে জামায়াতের কার্যক্রমে অনেক সংস্কার ও অগ্রগতি হয়েছে। জামায়াত নারীদের সংসদ সদস্য নির্বাচিত করে সংসদে পাঠিযেছে। উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত করেছে অনেককে। জামায়াতের নারী সদস্যের সংখ্যা এখন অর্ধেকের কাছাকাছি পৌঁছেছে। মেয়েদের রুকন করার ব্যাপারে কড়াকড়ি শিথিল করা হয়েছে। দলের সংখ্যালঘু সদস্য করা হয়েছে ৮০ হাজারের কাছাকাছি। সামনে এ সংখ্যা আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
জনাব শাহ হান্নান পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী আর বাংলাদেশ জামায়াত এক নয় বলে উল্লেখ করে বলেন, বর্তমান জামায়াতে ইসলামী ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।স্বাধীনতার সময়ের ভূমিকার জন্য তাদের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি প্রাসঙ্গিক নয়। এর পরও দলের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম জেল থেকে মুক্তি পাবার পর বায়তুল মোকাররমে জামায়াতের বিশাল জনসভায় ১৯৭১ সালে জামায়াতের সে সময়ের রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য দু:খ প্রকাশ করেছেন। প্রয়োজন মনে করা হলে এখন আবারো ক্ষমার বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে।
জামায়াতের নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে জনাব শাহ হান্নান বলেন, রাজনৈতিক দলের কিছু ঐতিহাসিক নাম রয়েছে। যেমন মুসলিম লীগ ভারতে, পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে রয়েছে । একইভাবে জামায়াতে ইসলামীও ভারত পাকিস্তান এমনকি শ্রীলঙ্কায়ও রয়েছে। ১৯৭৯ সালে এখানে যে জামায়াত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটি নতুন জামায়াতে ইসলামী। একেবারে অল্প সংখ্যক রয়েছেন যারা স্বাধীনতা পূর্ব জামায়াতের সাথে যুক্ত ছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সংবিধান, রাজনৈতিক বাস্তবতা এসব কিছু মেনে নিয়েই জামায়াত এখানে কাজ করছে। জামায়াতের বিলুপ্তির প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এরপরও জামায়াত হয়তো রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে সরে আসতে পারে। ইসলামের প্রচার ও সমাজ কল্যাণমূলক কাজ দলের নতুন ফোকাস হতে পারে। আর কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি নিয়ে ভিন্ন কোন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাকের পদত্যাগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি এই সিদ্ধান্তটিকে সঠিক বলে মনে করি না। কোন সংগঠন বা ফোরামে সবার সব পরামর্শ গৃহীত হবে এমনটি বাস্তব সম্মত নয়। এরপরও এটি তার অধিকার। আমি তার সব ধরনের কল্যাণ কামনা করি।
জামায়াত থেকে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের পদত্যাগ
নয়া দিগন্ত অনলাইন ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৯:২৯
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগ করেছেন দলের অন্যতম সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। শুক্রবার ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের ব্যক্তিগত সহকারী কাউসার হামিদ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়। জামায়াতের পক্ষ থেকে এটি নিশ্চিত করা হয়েছে এবং এ ব্যাপারে দলের সেক্রেটারি জেনারেল একটি বিবৃতি দিয়েছেন।
বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের এই সিনিয়র আইনজীবী। এসেক্সের বারকিং থেকে তিনি পদত্যাগের চিঠিটি পাঠান।
চিঠিতে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর আজও দলের নেতৃবৃন্দ ৭১-এর ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাইতে পারেননি। এমনকি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রসঙ্গে দলের অবস্থানও ব্যাখ্যা করেননি।’
তিনি বলেন, ‘অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতের ক্ষতিকর ভূমিকা সম্পর্কে ভুল স্বীকার করে জাতির সাথে সে সময়ের নেতাদের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে পরিস্কার অবস্থান নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে’।
১৯৮৬ সালে জামায়াতের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া ব্যারিস্টার রাজ্জাক পদত্যাগপত্রে বলেন, ‘গত প্রায় দুই দশক তিনি জামায়াতকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে ৭১-এ দলের ভূমিকা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া উচিত এবং ওই সময়ে জামায়াতের ভূমিকা ও পাকিস্তান সমর্থনের কারণ উল্লেখ করে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত’।
