১৭ মে ২০২৪, ০৩ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫
`


রাফায় হামলা ঠেকাতে দলীয় চাপে বাইডেন

-

- যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে বিতর্কিত বিল পাস
- ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা কলম্বিয়ার
- নেতানিয়াহুকে ইসরাইলি তদন্ত সংস্থার জিজ্ঞাসাবাদ

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার রাফাহ শহরে ইসরাইলি হামলা ঠেকাতে মার্কিন ডেমোক্র্যাটদের চাপে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বুধবার একটি চিঠির মাধ্যমে এ বিষয়ে বাইডেনকে নতুন করে চাপ দেন তারা। শহরটিতে গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার প্রায় অর্ধেকই আশ্রয় নিয়েছেন। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এই খবর জানিয়েছে।
মার্কিন হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভের ২১২ ডেমোক্র্যাটের মধ্যে ৫৭ জন ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। চিঠিতে তারা মিসরের সীমান্তবর্তী শহরটিতে পূর্ণ মাত্রার হামলা চালানো থেকে নেতানিয়াহু সরকারকে বিরত রাখতে বাইডেন প্রশাসনকে সম্ভাব্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘রাফাতে পূর্ণ মাত্রার হামলা ঠেকাতে আমরা আপনাকে অবিলম্বে বিদ্যমান আইন ও নীতির আওতায় ইসরাইলি সরকারের জন্য বরাদ্দ কিছু আক্রমণাত্মক সামরিক সহায়তা স্থগিত করার আহ্বান জানাচ্ছি। এর মধ্যে ইতোমধ্যে আইনে স্বাক্ষরিত হওয়া সহায়তা প্যাকেজও রয়েছে।’ প্রতিনিধি প্রমিলা জয়পাল ও ম্যাডেলিন ডিনের নেতৃত্বে পাঠানো এই চিঠি সম্পর্কে মন্তব্যের জন্য হোয়াইট হাউজের সাথে যোগাযোগ করে রয়টার্স। তবে এ বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
বুধবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেছিলেন, রাফাহ শহরের বেসামরিকদের রক্ষা করবে ইসরাইলের প্রতিশ্রুত হামলার পরিকল্পনা এখনো দেখতে পাননি তিনি। তখন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের হামলাকে সমর্থন করতে পারে না। বুধবার জেরুসালেমে ঘণ্টাখানেকের মতো বৈঠক করেছিলেন ব্লিনকেন ও নেতানিয়াহু। এ বৈঠকের পরই রাফাতে হামলা চালানোর প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি করেছিল ইসরাইল। ইসরাইলের প্রধান কূটনৈতিক সমর্থক এবং অস্ত্র সরবরাহকারী যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে ইসরাইলকে সতর্ক করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, বেসামরিক ক্ষতি, মানবিক দুর্ভোগ ও ত্রাণকর্মীদের নিরাপত্তার জন্য পদক্ষেপ নিতে ইসরাইল ব্যর্থ হলে ওয়াশিংটনের নীতি পরিবর্তন হতে পারে। এমন হুঁশিয়ারির প্রায় এক মাস পরই ইসরাইল সফর এসেছিলেন ব্লিনকেন।

ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে বিতর্কিত বিল পাস
আলজাজিরা জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে একটি বিল পাস হয়েছে। নাগরিক স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে সোচ্চার থাকা সংগঠনগুলোর বিরোধিতা সত্ত্বেও বুধবার বিলটি পাস হয়। এটি এখন অনুমোদনের জন্য কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে পাঠানো হবে। প্রতিনিধি পরিষদে বিলটি পাসের পক্ষে ভোট দিয়েছেন ৩২০ জন সদস্য। আর বিলটির বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন ৯১ জন। ধারণা করা হচ্ছে, গাজায় ইসরাইলের হামলার বিরোধিতা করে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে বিক্ষোভ চলছে, তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিলটি পাস করা হয়েছে। সিনেটে পাস হওয়ার পর বিলটি যদি আইনে পরিণত হয়, তবে এর মধ্য দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল হলোকস্ট রিমেমব্র্যান্স অ্যালায়েন্সের (আইএইচআরএ) দেয়া ইহুদিবিদ্বেষের সংজ্ঞাকে বিধিবদ্ধ করা হবে। আইএইচআরএর সংজ্ঞাকে আইনে যুক্ত করা হলে ইহুদিবিদ্বেষের চর্চা হওয়ার অভিযোগ তুলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তহবিল বন্ধ করে দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় শিক্ষা বিভাগ। সমালোচকরা বলছেন, আইএইচআরএর ইহুদিবিদ্বেষের সংজ্ঞাকে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান ইসরাইলবিরোধী বিক্ষোভ দমনে ব্যবহার করা হতে পারে। আইএইচআরএর সংজ্ঞা অনুযায়ী, ইহুদিবিদ্বেষ হলো ‘ইহুদিদের নিয়ে একটি নির্দিষ্ট ধারণা, যা ইহুদিদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশে ব্যবহার করা হতে পারে।’ আইএইচআরএর সংজ্ঞা অনুযায়ী, ইসরাইল রাষ্ট্রকে আক্রমণ করে কিছু বলাকেও ইহুদিবিদ্বেষ হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ ইসরাইলকে ইহুদিদের সম্মিলন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর আগে গত শুক্রবার প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিল আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (এসিএলইউ)। চিঠিতে প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যদের বিলটির পক্ষে ভোট না দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল, বিদ্যমান কেন্দ্রীয় আইন অনুযায়ী, ইহুদিবিদ্বেষী বৈষম্য ও হয়রানি এমনিতেই নিষিদ্ধ।

ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা কলম্বিয়ার
রয়টার্স জানায়, গাজায় হামলার কারণে ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো। স্থানীয় সময় বুধবার তিনি এ ঘোষণা দেন। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উপলক্ষে জড়ো হওয়া মানুষের সামনে পেত্রো বলেন, তার দেশ আগামীকালই (বৃহস্পতিবার) ইসরাইলের সাথে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে যাচ্ছে।
গাজায় হামলার শুরু থেকেই ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কঠোর সমালোচনা করে আসছেন পেত্রো। তিনি অন্যান্য দেশকে আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে যোগ দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে আসছেন। লোকভর্তি জনসমাগমস্থলে পেত্রো তার ঘোষণায় বলেন, ‘আপনাদের সামনে প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিচ্ছেন যে, আগামীকাল আমরা ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কগুলো ছিন্ন করব...।’ পেত্রো তার বক্তব্যে ইসরাইলের রাষ্ট্রপ্রধানকে গণহত্যাকারী বলে আখ্যা দেন। পেত্রো আরো বলেন, গাজার এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের কোনো দেশ নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না।

গত বছরের অক্টোবরে গাজায় হামলার পরপরই ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে দক্ষিণ আমেরিকার আরেক দেশ বলিভিয়া। সে সময় কলম্বিয়া, চিলি ও হন্ডুরাসসহ দক্ষিণ আমেরিকার আরো কয়েকটি দেশ ইসরাইল থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। এ দিকে কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্টের এমন ঘোষণায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ইসরাইল। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরাইল কাটজ অভিযোগ করে বলেছেন, পেত্রোর এ ঘোষণা ‘ইহুদিবিদ্বেষী ও ঘৃণায় পরিপূর্ণ’। তার এ পদক্ষেপ হামাসের জন্য পুরস্কার।
রাফায় হামলার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি হামাসের

টাইমস অব ইসরাইল জানায়, রাফা শহরে হামলার ব্যাপারে ইসরাইলকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। হামাসের সিনিয়র নেতা ওসামা হামদান বুধবার লেবাননের ‘আল-মানার’ চ্যানেলকে বলেছেন, ‘শত্রু যদি রাফায় স্থলাভিযান চালায়, তবে আলোচনা বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ গুলির মধ্যে প্রতিরোধ আন্দোলন আলোচনা চালায় না।’
হামদান আরো বলেন, হামাসের প্রতিরোধ সক্ষমতা এখনো উচ্চপর্যায়ের রয়েছে। প্রতিরোধ আন্দোলন এখনো দারুণ আছে। আর একই সময়ে ইহুদিবাদী এলিট ব্রিগেডগুলো গাজা উপত্যাকায় ধরে পড়ছে। তিনি আরো বলেন, ইসরাইলি শত্রুরা তাদের সক্ষমতা নিয়ে বাজি ধরেছে। তবে প্রতিরোধ আন্দোলন প্রস্তুতি নিচ্ছে। হামদান নিশ্চিত করেন যে হামাদের দুই নেতা মোহাম্মদ দেইফ ও ইয়াহিয়া সিনওয়ারের সাথে স্থায়ী যোগাযোগ আছে। তারা মাঠের পরিস্থিতির ওপর ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখছেন। তিনি বলেন, যুদ্ধের ব্যাপারে নিয়মিত সমন্বিত কার্যক্রম চলে। হামদান বলেন, এই যুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফল হল এই যে প্রতিরোধ বলয়ের শক্তি ও ক্ষমতা বেড়েছে। ইহুদিবাদী সত্তার বিরুদ্ধে ইরানি প্রতিক্রিয়ার ফলে নতুন সমীকরণের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘যারা গাজায় সমুদ্র জেটি নির্মাণ করছে, তারা হল আমেরিকান সরকার’।

তিনি বলেন, গাজার মাটিতে প্রতিটি সশস্ত্র সৈন্য ফিলিস্তিনি জনগণের শত্রু। গাজা উপত্যকায় নতুন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ নির্মাণের প্রকল্পটি প্রতিরোধ আন্দোলন ভণ্ডুল করে দেবে। তিনি একই সাথে চীনা মধ্যস্থতাকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, শত্রু রাফা যুদ্ধে প্রত্যেককে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছে।
নেতানিয়াহুকে জিজ্ঞাসাবাদ ইসরাইলি তদন্ত সংস্থার : হামাসের যোদ্ধারা গত ৭ অক্টোবর কিভাবে ইসরাইলের ভূখণ্ডে হামলা চালাল- সে সম্পর্কিত তদন্তের অংশ হিসেবে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং রাষ্ট্রটির স্থল, বিমান ও নৌবাহিনীর প্রধানদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ইসরাইলের সরকারি তদন্ত সংস্থা। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বুধবার তাদেরকে তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে তলব করা হয়েছিল। সেই তলবে সাড়া দিয়ে কার্যালয়ে উপস্থিতও হয়েছিলেন তারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে এ তথ্য জানানো হয়েছে ইসরাইলের সরকারি তদন্ত সংস্থার প্রধান মাতানিয়াহু অ্যাঙ্গলমানের দফতর থেকে।
হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলা ছিল ইসরাইলের গত ৭৫ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার ঘটনা। ইসরাইলি বাহিনীর অভিযান শুরুর পর নেতানিয়াহু অ্যাঙ্গলমান বলেছিলেন হামাস কিভাবে এত বড় একটি হামলা ঘটাতে সক্ষম হলো- তা তদন্ত করতে চায় তার দফতর। তিনি আরো বলেছিলেন, হামলার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ঘটনা ও বিষয় যাচাই এবং বিশ্লেষণ করা হবে। পরে ডিসেম্বরে এক সংবাদ সম্মেলনে অ্যাঙ্গলমান বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার দফতর এই মর্মে নিশ্চিত হয়েছে যে, ইসরাইলের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ‘বহুমুখী ব্যর্থতা ও গাফিলতি’ এ হামলার ভয়াবহতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে এ ইস্যুতে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করবেন তার দফতরের কর্মকর্তারা। বুধবারের ফেসবুক পোস্টে অ্যাঙ্গলমানের দফতরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুদ্ধের ছয় মাস ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেছে। এ যুদ্ধের জন্য যারা দায়ী, তাদের কাছ থেকে এ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা জানার অধিকার ইসরাইলের জনগণের রয়েছে। রাষ্ট্রীয় তদন্ত সংস্থার প্রধান জনগণকে এ-সংক্রান্ত বিশদ তথ্য দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ দিকে মাতানিয়াহুর দফতর থেকে বুধবারের ফেসবুক পোস্টের প্রতিক্রিয়ায় একটি বিবৃতি দেয়া হয়েছে নেতানিয়াহুর দফতর থেকে। সেই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘তদন্ত কর্মকর্তারা যেসব প্রশ্ন করেছিলেন, সেসবের প্রতিটির অনুপুঙ্খ জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।’


আরো সংবাদ



premium cement