২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মোদির ভারতে জুমার নামাজে বাধা

মুসলমান
ভারতে মুসলমানদের একটি প্রতিবাদ - সংগৃহীত

ভারতজুড়ে মুসলমানদের ভয়ভীতি দেখানোর জন্য উগ্রপন্থী শক্তিগুলোর পক্ষ থেকে ক্রমাগত এমন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে তারা বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমে আসে; অতঃপর তারা পুলিশের লাঠি আর গুলির নিশানায় পরিণত হয়। কখনো আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে জিন্নাহর ছবি নিয়ে বিতর্কের ইস্যু তৈরি করা হয়, কখনো দিল্লির জামেয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়াতে উত্তেজনাপূর্ণ সেøাগান গর্জে ওঠে। কখনো সে কর্মকাণ্ড চলে দিল্লির এক ঐতিহাসিক কবরকে মন্দিরে রূপান্তর করার ঘটনারূপে অথবা কখনো গুরগাঁওয়ে মুসলমানদের জুমার নামাজে বাধা প্রদানের মাধ্যমে। এসব কর্মকাণ্ড একের পর এক ঘটানো হচ্ছে এবং একটাই উদ্দেশ্য, মুসলমানদের এটা বুঝিয়ে দেয়া যে, তারা ভারতে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। তাদের সাংবিধানিক ও আইনি অধিকারের কোনোই মূল্য নেই।

বিগত দু’সপ্তাহ ধরে দিল্লির সন্নিকটে হরিয়ানার গুরগাঁও শহরে মুসলমানদের জুমার নামাজ পড়তে জোরপূর্বক বাধা দেয়া হচ্ছে। তাদের এ কথা বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে, এখন ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের উন্মাদদের মর্জি ছাড়া তারা নামাজও পড়তে পারবে না। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, গুরগাঁওয়ের প্রায় এক লাখ মুসলিম অধিবাসীকে ‘রোহিঙ্গা’ ও ‘বাংলাদেশী’ অভিহিত করে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রও বেশ চাঙ্গা হচ্ছে। প্রাদেশিক সরকারের ছত্রছায়ায় সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যদের দুঃসাহস এতটাই বেড়েছে যে, তারা আইন-কানুনকে মোটেও পরোয়া করে না। গুরগাঁওয়ের ১৫ লাখ অধিবাসীর প্রায় ৫ শতাংশ মুসলমান।

ওই শহরের পরিধি বেড়েই চলেছে। আর জীবিকার সন্ধানে ওখানে মানুষের আগমন অব্যাহত রয়েছে। বিগত দু’সপ্তাহে হিন্দু উগ্রপন্থী সংগঠনগুলো উজিরাবাদ, একে চক, বাখতাওয়ার চক ও শহরের দক্ষিণা এলাকাগুলোতে জুমার নামাজ আদায়ে বাধা দিচ্ছে এবং মুসল্লিদের নামাজ আদায় ব্যতীতই ফিরিয়ে দিয়েছে। এত বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য পুরো গুরগাঁও শহরে মাত্র আটটি মসজিদ রয়েছে, যা শহরের পুরাতন এলাকায় অবস্থিত। এর মধ্যে শুধু একটি মসজিদ নতুন গুরগাঁওয়ে অবস্থিত, যা যথেষ্ট নয়। এ জন্য বহু বছর ধরে ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে খোলা স্থানে জুমার নামাজ আদায় করে আসছেন।

উল্লেখ্য, হরিয়ানায় নতুন কোনো মসজিদ নির্মাণের অনুমতি নেই। আর পুরাতন মসজিদগুলো রয়েছে ‘শত্র“’দের দখলে। হরিয়ানা ওয়াকফ বোর্ড গুরগাঁওয়ে এমন ২০টি মসজিদ চিহ্নিত করেছে, যা হয়তো অবৈধভাবে দখল করে নেয়া হয়েছে, অথবা তা পোড়ো বাড়িতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। আমরা আপনাদের অবগতির জন্য বলছি, গুরগাঁওয়ে গত মসজিদ নির্মাণ করার একটি আবেদন ২০ বছর ধরে কর্তৃপক্ষের নিকট আটকে আছে। গুরগাঁও ছাড়াও হরিয়ানার অনেক শহর যেমন- সোনিপথ, পানিপথ, রোহতাক, হিসার, ঝাজ্জার, হাঁসি, কারনাল ও আম্বালায় হাজার হাজার এমন মসজিদ রয়েছে, যেগুলো শত্র“রা দখল করে রেখেছে। শুধু পানিপথে এমন প্রায় ১০০টি মসজিদ চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলো অমুসলিমদের দখলে রয়েছে। অথচ মুসলমানেরা নামাজ আদায়ের জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে দ্বারে দ্বারে।

হরিয়ানা অতীতে অবিভক্ত পাঞ্জাবের অংশ ছিল, যেখানে স্বাধীনতার আগে ছিল প্রচুর মুসলমান অধিবাসী। দেশ ভাগের সময় বেশির ভাগ মুসলমান পাকিস্তান চলে গিয়েছিল এবং হাজার হাজার মসজিদ, মাদরাসা ও খানকা সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় ফেলে রেখে যায়। পরবর্তীকালে অমুসলিমরা তন্মধ্যে বেশির ভাগ মসজিদ দখল করে সেগুলোর আকার-আকৃতি বদলে দেয়। এমনকি, কিছু মসজিদকে মন্দির ও গুরুদুয়ারায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। কিছু মসজিদ এখনো আসল অবস্থায় টিকে রয়েছে। কিন্তু স্থানীয় লোকেরা এগুলো মেরামত করতে দেয় না। ওখানে নামাজ আদায় করতে দিতেও তারা আগ্রহী নয়। রাজ্য ওয়াকফ বোর্ড ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রেখে এ মসজিদগুলোকে মেরামত করার জন্য সরকারের কাছে অনুমতি চেয়ে আবেদন করলে, অনুমতি দেয়া হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে নিরুপায় ও অপারগ মুসলমানেরা যখন পার্কসহ খোলা স্থানে নামাজ আদায়ের চেষ্টা করে, তখন তাদের ভয়ভীতি দেখানো এবং হয়রানি করা হয়। এটা এমন এক পরিস্থিতি, যা সেক্যুলার গণতন্ত্রী ভারতের জন্য একটা পরীক্ষার চেয়ে কম নয়। এর মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়, সংখ্যাশক্তির বলে ওখানে মুসলমানদের মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।

হরিয়ানার গুরগাঁও, যা গুরুগ্রাম নামেও পরিচিত, অন্যতম অত্যাধুনিক শহর। ওখানে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর হাজার হাজার অফিস রয়েছে। আধুনিক ও বহুতলবিশিষ্ট ভবন নির্মাণের কাজও অব্যাহতভাবে চলছে। কোম্পানিগুলোতে কর্মরত এবং নির্মাণশ্রমিক মুসলমানেরা কয়েক বছর ধরে কিছু খালি পড়ে থাকা প্লটে জুমার নামাজ আদায় করে আসছেন। গত মাসে সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন এক ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে, যেখানে উগ্রপন্থী গোষ্ঠী কর্তৃক খুতবার সময় মুসল্লিদের ওখান থেকে তাড়িয়ে দিতে দেখা যাচ্ছে। ভিডিওতে অসংখ্য মুসলমানকে জুমার নামাজ আদায় না করেই ফিরে যেতে দেখা গেছে। ওই ভিডিও এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, গুরগাঁও প্রশাসন নড়েচড়ে উঠতে হয় এবং তারা হিন্দু উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর ছয়জন যুবককে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু এ ঘটনার সাথে সাথে আরএসএসের সাথে যুক্ত সংগঠনগুলো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পুরো গুরগাঁওয়ে সব খালি প্লটে জুমার নামাজ আদায়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

এ বিষয়ে প্রাদেশিক সরকারের সমঝোতার চেষ্টা চালানো উচিত ছিল, কিন্তু আরএসএসের মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খাট্টার এমন এক বক্তব্য প্রদান করেছেন, যা আগুনে ঘি ঢালার মতো। তিনি প্রশাসনিক নীতি পদদলিত করে বলেছেন, ‘আমজনতার স্থানের পরিবর্তে শুধু মসজিদ, ঈদগাহ ও নিজস্ব স্থানে নামাজ আদায় করা উচিত।’ তিনি এ কথাও বলেছেন, ‘শৃঙ্খলা বজায় রাখা আমাদের কর্তব্য। আজ নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করলে, কাল এ জমির মালিকানা দাবি করে বলবে, আমরা তো বছরের পর বছর এখানে নামাজ পড়ে আসছি।’ প্রকাশ থাকে যে, মুখ্যমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে রাষ্ট্রধর্মের নীতির ঝাণ্ডা ওড়ানো হয়েছে এবং এর দ্বারা ওই লোকদের সাহস বিশেষভাবে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, যারা খালি পড়ে থাকা প্লটে নামাজ আদায়ে মুসলমানদের জোরপূর্বক বাধা দিয়েছে।

এখানে একটি মৌলিক প্রশ্ন, মুখ্যমন্ত্রী কি এ নিয়ম সব ধর্মের মানুষের ওপর প্রয়োগ করবেন? ভবিষ্যতে তার রাজ্যে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা সমাবেশ আমজনতার স্থানে করার অনুমতি কি দেবেন না? এর জবাব ‘না’সূচক হবে। কেননা জুমার নামাজ তো সপ্তাহে মাত্র একবার হয়। কিন্তু আরএসএসের কার্যক্রম প্রতিদিন ভোরবেলায় সাধারণ মানুষের জায়গায় ও পার্কে বিনা বাধায় হচ্ছে। এতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। হরিয়ানা সরকার সরকারি সহযোগিতায় নির্মিতব্য সব ব্যায়ামাগারে আরএসএসের কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে। চতুর্দিকে মুখ্যমন্ত্রীর উল্লিখিত বক্তব্যের নিন্দা জানানো হচ্ছে। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লোকদল ও কংগ্রেস জুমার নামাজ আদায়ে বাধা দেয়াকে ‘সাম্প্রদায়িকতার কার্ড খেলার প্রচেষ্টা’ বলে অভিহিত করেছে।

প্রাক্তন প্রাদেশিক মন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা ক্যাপ্টেন এজে যাদবের বক্তব্য, ‘গুরগাঁওয়ে মুসলমানরা বহু বছর ধরে খোলা ময়দানে জুমার নামাজ আদায় করছে এবং এ ব্যাপারে কখনো কেউ আপত্তি তোলেনি। যখন ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসছে, তখন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এ কারণে এক হওয়ার চেষ্টা করছে। এটা শুধু একটা রাজনৈতিক খেলা।’

তিনি বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রীর এমন পক্ষপাতিত্বমূলক বক্তব্য না দিয়ে, বরং নামাজ আদায়ের জন্য একখণ্ড ভূমি বরাদ্দ করা উচিত ছিল।’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘আমরা কি পার্কে যোগব্যায়াম ও রাস্তায় জাগরণ করি না?’ এ কথা সবাই জানে, সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারায় ভারতের সব অধিবাসীর ধর্মপালনের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে এবং এটাকে কোনো প্রকারে বাধা দেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ বলা হয়েছে। কিন্তু গুরগাঁওয়ে বিজেপি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলমানদের শুধু জুমার নামাজ আদায়ে বাধা দেয়া হচ্ছে না, বরং এ কাজকে ‘ভূমি জিহাদ’ আখ্যা দিয়ে মুসলমানদের রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী অভিহিত করে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেয়ারও হুমকি দেয়া হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য হরিয়ানা ওয়াকফ বোর্ড সরকারের কাছে এমন ১৯টি মসজিদের তালিকা পেশ করে আবেদন করেছে, এ মসজিদগুলোকে অবৈধ দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করে মুসলমানদের কাছে অর্পণ করা হোক। তাহলে মুসলমানরা এ মসজিদগুলোতেই নামাজ আদায় করতে পারবে।

উল্লেখ্য, হরিয়ানা শহর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ওয়াকফ বোর্ডের দুই একর জমি দখল করে রেখেছে। এ ব্যাপারে হাইকোর্ট আগেই ওয়াকফ বোর্ডকে জমির বিনিময়ে জমি প্রদানের নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন কর্তৃপক্ষকে। একদিকে গুরগাঁও কর্তৃপক্ষ ওয়াকফের এত বিশাল জমি দখল করে বসে আছে, অপর দিকে উগ্রপন্থীদের চাপে মুসলমানদের জুমার নামাজের জন্য অস্থায়ীভাবেও প্লট বরাদ্দ দিতেও প্রস্তুত নয়। বহু আন্দোলনের পর হিন্দু উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর পরামর্শে প্রশাসন শুধু ২৩টি স্থান নির্দিষ্ট করেছে, যেখানে জুমার নামাজ আদায় করা যেতে পারে। অথচ এর আগে থেকেই ১১৫টি স্থানে জুমার নামাজ আদায় করা হচ্ছে।
মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক উর্দুটাইমস
১৩ মে, ২০১৮ থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক: ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement