২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

উইঘুর সংস্কৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা

চীনের জিনজিয়াংয়ে একটি মসজিদের সামনে পুলিশের পাহাড়া - ফাইল ছবি

চোখ বন্ধ করে একটু ভাবুন তো! নিরাপত্তা বাহিনী আপনার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিলো, প্রিয়জনকে আটক করে নিয়ে গেল, তাদের বন্দিশিবিরে আটকে রাখল, আর শিশু সন্তানদের আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হলো। তখন আপনার মনের অবস্থা কেমন হবে? ৪৪ বছর বয়সী তুরঘুন জানের বেলায় এমনটাই ঘটেছে। উইঘুর শরণার্থীদের সাক্ষাৎকার নিতে তুরস্কে গেলে সেখানে তার সাথে আমার দেখা হয়।

তুরঘুন জানের অলঙ্কারের ব্যবসা ছিল। ব্যবসার কাজে সে চার বছর ধরেই চীন-তুরস্ক আসা-যাওয়া করছে। ২০১৭ সালে এমনই একটি সফরের সময় তার পরিবারের সদস্যদের কোনো কারণ ছাড়াই ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
‘তারা আমার স্ত্রীকে আটক করে নিয়ে গেছে, এখন আমার হারানোর কিছু নেই। জানি না, যমজ ছেলে দু’টি কোথায় আছে’। তিনি বলছিলেন, ‘আমরা কেবল শান্তি, নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা চাই। আমার মতো বহু মানুষ যারা চীনের বাইরে বসবাস করে এবং যাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ নেই, তাদের এ জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হচ্ছে।’ কথাগুলো বলার সময় তিনি চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। জিনজিয়াং বা পূর্ব তুর্কিস্তানের ওপর চীনের দীর্ঘ দিনের নিপীড়নের ফলে বহু উইঘুর পরিবারের সদস্যের প্রতিদিনের চিত্র এমনই।

গত আগস্টে, নির্মূল ও বৈষম্যের শিকার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করা জাতিসঙ্ঘের বিশেষ কমিটি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়, চীনে প্রায় ১০ লাখ উইঘুর মুসলিমকে বিভিন্ন ‘সন্ত্রাসবাদী শিবিরে’ আটক করে রাখা হয়েছে। ২০ লাখ উইঘুরকে জোর করে ‘শিক্ষাকেন্দ্রে’ আটক রাখা হয়েছে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দীক্ষা দেয়ার জন্য।
চীন সরকার এসব অভিযোগ প্রথমে জোরের সাথে অস্বীকারই শুধু নয়, বরং প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু দুই মাস পরই আইন পরিবর্তন করে এসব ‘বন্দিশিবির’ থাকার কথা ঘোষণা করেছে।
‘পুনঃশিক্ষাকেন্দ্র’কে বৈধ করতে এবং ‘চরমপন্থী মতবাদে বিশ্বাসীদের শিক্ষা দিতে’ চীন জিনজিয়াংয়ের স্থানীয় সংবিধানেও পরিবর্তন এনেছে।

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, এসব শিবির ও কেন্দ্রে বন্দীদের চীনা ম্যান্ডারিন ভাষা শিখতে বাধ্য করা হয়। ক্ষমতাসীন চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি বা সিসিপির প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে হয় এবং তাদের নিয়ম-নীতিগুলোর আলোকে কেমন আচার-ব্যবহার করতে হবে, সেসব বিষয় স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। এ সময় তারা বৈরী পরিবেশে বসবাস করতে বাধ্য হয়। তাদের ওপর চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।

এসবই হলো নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে নেয়া কমিউনিস্ট সরকারের আত্তীকরণ নীতির সাম্প্রতিক পুনরাবৃত্তি। চীনের ‘জাতির পিতা’ মাও জে দংয়ের মত অনুযায়ী, চীনের সবচেয়ে বড় নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী হানরা। আর বিগত সাত দশকে তাদের আধিপত্য ক্রমেই বাড়ছে।

এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে চীনা সরকার সুনিপুণভাবে উইঘুরদের সংস্কৃতি ও জিনজিয়াংয়ের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলো মুছে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছে। বড়দের এসব ‘পুনঃশিক্ষাকেন্দ্র’গুলোর বাইরেও উইঘুর শিশুদের জন্য খোলা হয়েছে বিশেষ ক্যাম্প ও স্কুল। পরিবার, নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করে শিশুদের এসব ক্যাম্পে রাখা হয়। হান জনগোষ্ঠীর পোশাকে এবং ম্যান্ডারিন ভাষা শিক্ষা করছে এবং হান সংস্কৃতি শিখছে- উইঘুর শিশুদের এমন নানা ছবি, খবর ও প্রবন্ধ প্রতিনিয়ত চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে।

‘আত্তীকরণ’ নীতি অনুযায়ী উইঘুরদের বাড়িঘরে যেকোনো সময় ঢুকে তল্লাশির নামে ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে চলেছে চীন সরকার। ২০১৬ সালে ‘এক পরিবার হয়ে যাও’ শিরোনামে বিশেষ কার্যক্রম শুরু করে সরকার। এর আওতায় প্রতি দুই মাসে পাঁচ দিন করে কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্যকে ‘অতিথি’ হিসেবে নিজের বাড়িতে রাখতে উইঘুর পরিবারগুলোকে বাধ্য করা হচ্ছে।

চীন রাষ্ট্রটি খুব সচেতনভাবে উইঘুরদের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে আসছে। রাষ্ট্রীয়ভাবেই ঘোষণা করা হয়েছে, ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করার অর্থ হলো- সে ‘নৈতিকভাবে অসুস্থ’। চীন সরকার বহু মসজিদ ধ্বংস করে দিয়েছে, ধর্মীয় পোশাক এবং মুসলিমদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ‘কুরআন’ পড়া নিষিদ্ধ করেছে। সেই সাথে ইসলামি নিয়ম অনুযায়ী লাশ দাফন করা থেকে বিরত থাকতে এবং চীনাদের মতো করে লাশ দাফন করতে বাধ্য করা হচ্ছে মুসলিমদের।

ধর্মীয় আচার-আচরণকে লক্ষ্য বানিয়ে আইনগত নির্দেশও জারি করে চীন। সমন্বিত সামাজিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষা আদেশের আওতায় ‘জিনজিয়াং উইঘুর স্বশাসিত অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ’ এর জন্য বেশ কিছু নির্দেশ জারি করা হয়। এগুলো মানতে হলে আগের সেই ‘ধর্মীয় বিষয়াবলির ব্যবস্থাপনা’ ও ‘সংস্কৃতিবিরোধী শিক্ষা কার্যক্রম’ এর মতো পদক্ষেপ নেবে স্থানীয় প্রশাসন।

এসব নীতির বাস্তবায়নে মুসলিমদের প্রতিদিনকার কার্যক্রমই পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এসব কার্যক্রমের মধ্যে আছে- তারা হালাল খাবার খায় কি না, হান চীনাদের বিয়ে করতে অস্বীকার করে কি না, এমনকি ইসলামি রীতিনীতিতে একে অপরকে সম্বোধন করে কি না।

চীন সরকার যেসব অভিযোগ এনে উইঘুরদের ওপর নির্বিচারে নির্যাতন চালায় তা হলো- উগ্রপন্থা, সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম। প্রথম অভিযোগ হলো ‘উগ্রপন্থা’। আসলে ‘উগ্রপন্থী’র নামে উইঘুর মুসলিমদেরই বুঝিয়ে থাকে তারা। লাখ লাখ উইঘুরকে ‘পুনঃশিক্ষা’ কেন্দ্রে পাঠানো হলেও বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তিকে তারা আটক করেছে, না হয় গুম করে দিয়েছে। এদের মধ্যে ইসলামি পণ্ডিত মোহাম্মদ সালিহ হাজিম, অর্থনীতিবিদ ইলহাম তাক্মতি, নৃ-বিজ্ঞানী রাহিল দাউদ, পপসঙ্গীত শিল্পী আব্দুর রহিম হাইয়েত ও আবলাজান আউত এবং ফুটবল খেলোয়াড় এরফান হেজিমের নাম উল্লেখযোগ্য।

সত্যিকার অর্থে ‘উইঘুর’ হওয়ার মধ্যে চরমপন্থার কিছু নেই বরং এটা গর্বের ব্যাপার। হানরা যেমন নিজস্ব ঐতিহ্য ধারণ করতে পারে এবং নিজস্ব উৎসব উদযাপন করতে পারে, উইঘুরদেরও তেমনি করতে পারা উচিত। নিজেদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অধিকার চাওয়ার মধ্যে ‘উগ্রপন্থার’ কিছু নেই।

উইঘুরদের বিরুদ্ধে আনীত পরের অভিযোগটি হচ্ছে ‘সন্ত্রাসবাদী’ কার্যক্রম। জিনজিয়াংয়ে অবশ্যই কিছু সঙ্ঘাত-সহিংসতা হয়ে থাকে, কিন্তু প্রকাশ্যে নিজের অধিকার চাওয়ার নামই কি সন্ত্রাসবাদ? এটা বুঝতে পারা খুব কঠিন নয় যে, মানুষ যখনই নিষ্পেষণের শিকার হয়, যখন তাদের সম্মান ও মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়, যখন তারা নিজেদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি পালন করতে না পারে, যখন কেবল আত্মপরিচয়ের কারণে পরিবারের সদস্যদের আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়, তখনই মানুষ হতাশা, রাগ ও অবিশ্বাসে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা এই অঞ্চলে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে, আর দেশের বাইরের কিছু সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে হয়তো সামান্য কিছু উইঘুরের যোগাযোগও আছে। কিন্তু এর বাইরেও কিছু বিষয় কিছুতেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না। আর তা হলো, রাষ্ট্রীয় চরম বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার বেশির ভাগ উইঘুর সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ উপায়ে এসবের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী যেকোনো দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় ও নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর ভেতরেই কেবল সন্ত্রাসের উৎস খোঁজা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য ও হাস্যকর।

উইঘুরদের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ আনা হয় ‘বিচ্ছিন্নতা’বাদের। কিন্তু তারা মোটেও চীন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় না। তারা তাদের মাতৃভূমিকে দেখে কেবল ঔপনিবেশিক অঞ্চল হিসেবে। কেননা জিনজিয়াং অঞ্চলটি ঐতিহাসিকভাবে কখনোই চীনের ছিল না। তারা একই সাথে চীনা উপনিবেশবাদ ও হানকেন্দ্রিক নীতিতে পরিচালিত চীনা রাষ্ট্র কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া শান্তি-স্বাধীনতা-গণতন্ত্র কায়েমের ওপর নানা নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
প্রত্যেক উইঘুর নাগরিক মন থেকে পূর্ব তুর্কিস্তানে শান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র চায়। কিন্তু আমি ভীত ও সন্ত্রস্ত এ কারণে যে, চীন সরকার এখন যেভাবে পূর্ব তুর্কিস্তানে সাংস্কৃতিক গণহত্যা ও নিষ্পেষণ চালিয়ে যাচ্ছে, এতে আগামীতে এসবের কিছুই অর্জন করা যাবে না।

লেখক : উইঘুর অধিকার কর্মী। উইঘুর কানাডিয়ান সোসাইটির সাবেক প্রেসিডেন্ট।

আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর করেছেন মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম


আরো সংবাদ



premium cement
যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ভিসা সহজ করার আহ্বান প্রবাসী প্রতিমন্ত্রীর চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে অংশীদার হওয়া উচিত : শি জিনপিং ওকাব সভাপতি নজরুল ইসলাম, সম্পাদক জুলহাস আলম পাবনায় ১০ কোটি টাকার অনিয়মে ৩ ব্যাংক কর্মকর্তা কারাগারে চুয়েট ১১ মে পর্যন্ত বন্ধ, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত নরসিংদীতে হিট স্ট্রোকে শিশুর মৃত্যু হিলিতে ভটভটি-মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে নিহত ২ ‘গাজার ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করতে ১৪ বছর লাগতে পারে’ সখীপুরে ছাগল চুরির মামলায় মা-ছেলে কারাগারে ‘অন্যায়ের সাথে নয়া দিগন্তের সাংবাদিকরা কখনোই আপোষ করেন না’ রাজশাহীতে হলে ঢুকতে না দেয়ায় রাস্তায় বিসিএস পরীক্ষার্থীর কান্না

সকল