তিনি উল্লেখ করেন,‘জামায়াত ৬০-এর দশকে সব সংগ্রামে যেমন অংশ নিয়েছে, তেমনি ৮০-র দশকে আট দল, সাত দল ও পাঁচ দলের সাথে যুগপৎভাবে সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। কিন্তু দলটির এসব অসামান্য অবদান ৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার ভুল রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে স্বীকৃতি পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা পরবর্তীকালে জামায়াতের সব সাফল্য ও অর্জন ম্লান করে দিয়েছে’।
তিনি বলেন, ‘২০০১ সালে জামায়াতের সে সময়ের আমীর এবং সেক্রেটারি জেনারেল মন্ত্রী হওয়ার পর বিজয় দিবসের আগেই ১৯৭১ নিয়ে বক্তব্য দেয়ার জন্য তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন একটি কমিটি এবং বক্তব্যের খসড়াও তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি’।
এছাড়া, ২০০৫ সালে কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের বৈঠকেও তিনি প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন এবং ২০০৭-০৮ সালে জরুরি অবস্থার সময়েও তিনি জামায়াতকে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে ২০১১ সালে মজলিসে শুরার সবশেষ প্রকাশ্য অধিবেশনেও তিনি বিষয়টি তুলে ধরেন, কিন্তু দলের শীর্ষ নেতাদের একাংশের অবহেলায় তার প্রস্তাব পরাজিত হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এরপরে ২০১৬ সালের ১৯শে মার্চ বর্তমান আমীর মকবুল আহমদকেও চিঠি পাঠিয়ে ১৯৭১ প্রসঙ্গে বক্তব্য দেয়ার প্রস্তাব দেন জনাব রাজ্জাক। মকবুল আহমদ আমীর হওয়ার পর ২০১৬ সালের নভেম্বরে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের মতামত চাইলে তিনি জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া সংক্রান্ত একটি খসড়া বক্তব্য পাঠান কিন্তু সেটিও আর বাস্তবায়িত হয়নি।
ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, ‘সবশেষে ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর জানুয়ারি মাসে জামায়াতের করণীয় সম্পর্কে আমার মতামত চাওয়া হয়। আমি যুদ্ধকালীন জামায়াতের ভূমিকা সম্পর্কে দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দেই। অন্য কোন বিকল্প না পেয়ে তখন বলেছিলাম, জামায়াত বিলুপ্ত করে দিন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আমার তিন দশকের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে’।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক তার পদত্যাগপত্রে বৈশ্বিক রাজনীতির বাস্তবতা ও একাত্তরে দলের ভূমিকা নিয়ে বর্তমানে যে প্রভাব, তা তুলে ধরেছেন দলের আমীরের কাছে।
জামায়াতে যোগ দেয়ার পর তিনি দলের ভেতর থেকে সংস্কারের চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করে ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, ‘বিগত ৩০ বছর আমি সেই চেষ্টাই করেছি। আমি কাঠামোগত সংস্কার ও নারীর কার্যকর অংশগ্রহণের পক্ষে ছিলাম। ২০১৬ সালে চিঠি দিয়ে অভ্যন্তরীণ সংস্কারের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছি। অন্য মুসলিম দেশগুলোর উদাহরণ দিয়েছি। কিন্তু কোনো ইতিবাচক সাড়া পাইনি’।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক দলের সর্বশেষ পদক্ষেপ তাকে হতাশ করেছে বলেই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মর্মে উল্লেখ করেন।
জামায়াতের বক্তব্য:
ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগের ব্যাপারে গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগ থেকে পাঠানো ওই বিবৃতিতে জানানো হয়, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক জামায়াত থেকে পদত্যাগ করেছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারী জেনারেল ডা: শফিকুর রহমান শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছেন,‘ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকসহ আমরা দীর্ঘদিন একই সাথে এই সংগঠনে কাজ করেছি। তিনি জামায়াতে ইসলামীর একজন সিনিয়র পর্যায়ের দায়িত্বশীল ছিলেন। তার অতীতের সকল অবদান আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি’।
ডা. শফিক বলেন, ‘তার পদত্যাগে আমরা ব্যথিত ও মর্মাহত। পদত্যাগ করা যে কোনো সদস্যের স্বীকৃত অধিকার। আমরা দোয়া করি তিনি যেখানেই থাকুন, ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন’।
বিবৃতিতে ডা:শফিকুর রহমান বলেন,‘আমরা আশা করি তার সাথে আমাদের মহব্বতের সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে’।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা