২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মসজিদ : ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ

৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ ভেঙে ফেলা হয় বাবরি মসজিদ - ছবি : সংগ্রহ

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যা মামলার ওপর শুনানিকালে তার ওই রায়কে প্রশস্ত বেঞ্চের কাছে অর্পণ করতে অস্বীকার করেছেন। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘মসজিদে নামাজ পড়া ইসলামের অপরিহার্য অঙ্গ নয়।’ অথচ বাবরি মসজিদের মৌলিক মামলার সাথে এ সিদ্ধান্তের কোনো সম্পর্ক নেই। তথাপি উগ্রবাদী গোষ্ঠী একে বাবরি মসজিদের অধিকার ছিনিয়ে নেয়ার একটা সুযোগ মনে করছে। তারা বগল বাজিয়ে এ কথা বলে বেড়াচ্ছে, আদালত বাবরি মসজিদের স্থানে রাম মন্দির নির্মাণের পথ সুগম করে দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে আরএসএস এবং বিশ্ব হিন্দুপরিষদের মতো ফ্যাসিবাদী সংগঠনগুলো স্বাগত জানিয়েছে। এ উচ্ছল নৃত্য আদালতের ওই ব্যাখ্যা সত্ত্বেও অব্যাহত রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, বাবরি মসজিদের স্বত্বাধিকারের মামলার ওপর এ রুলিংয়ের কোনো প্রভাব পড়বে না। আগামী ২৯ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টে এর শুনানি শুরু হবে।

ওই সময় বাবরি মসজিদের ভূমিকে এলাহাবাদ হাইকোর্টের তিন ভাগে বণ্টন করার বিস্ময়কর রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিলের ওপরও শুনানি হবে। ভারতের এক আশ্চর্যজনক বেদনার বিষয় হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো নিজেদের মনমতো ব্যাখ্যা দ্বারা আদালত ও আইনি ব্যবস্থাকে চাপের মধ্যে ফেলার চেষ্টা করে। অথচ ভারতের সর্বোচ্চ আদালত স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তারা অযোধ্যা মামলার ফয়সালা কারো আস্থা বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে নয়, বরং স্বত্বাধিকারের প্রমাণাদির ভিত্তিতে করবেন। তা সত্ত্বেও বলা হচ্ছে, ‘অযোধ্যার মামলায় আমাদের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রশ্ন জড়িত। আর এ ধরনের প্রশ্নের মীমাংসায় উপনীত হওয়া আদালতের কার্যপরিধির বাইরে।’ কিন্তু এর পাশাপাশি আদালত যখন কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় কার্যক্রমের অধিকারকে সীমিত করে তাদের বিশ্বাসের ওপর প্রশ্নবোধক চিহ্ন দাঁড় করিয়ে দেয়, তখন ওই শক্তিগুলো তাকে সাধুবাদ জানাতে থাকে। বাবরি মসজিদ মূলত ভারতে সংবিধান ও আইনের জন্য কষ্টিপাথরস্বরূপ।

এ মামলার সাথে প্রথম দিন থেকে যে খেলা হয়েছে, তা কারো কাছে গোপন নেই। বাবরি মসজিদের সাংবিধানিক ও আইনি অধিকারকে যেভাবে হরণ করা হচ্ছে, স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এর কোনো দ্বিতীয় উদাহরণ পাওয়া যাবে না। ১৯৪৯ সালে বাবরি মসজিদের ভেতর জোরপূর্বক মূর্তি স্থাপনার মামলা হোক, কিংবা ১৯৮৬ সালে বাবরি মসজিদের দরজা গণপূজাপাটের অনুমতির জন্য খুলে দেয়ার মামলা হোক।

১৯৮৯ সালে বাবরি মসজিদের সামনে রাম মন্দিরের শিলান্যাস রাখার ঘটনা হোক, কিংবা এরপর ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদকে অন্যায়রূপে শহীদ করা পর্যন্ত সব ঘটনা এ কথার সাক্ষ্য দেয়, পাঁচ শত বছরের ঐতিহাসিক এই ধর্মীয় স্থাপনার সাথে আইন ও আদালত কানামাছি খেলেছে এবং রাজনীতিবিদরা তার আগুনে নিজেদের রুটি সেঁকেছেন। প্রকাশ থাকে যে, বাবরি মসজিদের শাহাদতের পর ৭ জানুয়ারি, ১৯৯৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এক অর্ডিন্যান্স জারি করে অযোধ্যায় ৬৭ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল। এতে বিতর্কিত জমির ওই অংশও যুক্ত ছিল, যেখানে ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ পর্যন্ত বাবরি মসজিদ দাঁড়িয়েছিল।

১৯৯৩ সালেই বাবরি মসজিদের জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে ইসমাঈল ফারুকী এ বলে এক আরজি পেশ করেছিলেনÑ সরকার কোনো ধর্মীয় স্থান নিজের অধীনে কিভাবে নিতে পারে?

