২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চুলায় আগুন জ্বালাতেই দগ্ধ ৮ জন একজনের মৃত্যু, দু’জন আইসিইউতে

-

নারায়ণগঞ্জ সাইনবোর্ড সাহেবপাড়া এলাকার একটি পাঁচতলা ভবনের নিচ তলায় বাসায় জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণে একই পরিবারের আটজন দগ্ধ হয়েছেন। গতকাল সোমবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে এই দুর্ঘটনা ঘটে। পরে গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় তাদেরকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হলে নুরজাহান বেগম (৭০) নামে একজনের মৃত্যু হয়। বাকি সাতজনের মধ্যে দুইজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদেরকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছে।
দগ্ধরা হলেন আবুল হোসেন ইমন (২৩), তার ছোট ভাই মাদরাসা ছাত্র আপন (১০), তাদের বাবা মো: কিরণ মিয়া (৫০), চাচা মো: হিরণ মিয়া (৩০), হিরণের স্ত্রী মুক্তা বেগম (২০), তাদের মেয়ে লিমা (৩) এবং ইমনের ফুপাতো ভাই স্কুলছাত্র কাউছার আহমেদ (১৩)। এ ঘটনায় নিহত নুরজাহান বেগম ইমনের দাদী।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা: সামন্তলাল সেন জানান, দগ্ধদের মধ্যে ইমনের শরীরের ৪৫ শতাংশ, কিরণের ৭০ শতাংশ, হিরণের ২২ শতাংশ, কাউছারের ২৫ শতাংশ, মুক্তার ১৫ শতাংশ, লিমার ১৪ শতাংশ, আপনের শরীরের ২০ শতাংশ এবং নুরজাহানের ১০০ দগ্ধ হয়। এদের মধ্যে নুরজাহান বেগম চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেলা ১১টার দিকে মারা গেছেন। বাকিদের মধ্যে ইমন ও তার বাবা কিরণের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের দুইজনকে ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হচ্ছে। বাকি পাঁচজনকে ওয়ার্ডে ভর্তি রাখা হয়েছে।
দগ্ধ নুরজাহান বেগমের মেয়ের জামাই মো: ইলিয়াস জানান, ইমনদের বাড়ি নরসিংদী শিবপুর উপজেলার কুমড়াদি গ্রামে। তারা সাহেবপাড়া ফারুকের পাঁচতলা বাড়ির নিচতলায় ভাড়া থাকত। সাইনবোর্ডে নরসিংদী গার্মেন্ট নামে একটি গেঞ্জির কারখানা আছে তাদের। আর ওই কারখানারই শোরুম রাজধানীর গুলিস্তানের ঢাকা ট্রেড সেন্টারের আন্ডারগ্রাউন্ডে। ইমন, তার বাবা কিরণ ও চাচা হিরণ একই সঙ্গে ব্যবসা করেন। সাহেবপাড়ায় থাকেন একই বাসায়। পাঁচ মাস আগে ইমন বিয়ে করেন। তার স্ত্রীর নাম শামীমা সিদ্দিকী। ঘটনার সময় তিনি ওই বাসায় ছিলেন না। তার আগেই সানারপাড়ে বাবার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি।
হাসপাতালে তাদের সাথে থাকা তাদেরই কারখানার কর্মচারী মোসাম্মৎ রাহেলা বেগম বলেন, আমি ওনাদের কারখানায় দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করি। থাকি ওই এলাকাতেই। ছয়-সাত বছর ধরেই দেখছি ওই এলাকার কোনো বাসাতেই দিনের বেলায় লাইনে গ্যাস থাকে না। রাত ১২টার পরে গ্যাস আসে আবার ভোর হলেই গ্যাস শেষ হয়ে যায়। শীতের দিন গরমের দিন একই রকম গ্যাসের সমস্যা। আর রাতে গ্যাসের চুলা চালু দিলেও চালু দেয়ার আধা ঘণ্টা পর্যন্ত গ্যাসের পাইপ দিয়ে শুধু পানি আসে। এরপর গ্যাস আসে। এ জন্য ওই এলাকার সবাই রাতে ঘুমানোর আগে চুলার সুইচ চালু দিয়ে রাখে। তিনি জানান, ইমনদের বাসায়ও চুলা চালু দিয়ে রেখেছিল। আর রান্না ঘরের দরজা জানালাও ছিলো বন্ধ। ভোরে ইমনের দাদী নুরজাহান ঘুম থেকে উঠে রান্না করার জন্য রান্নাঘরে গিয়ে ম্যাচ জ্বালাতেই জমে থাকা গ্যাসে আগুন ধরে বিস্ফোরণ হয়। এতে প্রথমে নুরজাহান দগ্ধ হন। সাথে সাথে বাকি রুমগুলোতেও আগুন ছড়িয়ে পড়লে আটজনই দগ্ধ হন। পরে বাকিরা দরজা খুলে নুরজাহানকে নিয়ে বাইরে বের হন। তিনি আরো বলেন, রুমে ইমনের মা লিপি বেগম ও দেড় বছরের ছোট বোন ইকরাও ছিল। ঘরে আগুন লেগে যাওয়ায় ইমন তাদেরকে দরজা দিয়ে না বের করে শাবল দিয়ে বারান্দার গ্রিল ভেঙে তার নিচ দিয়ে বের করেন। এ জন্য তারা দুইজন দগ্ধ হয়নি। তবে তাদের বের করতে গিয়ে ইমন দগ্ধ হয়। পরে তাকেও রুম থেকে বের করা হয়।
ইমনের ফুপাতো ভাই কাউছার স্থানীয় নিরাপদ আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। তার বাবা সৌদি প্রবাসী। তারা তিন ভাই ও দুই বোন। মা বাকি ভাইবোনদের নিয়ে কুমিল্লায় থাকেন। আর কাউছার নানী নুরজাহানের কাছে থাকত। দগ্ধ কিরণের স্ত্রী লিপি আক্তার জানান, শীতের কারণে সারা রাত ঘরের সব দরজা-জানালা বন্ধ ছিল। ধারণা করা হচ্ছে রান্নাঘরের গ্যাসের চুলার চাবি ঠিকমতো বন্ধ না করায় সারা রাত গ্যাস লিক বন্ধ ঘরে জমে থাকে। ভোরে চুলা ধরাতে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালানোর সাথে সাথে চার রুমে আগুন ছড়িয়ে পড়ে আটজনই দগ্ধ হন। তিনি আরো জানান, এ এলাকায় প্রায় সময়ই চুলায় গ্যাসের চাপ থাকে না। হয়তো গ্যাস সরবাহ না থাকার সময় কেউ চুলার চাবি ঘুরিয়ে গ্যাস না থাকায় তা বন্ধ করতে ভুলে যায়। নিয়মিত গ্যাসের চাপ না থাকায় অসাবধানতাবশত এ ভুলের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
আদমজী ইপিজেডের ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো: শাহজাহান জানান, ওই বাসায় গ্যাসের চুলা সারা রাত চালু থাকায় চারটি রুমে গ্যাস জমে ছিল। সকালে চুলা জ্বালানোর সাথে সাথে চার রুমে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আহতদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তাদের মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করা হয়। কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
আহতদের স্বজন ইলিয়াস জানান, ঘুম থেকে উঠে সিগারেটের জন্য আগুন ধরালে পুরো ঘরে আগুন ধরে যায়। ধারণা করা হচ্ছে গ্যাস জমে থাকায় আগুন লেগে দুর্ঘটনা ঘটে।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফিন বলেন, সিদ্ধিরগঞ্জের সাহেবপাড়া এলাকার একটি ফ্ল্যাট বাসায় এ ঘটনা ঘটে। ধারণা করা হচ্ছে রাতে রান্নার চুলা বন্ধ না করে ওই পরিবারের লোকজন ঘুমিয়ে পড়ে। ফলে চুলা থেকে গ্যাস বের হয়ে ঘরের ভেতর জমে থাকে। ভোর ৬টায় রান্নাঘরে গ্যাসের চুলায় আগুন ধরাতে গেলে জমে থাকা গ্যাসের বিস্ফোরণ হয়। এদিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ সূত্রে জানা যায়, আহত বাকি সাতজনের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তারা হলেন কিরণ (৭০ শতাংশ), ইমন (৪৫ শতাংশ) ও কাওছার (২৫ শতাংশ)।

 


আরো সংবাদ



premium cement