২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নাগরিকত্ব বিলে জ্বলছে আসাম

গুলিতে নিহত ৩
-

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের (সিএবি) বিরুদ্ধে প্রতিবাদে চলাকালীন এ বার রক্ত ঝরল আসামে। পুলিশের গুলিতে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে সেখানে। গুলিবিদ্ধ হয়ে গৌহাটি মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন দু’জন। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে। স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, লালুঙ গাঁওতে এ দিন বিক্ষোভ সামাল দিতে গিয়ে আন্দোলনকারীদের সাথে খণ্ডযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে পুলিশ। উত্তেজিত জনতাকে থামাতে গুলি চালায় পুলিশ। তাতেই পাঁচজন আহত হন। দ্রুত তাদের হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে মৃত্যু হয় ওই তিনজনের।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসামে বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে রাতভর বিক্ষোভের পর ওই রাজ্যে হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। সকালে গৌহাটিতে লোকজন কারফিউ ভেঙে রাস্তায় নেমে আসে। আসামের ছাত্রসংগঠন এএএসইউ ও কেএমএসএস লোকজনকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানায়। গৌহাটির শহরতলীর কোনো কোনো এলাকায় পুলিশ গুলি বর্ষণ করেছে বলেও খবর পাওয়া গেছে। নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে বিক্ষোভকারীরা রাজধানী গৌহাটিতে কারফিউ ভঙ্গ করে দোকানপাট ও যানবাহনে আগুন দিয়েছে। বেশ কয়েকটি রেলস্টেশনেও ভাঙচুর হয়েছে বলে জানা গেছে। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে। খবর রয়টার্স বিবিসি এনডিটিভি ও আনন্দবাজার পত্রিকার।
বিজেপি সরকার বলছে, এই নাগরিকত্ব বিল পাসের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় কারণে নিপীড়িত অমুসলিমদের আশ্রয়স্থল হবে ভারত। তবে সমালোচকদের মতে, দেশটির মুসলমানদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতেই এ বিল আনা হয়েছে। বিলটিকে আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। বিতর্কিত ওই বিলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে ভারতে গিয়ে বসবাসরত হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পার্সি ও খ্রিষ্টানদের নাগরিকত্ব দেয়ার কথা বলা হয়েছে। মোদি সরকারের মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর ধারাবাহিকভাবে লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিলটি পাস হলে আরো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে নাগরিকত্ব আইনবিরোধী আন্দোলনকারীরা। এর জেরেই শেষ পর্যন্ত আন্দোলন দমনে সেনা মোতায়েনে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।
সেনা মোতায়েন নিয়ে সংবাদ সংস্থা পিটিআইর সাথে কথা বলেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল পি খোঙ্গসাই। তিনি জানান, গৌহাটি শহরে দুই কলাম (এক কলামে থাকে ৭০ জন জওয়ান, যার নেতৃত্বে থাকেন এক বা দুইজন অফিসার) সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। তারা এলাকায় টহল দিচ্ছে। তিনসুকিয়া, ডিব্রুগড় ও জোড়হাট জেলাতেও টহল দিচ্ছে সেনারা।
বুধবার সন্ধ্যায় ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় সিএবি পাস হওয়ার পরপরই আসামের বিভিন্ন অংশে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পুরো রাজ্যকে অস্থির করে তোলে। প্রতিবাদ চলতে থাকায় আসাম ও প্রতিবেশী ত্রিপুরায় সব ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়। গৌহাটি ও ডিব্রুগড়গামী বহু ফ্লাইট বাতিল করা হয়। হাজার হাজার লোক রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে অংশ নিতে থাকায় একপর্যায়ে আসামের চারটি এলাকায় সেনাবাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়।
বিক্ষোভের মুখে আসামের বৃহত্তম শহর গৌহাটিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। ডিব্রুগড়ে প্রতিবাদকারীরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সানোয়াল ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামেশ্বর তেলির বাড়িতে চড়াও হওয়ার পর সেখানেও কারফিউ জারি হয়। প্রতিবাদকারীরা সানোয়ালের লক্ষ্মীনগরের বাড়িতে পাথর নিক্ষেপ করে। তারা আরেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দুলিয়াজানের বাড়িতেও হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে।
বুধবার রাতে ডিব্রুগড়ের চাবুয়ায় প্রতিবাদকারীরা একটি রেলস্টেশনে আগুন লাগিয়ে দেয়। তিনসুকিয়া জেলার পানিতোলা রেলস্টেশনও প্রতিবাদকারীরা পুড়িয়ে দিয়েছে বলে নর্থ-ইস্টান ফ্রন্টিয়ার রেলওয়ের মুখপাত্র জানিয়েছেন।
ইন্ডিগো বৃহস্পতিবার তাদের ডিব্রুগড়গামী ও সেখান থেকে ছেড়ে আসার কথা থাকা সব ফ্লাইট বাতিল করে। স্পাইসজেটও গৌহাটি ও ডিব্রুগড়গামী ও সেখানে থেকে ছেড়ে আসার কথা থাকা তাদের সব ফ্লাইট শুক্রবার পর্যন্ত বাতিল করে। ভারতের অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী অন্য এয়ারলাইন্সগুলো একই ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়। মঙ্গলবার বেলা ২টা থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার জন্য পুরো আসামজুড়ে ইন্টারনেট সার্ভিস বন্ধ রাখা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার প্রতিবেশী ত্রিপুরায় বন্ধের ডাক দিয়েছে বিরোধী দল কংগ্রেস। ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে এই রাজ্যটিতে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে আসাম রাইফেলের ২১০ জন আধাসেনা মোতায়েন করা হয়েছে। এর আগে রাজ্যটিতে সেনাবাহিনীর ১৪০ জন সদস্যকে মোতায়েন করা হয় বলে ভারতের প্রতিরক্ষা বিভাগের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন। প্রতিবেশী আসামের ছাত্রসংগঠন এএএসইউ ও কেএমএসএস লোকজনকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানানোর পর কারফিউ অমান্য করে হাজারো জনতা রাস্তায় নামে।
রাজ্যের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, পরিস্থিতি মোকাবেলার লক্ষ্যে কাশ্মিরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সেনাবাহিনীর কিছু ইউনিটকে আসামে সরিয়ে আনা হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সানোয়ালসহ বেশ ক’জন বিজেপি নেতার বাড়িঘরে হামলা করেছে বলে রয়টার্স উল্লেখ করেছে। উত্তেজনা প্রশমনের জন্য রাজ্যের ১০টি জেলায় মোবাইল ইন্টারনেট বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে।
কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসসহ ভারতের বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দল সংসদে সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল বা সিএবি নামে পরিচিত এই বিতর্কিত বিলটির বিরোধিতা করেছে। ভারতের বিভিন্ন মুসলিম দলের নেতারাও বিলটিকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন।
আসামে যারা এই বিলের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তাদের বক্তব্য হলো, এই বিলের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ থেকে আসামে আরো বেশিসংখ্যক বাঙালি হিন্দুর আসার পথ খুলে দেয়া হয়েছে। আসামে দীর্ঘ দিন ধরে স্থানীয় অহমিয়া জনগোষ্ঠীর সাথে বাংলাভাষী জনগণের বিরোধ চলছে।
অহমিয়াদের প্রতি মোদির আশ্বাস : আসাম অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলছেন, এই আইনটি নিয়ে আসামের বাসিন্দাদের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। ইংরেজি ও অহমিয়া ভাষায় পাঠানো একের পর এক টুইট-বার্তায় মোদি বলছেন, আসাম চুক্তির অনুচ্ছেদ ছয়কে রক্ষা করার জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে এবং কেন্দ্রীয় সরকার সম্ভাব্য সব কিছুই করবে। এই চুক্তিতে স্থানীয় বাসিন্দাদের রাজনৈতিক, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক এবং ভূমির অধিকারকে হেফাজত করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।
সহিংসতা থামেনি : প্রধানমন্ত্রীর এই টুইটেও সহিংসতা বন্ধে কোনো কাজ হয়নি বলে জানিয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা। পত্রিকাটি উল্লেখ করেছে, প্রধানমন্ত্রীর টুইটে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএবি) নিয়ে বিক্ষোভ থামানো গেল না আসামে। বরং কারফিউ ভেঙেই এবার গৌহাটির রাস্তায় নেমে এলেন সাধারণ মানুষ। নিরাপত্তাবাহিনীর উপস্থিতিতেই জায়গায় জায়গায় বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন তারা। জ্বলন্ত কাঠ ফেলে রাস্তা অবরোধের অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। এমনকি ডিব্রুগড় রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের একটি দফতরে তারা হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ স্থানীয় বিজেপি নেতাদের। দফতরের বাইরে বেশ কয়েকটি গাড়িও জ্বালিয়ে দেয়া হয় বলে দাবি তাদের।
আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়িয়েছে অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু) এবং কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতি (কেএমএসএস)। সাধারণ মানুষকে ঘর ছেড়ে রাস্তায় নামার আর্জি জানিয়েছে তারা। এ দিন আসুর তরফে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে বলা হয়, ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে লড়াই চলবে। বেলা ১১টায় গৌহাটির লতাশীল ময়দানে জমায়েত রয়েছে। তার জন্য সবাইকে ঘর ছেড়ে রাস্তায় নামার আর্জি জানাচ্ছি আমরা।’ এমন পরিস্থিতিতে গৌহাটির পুলিশ কমিশনার দীপক কুমারকে সরানো হয়েছে। তার জায়গায় আনা হয়েছে মুন্নাপ্রসাদ গুপ্তকে।
বিক্ষোভ হিংসাত্মক আকার ধারণ করায় বুধবার থেকেই অবরুদ্ধ আসাম। এ দিন এয়ার ইন্ডিয়া, ইন্ডিগো, স্পাইসজেট, ভিস্তারা, গো এয়ার-সহ বেশ কিছু সংস্থা আসাম বিমানবন্দর থেকে তাদের একাধিক বিমানের যাত্রা বাতিল করেছে। বাতিল করা হয়েছে বেশ কিছু বিমানের অবতরণ।
বিক্ষোভ চলাকালীন ডিব্রুগড়ের ছাবুয়ার একটি রেলস্টেশন চত্বরে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। তিনসুকিয়ার পানিতোলা স্টেশন চত্বরেও আগুন ধরানো হয়, যার পর এ দিন আসামে সব লোকাল ট্রেন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। ডিব্রুগড় থেকে সব দূরপাল্লার ট্রেনও বন্ধ রাখা হয়েছে। এ দিন গৌাহাটিতে রণজি ট্রফিতে সার্ভিসেস বনাম আসামের ম্যাচ ছিল। কারফিউর জেরে তা-ও সাসপেন্ড করা হয়েছে।
বিতর্কিত আইনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের : নাগরিকত্ব আইনের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ বৃহস্পতিবার আদালতে মামলা দায়ের করেছে। সুপ্রিম কোর্টের কাছে পেশ করা এক আর্জিতে আইউএমএল বলছে, এই আইনটি ভারত সংবিধানের সাম্য, মৌলিক অধিকার এবং জীবনের অধিকারসংক্রান্ত বিধানগুলোকে ভঙ্গ করছে।


আরো সংবাদ



premium cement