২৪ অক্টোবর, ১৯৯৪ সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ তার আরজির ওপর রায় প্রদান করতে গিয়ে এ বিস্ময়কর বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেন, মসজিদে নামাজ পড়া ইসলামের অপরিহার্য অঙ্গ নয়। পরবর্তী সময়ে ওই রায়ের রিভিউয়ের জন্য এক আরজি দায়ের করা হয় এবং অযোধ্যা মামলার অন্যতম স্বপক্ষীয় উকিল মাহবুব সিদ্দিকী ইসমাঈল ফারুকীর বিষয়ে ১৯৯৪ সালের রায়ের বিশেষ অংশের ওপর আপত্তি লিপিবদ্ধ করান। ৫ ডিসেম্বর, ২০১৭ অযোধ্যা মামলার শুনানির সময় মুসলমান পক্ষের উকিল রাজীব ধাওয়ান বলেছেন, ‘নামাজ পড়ার অধিকার পুনর্বহাল করা উচিত। কেননা নামাজ আদায় করা ধর্মীয় অনুশীলন। আর এ থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যেতে পারে না।’

২০ জুলাই, ২০১৮ চিফ জাস্টিস দীপক মিশ্রের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এ মামলার দুই পক্ষের বক্তব্য শোনার পর তার রায় সংরক্ষণ করেছিলেন, যা ২৭ সেপ্টেম্বর শোনানো হয়। আদালত এ মামলাকে সাত সদস্যের বেঞ্চের কাছে অর্পণের আপিল প্রত্যাখ্যান করেন। চিন্তার বিষয় হচ্ছে, মসজিদের ধর্মীয় মর্যাদাসংক্রান্ত এ রায় তিন বিচারকের বেঞ্চের সামনে ছিল, যেখানে জাস্টিস আবদুন নাজির এর বিরুদ্ধে রায় দেন। পক্ষান্তরে দু’জন বিচারক এ মামলায় বলেছেন, অযোধ্যা মামলা ভূমির মামলা। আর এতে ১৯৯৪ সালের নামাজ প্রসঙ্গে নির্দেশে কৃত বিশ্লেষণের সাথে এর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। চিফ জাস্টিস দীপক মিশ্র ও জাস্টিস অশোক ভূষণ আধিক্য রায়ে বলেন, এ দেওয়ানি মামলার ফয়সালা ধর্মীয় গুরুত্বের প্রেক্ষাপটে হবে না।

তারা মুসলমান পক্ষের এ প্রমাণ গ্রহণ করেননি যে, ১৯৯৪ সালের এ বিশ্লেষণ মসজিদে নামাজ পড়ার অধিকার খতম করার মতো মনে হচ্ছে। ওই দুইজন বিচারকের বিরোধিতা করে বেঞ্চের তৃতীয় সদস্য জাস্টিস আবদুন নাজির স্পষ্টভাবে বলেছেন, ধর্মীয় বিশ্বাসকে মাথায় রেখে ‘আমাদের এ ফয়সালা করতে হবে, মসজিদ ইসলামের অঙ্গ কি না।’

তিনি বলেন, ‘এর ওপর বিস্তারিতভাবে চিন্তা করার প্রয়োজন রয়েছে এবং এ মামলাকে বড় বেঞ্চের কাছে প্রেরণ করা উচিত।’ জাস্টিস আবদুন নাজির এ মামলায় দাউদি বোহরা সম্প্রদায়ের মেয়েদের খতনার বিষয়টিরও উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন, যা ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রশস্ত বেঞ্চের কাছে অর্পণ করা হয়েছে।

মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট মুসলমান পক্ষের দাবি সত্ত্বেও ১৯৯৪ সালে প্রদত্ত তাদেরই বিশ্লেষণকে প্রশস্ত বেঞ্চের কাছে অর্পণ করতে কেন রাজি হয়নি? অথচ মসজিদে নামাজ আদায়ের বিষয় মুসলমানদের মৌলিক বিশ্বাস, ইবাদত ও সাধনার সাথে সংশ্লিষ্ট। সবাই জানে, ইসলামে মসজিদের মর্যাদা এমন এক কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত, যেখানে মুসলমানরা দিনে পাঁচবার হাজির হয়ে প্রভুর দরবারে সেজদাবনত হয়।

যে ধর্মে মসজিদকে ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তার ব্যাপারে এ কথা বলা- ‘মসজিদে নামাজ আদায় ইসলামের অঙ্গ নয়’ এক বিস্ময়কর ও দুর্বোধ্য যুক্তি। বিষয়টি এমন একসময়ে জনসমক্ষে এলো, যখন পাবলিক প্লেসে মুসলমানদের নামাজ আদায়ে বাধা প্রদান করা হচ্ছে এবং নতুন গড়ে ওঠা নগরে মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। আপনাদের স্মরণ থাকার কথা, কয়েক মাস ধরে বিজেপির শাসনাধীন রাজ্য হরিয়ানায় পাবলিক প্লেসে মুসলমানদের নামাজ আদায়ে বাধা প্রদান করা হচ্ছে। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খাট্টারের কাছে যখন বিষয়টি উত্থাপন করা হলো- তখন তিনি বললেন, ‘পাবলিক প্লেস নামাজের জন্য নয়।

সুতরাং ‘মুসলমান মসজিদে নামাজ আদায় করবে।’ কিন্তু ওই হরিয়ানার গুরগাঁও শহরে শীতলা কলোনির মদিনা মসজিদে শুধু এ জন্য প্রশাসন তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে, স্থানীয় হিন্দুরা সেখানে আজানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারায় অন্যান্য সংখ্যালঘুর সাথে মুসলমানদেরও নিজেদের ইবাদতের স্থান নির্মাণ করা, তাতে নামাজ পড়ার স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে। তা মুসলমানরা বেশ সুচারুরূপে পালন করে আসছে। মসজিদ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উভয় দিক দিয়ে ইসলামের অপরিহার্য অঙ্গ। কুরআন ও হাদিসের একাধিক স্থানে মসজিদের গুরুত্বকে দীপ্তিমান করা হয়েছে। মুসলমানদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য মসজিদে একত্র হওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এটা সারা বিশ্বে ইসলামের সূচনা থেকে অব্যাহতভাবে চলে আসছে।

মোট কথা, মসজিদের সাথে মুসলমানদের ধর্মীয় উদ্দীপনার সম্পর্ক এমন ধরনের, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু বর্তমান উৎপীড়ক শাসনব্যবস্থায় মুসলমানদের জীবনের ছন্দ এতটাই সঙ্কীর্ণ করে দেয়া হচ্ছে যে, তাদেরকে নিজেদের ধর্মীয় ও সাংবিধানিক অধিকার আদায় থেকেও দূরে রাখা হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চে জাস্টিস আবদুন নাজিরের এ বিরোধিতামূলক বাক্য মনে রাখার মতো, ‘ধর্মের দোহাই দেয়া কতটুকু প্রয়োজন, ইসমাঈল ফারুকীর মামলায় এর ভিত্তিতে কোনো ব্যাপক অধ্যয়ন ছাড়াই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এ মামলায় যে বিশ্লেষণ সন্দেহের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল, তাকে ভিত্তি করে এলাহাবাদ হাইকোর্ট অযোধ্যা মামলায় তাদের ফয়সালা প্রদান করেছিলেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘এর অর্থ ইসমাঈল ফারুকী মামলাকে ১৯৫৪ সালের শিরুর মঠ মামলার প্রেক্ষাপটে দেখা জরুরি।’ ওই মামলায় পাঁচজন বিচারকের বেঞ্চ বলেছিলেন, কোনো ধর্মের সঠিক অনুশীলন কী, এটি বাইরের কোনো সংস্থা নির্ধারণ করবে না, বরং ওই ধর্মের লোকরাই তা নির্ধারণ করবে।

লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক, মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক উর্দু টাইমস থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
রাজশাহীতে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়াল যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ভিসা সহজ করার আহ্বান প্রবাসী প্রতিমন্ত্রীর চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে অংশীদার হওয়া উচিত : শি জিনপিং ওকাব সভাপতি নজরুল ইসলাম, সম্পাদক জুলহাস আলম পাবনায় ১০ কোটি টাকার অনিয়মে ৩ ব্যাংক কর্মকর্তা কারাগারে চুয়েট ১১ মে পর্যন্ত বন্ধ, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত নরসিংদীতে হিট স্ট্রোকে শিশুর মৃত্যু হিলিতে ভটভটি-মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে নিহত ২ ‘গাজার ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করতে ১৪ বছর লাগতে পারে’ সখীপুরে ছাগল চুরির মামলায় মা-ছেলে কারাগারে ‘অন্যায়ের সাথে নয়া দিগন্তের সাংবাদিকরা কখনোই আপোষ করেন না’

সকল