নির্দেশদাতা ও জড়িতদের বিচার দাবি স্বজনদের
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০
ফুলেল শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হয়েছে পিলখানা হত্যাকাণ্ডে শহীদ সেনা সদস্যদের। দিনটি উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে শহীদদের স্মৃতিরপ্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ, দোয়া মুনাজাত ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় বক্তারা এ ঘটনার পরিকল্পনাকারী, নির্দেশদাতা এবং প্রত্যক্ষভাব জড়িত সবার দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেছেন। সেই সাথে ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করারও দাবি জানানো হয়।
স্বজনদের মনে আজো শঙ্কা : পিলখানা বিডিআর বিদ্রোহে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রকৃত আসামিরা আদৌ শাস্তি পাবে কি না, এমন শঙ্কা কাজ করছে হত্যাকাণ্ডের শিকার সেনাসদস্যদের স্বজনদের মনে।
পিলখানায় নিহত কর্নেল কুদরত ইলাহি শফিকের ছেলে অ্যাডভোকেট সাকিব রহমান বনানী সামরিক কবরস্থানে বাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, পর্দার আড়ালে থেকে যারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, বিচারে তাদের শাস্তি হয়েছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
২০০৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ কুদরত ইলাহি শফিকের সাথে দেখা হয়েছিল সাকিবের। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাভার ক্যাম্পাসে থেকে লেখাপড়া করতেন সাকিব। ২১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় স্মৃতিসৌধে বাবার সাথে দেখা হওয়ার পর ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে সিএমএইচে আবার দেখা হয়। তখন আর জীবিত নেই বাবা। মুখের ডান পাশে গুলি লেগেছিল তার। বাবার মৃত্যুর পরের বছরগুলো দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে কাটছে বলে জানান সাকিব। তিনি বলেন, জীবন থেমে থাকে না, চলে যাচ্ছে। কিন্তু বাবা ছাড়া জীবন যে কতখানি দুঃসহ, তা শুধু আমরাই টের পাচ্ছি। প্রতিনিয়ত বাবাকে মিস করি।
সাদাকাতের কাছে বাবা শুধুই ছবি : মেজর মোহাম্মদ মমিনুল ইসলামের মৃত্যুর ১২ দিন পর জন্ম হয় ছেলে সাদাকাত বিন মমিনের। বাবার সাথে তার পরিচয় ছবির মাধ্যমে। সাদাকাতের জন্মের আগেই পিলখানা ট্র্যাজেডির দিন ঘাতকদের হাতে প্রাণ হারান মেজর মমিনুল। বাবা এখন তার কাছে শুধুই ছবি।
মেজর মমিনুলের বোন জেবুন্নাহার সরকার বনানী কবরস্থানে ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসে বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচারে প্রকৃত আসামিরা শাস্তি পাচ্ছে কি না এ নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। তার মতে, ষড়যন্ত্রকারীরা সামনে আসেনি।
গতকাল সকাল ৯টায় বনানী কবরস্থানে নিহত সেনাসদস্যদের স্বজনরা জমায়েত হন। এ সময় তাদের অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। স্বজনরা নিহতদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন এবং তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মুনাজাত করেন।
নির্দেশদাতাদের বিচার দাবি : পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রত্যক্ষ অপরাধীদের বিচার হলেও পেছনে যারা কলকাঠি নেড়েছেন বা নির্দেশনা দিয়েছেন তাদের পরিচয় উন্মোচনের দাবি এবং তদন্ত কমিটি গঠন করে এ ঘটনার পেছনের অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন সুশীল সমাজের নেতারা। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় এ দাবি করা হয়। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগের বিচারপতি (অব:) এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্য মুহম্মদ শফিকুর রহমান, সাবেক পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল হক, মেজর জেনারেল (অব:) আবদুর রশীদ প্রমুখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষ হত্যাকারীদের বিচার হলেও পেছনে যারা কলকাঠি নেড়েছে তারা এখনো আড়ালে রয়ে গেছে। এ ঘটনার মূলহোতাদের পরিচয় দেশের মানুষ জানতে চায়, তদন্ত করে এসব ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
এ কে এম শহীদুল হক বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশকে বড় দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। মেজর জেনারেল (অব:) আবদুর রশীদ বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ড বিজিবির ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ১১তম বার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীর বনানী সামরিক কবরস্থানে সকাল ৯টায় শহীদদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে তাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতির পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম শামীম উজ জামান এবং প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তার সামরিক সচিব। পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে স্যালুট জানানো হয়। পরে শহীদদের রূহের মাগফিরাত কামনায় এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এ সময় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা স্যালুট জানান।
এ সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, ভারপ্রাপ্ত নৌবাহিনী প্রধান রিয়াল অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ শাহীন ইকবাল, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাফিনুল ইসলাম পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। পরে শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে স্যালুট জানানো হয়।
এ সময় শহীদদের রূহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া করা হয়। এ ছাড়াও এদিন সকল সেনানিবাসের কেন্দ্রীয় মসজিদে কুরআন খতমের ব্যবস্থা করা হয় এবং শহীদদের রূহের মাগফিরাত কামনা করে সর্বস্তরের সেনাসদস্যের উপস্থিতিতে মিলাদ মাহফিল ও বিশেষ মুনাজাতের আয়োজন করা হয়।
রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন পর্ব শেষে শহীদ সেনা অফিসারদের স্বজনরা বনানীর কবরস্থানে আসেন। স্ত্রী-সন্তান, ভাইবোন ও স্বজনরা তাদের প্রিয়জনের কবর জিয়ারত করেন। এ ছাড়া শহীদ সেনা সদস্যদের পরিবারের পক্ষ থেকে কুরআন খতম ও দোয়ার আয়োজন করা হয়।
জাতীয় পার্টির শ্রদ্ধা : নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন, বিডিআর বিদ্রোহে শহীদ সেনাকর্মকর্তাদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছেন জাতীয় পার্টি (জাপা) চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদের এমপি। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতাদের সাথে নিয়ে শহীদ সেনা অফিসারদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান তিনি।
এ সময় জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান শহীদ সেনাকর্মকর্তাদের কবরের কাছে নীরবে কিছু সময় অতিবাহিত করেন। পরে দোয়া ও মুনাজাতে শহীদ সেনাকর্মকর্তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করেন। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভরায়, রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, উপদেষ্টা হাসিবুল ইসলাম জয়, ভাইস চেয়ারম্যান আদেলুর রহমান আদেল, সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল খায়ের, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য জহিরুল ইসলাম মিন্টু, মাহমুদ আলম, সমরেশ মণ্ডল মানিক, সদস্য জহিরুল ইসলাম এতে উপস্থিত ছিলেন।
জাগপার আলোচনা সভা : জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি জাগপার সভাপতি ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধান বলেছেন, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আমার দেশের সেনাবাহিনীর ওপরে আঘাত করা হয়েছিল। দেশের সূর্য সন্তানদের হত্যা করে, আমাদের প্রতিরক্ষাকে দুর্বল করে, বাংলাদেশকে পঙ্গু করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। মেজর-জেনারেল থেকে ক্যাপ্টেন পর্যন্ত বিভিন্ন পদের ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তা সেদিন শহীদ হয়েছিলেন। সেই নির্মম-নৃশংস হত্যাযজ্ঞের স্বয়ংসম্পূর্ণ, অবিতর্কিত এবং গ্রহণযোগ্য তদন্ত আজো হয়নি। পিলখানা ট্র্যাজেডির রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি। অবিলম্বে ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ সেনা দিবস’ ঘোষণা করতে হবে। তিনি গতকাল সকালে আসাদ গেট জিইউপি মিলনায়তনে জাগপা আয়োজিত ‘পিলখানা ট্র্যাজেডিÑ কার স্বার্থে ষড়যন্ত্র’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন। জাগপা সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ইকবাল হোসেনের সভাপতিত্বে সভায় আরো বক্তব্য দেন জাগপা, যুব জাগপা ও জাগপা ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ।
জাগপা (লুৎফর) : এ দিকে জাগপা (লুৎফর) সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার লুৎফর রহমান বলেছেন, দেশবিরোধী ও গণতন্ত্রবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। গতকাল
নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ে বিডিআর ট্র্যাজেডি স্মরণে জাগপা আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে এ কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, বিডিআর ট্র্যাজেডি স্মরণে অনেক আগে থেকেই ২৫ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালন করা উচিত ছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের আত্মীয়স্বজনের বাইরে অন্য কোনো কিছুতে জাতীয় শোক পালনে রাজি নয়। সভা সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক এস এম শাহাদাত।
আগৈলঝাড়া (বরিশাল) সংবাদদাতা জানান, কর্নেল এ বি এম জাহিদ হোসেন চপল ও মেজর কাজী আশরাফের ১১তম শাহাদতবার্ষিকীতে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার চাঁদত্রিশিরা ও বেলুহার গ্রামের বাড়িতে দিনব্যাপী কুরআনখানি, কবর জিয়ারত, মিলাদ ও দোয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে। কর্নেল জাহিদ ও আশরাফের আপনজনের সাথে আগৈলঝাড়ার জনসাধারণও তাদের স্মরণ করে। পিলখানা ট্র্যাজেডির ছয় দিন পর উদ্ধার হওয়া মেজর কাজী আশরাফের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে আশরাফের পরিবার চট্টগ্রামে অবস্থান করায় গ্রামের বাড়ি বেলুহার গ্রামে তার চাচারা দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা