২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মিয়ানমারকে বয়কটের ডাক

বিশ্ব আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার শুরু আজ
-

রাখাইনে সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধনে চালানো গণহত্যার জন্য মিয়ানমারকে জবাবদিহি করার সময় এসেছে। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন এ কথা বলেন। আজ মঙ্গলবার নেদারল্যান্ডসের হেগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলার শুনানি শুরু হচ্ছে। চলবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত।
এ দিকে ১০টি দেশের ৩০টি মানবাধিকার, শিক্ষাবিদ ও পেশাদারদের সংগঠন মিয়ানমারকে বর্জনের ডাক দিয়েছে।
ক্ষমতাসীন এনডিএ দলের নেতা নোবেল জয়ী অং সান সু চি স্বয়ং এ মামলায় মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন। এর মধ্য দিয়ে এই প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা ইস্যুতে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য মিয়ানমার কোনো আদালতে দাঁড়াচ্ছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্ববাসীকে নিজেদের অবস্থান জানানোর ক্ষেত্রে এটিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে মিয়ানমার।
এর আগে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) এখতিয়ার অস্বীকার করেছে। মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসঙ্ঘের স্পেশাল রেপোর্টিয়ার এবং জাতিসঙ্ঘের তথ্যানুসন্ধান দলকে মিয়ানমারে ঢোকার অনুমতি দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের সাথে প্রত্যাবাসন চুক্তি করেও একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি প্রতিবেশী দেশটি। কিন্তু আইসিজে সনদে স্বাক্ষরকারী হিসেবে আন্তর্জাতিক এই আদালতকে অস্বীকার করতে পারেনি দেশটি।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও রাষ্ট্রদূত তৌহিদ হোসেন গতকাল সোমবার নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে বলেছেন, আইসিজের প্রক্রিয়াকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখি। এতে যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তা নয়; মিয়ানমারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে যেখানে যে সুযোগ রয়েছে তা কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন, গাম্বিয়ার করা মামলার সুরাহা হতে চার থেকে ছয় বছর পর্যন্ত লাগতে পারে। আমরা চাই এই মামলার মাধ্যমে রাখাইনের ঘটনার সত্যতা উদঘাটিত হোক এবং গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধে মিয়ানমারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য হোক।
আইসিজের রায় মানতে মিয়ানমার বাধ্য কি না জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, বাস্তবিক অর্থে রায় মানার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। রায় বিপক্ষে গেলে মিয়ানমার তা না মেনে পার পেয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। সে ক্ষেত্রে আইসিজের রায় বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়বে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের ওপর। চীন বা রাশিয়া এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের পক্ষ নিয়ে ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করবে কি না তা দেখার বিষয়। এ ছাড়া নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি গেলে তা দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে পড়তে পারে। রায়ে মিয়ানমারের গণহত্যার বিষয়টি উঠে এলে কী করতে হবে তা নিয়েও নিরাপত্তা পরিষদ সদস্যদের ভিন্ন ভিন্ন মত থাকতে পারে। তিনি বলেন, মিয়ানমার কয়েকটি দেশকে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে জাতিগত নিধনের মতো অপরাধ থেকে দায়মুক্তি পেয়ে যাওয়া চেষ্টা করছে। মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসহ কার্যকর সব পদক্ষেপ এখনই নেয়া প্রয়োজন।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য সম্ভব সব ধরনের পদক্ষেপ আমাদের নিতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আদালতে দায়ের করা মামলাগুলোতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে।
নেদারল্যান্ডসের পিস প্যালেসে অবস্থিত আইসিজেতে আজ গাম্বিয়ার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা গণহত্যার মামলার শুনানি শুরু হবে। ১১ ডিসেম্বর বক্তব্য উপস্থাপন করবে মিয়ানমার। ১২ ডিসেম্বর সকালে গাম্বিয়া পাল্টা যুক্তি দেবে মিয়ানমারের বিপক্ষে। আর দুপুরে মিয়ানমার গাম্বিয়ার জবাব দেবে।
গণহত্যার অপরাধে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সিদ্ধান্তে গাম্বিয়া এই মামলা করে। মামলা পরিচালনায় প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত দিয়ে মিয়ানমারকে সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ ও কানাডা। পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হকের নেতৃত্বে নেদারল্যান্ডসে রয়েছে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল। মিয়ানমারবিষয়ক কানাডার বিশেষ দূত বব রায়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলও নেদারল্যান্ডসে রয়েছে।
শুনানিতে মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মিয়ানমার জাতিসঙ্ঘের গণহত্যা সনদ ভঙ্গ হয় এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া থেকে যাতে বিরত থাকে এবং মামলার সাথে সম্পর্কিত সাক্ষ্যপ্রমাণ ও আলামত যাতে ধ্বংস না করে সে জন্য অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ চাইবে গাম্বিয়া।
আইসিজেতে মামলা লড়াইয়ের জন্য গাম্বিয়া শক্তিশালী একটি আইনজীবী দল গঠন করেছে। গাম্বিয়ার প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে রয়েছেন দেশটির বিচারমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল আবু বকর তামবাডু। তিনি রুয়ান্ডার গণহত্যা সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ছিলেন। তামবাডুর নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলে অভিজ্ঞ ও সুপরিচিত আন্তর্জাতিক আইনজীবীরা রয়েছেন। আইসিজে ও গণহত্যা কনভেনশনের ক্ষেত্রে তাদের অনেক অভিজ্ঞতা আছে।
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইসিজেতে গণহত্যা মামলার শুনানি চলাকালে নেদারল্যান্ডসে বেশ কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশসহ ওআইসির সদস্য কয়েকটি দেশ এবং একাধিক আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা এসব আয়োজনের সাথে যুক্ত। বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে নেদারল্যান্ডসে আসা রোহিঙ্গাদের সাথে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মতবিনিময়ের আয়োজন করা হয়েছে। আজ রাতে গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রীর সম্মানে ওআইসির চার সদস্য দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সংবর্ধনার আয়োজন করেছে। আইসিজেতে গাম্বিয়ার মামলা প্রক্রিয়ায় ওআইসির সমর্থনের বিয়ষটি তুলে ধরতে এই আয়োজন।
মিয়ানমারকে বর্জনের আহ্বান : আইসিজের শুনানিকে সামনে রেখে মিয়ানমারকে বর্জনের ডাক দিয়েছে ১০টি দেশের ৩০টি মানবাধিকার, শিক্ষাবিদ ও পেশাদারদের সংগঠন। এতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। ‘বয়কট মিয়ানমার ডট অর্গ’ চালু করেছে ‘বয়কট মিয়ানমার ক্যাম্পেইন’। এর সাথে যুক্ত রয়েছে ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশন, ফরসি ডট কো, রেস্টলেস বিংস, ডেস্টিনেশন জাস্টিস, রোহিঙ্গা হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্ক অব কানাডা, রোহিঙ্গা হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভ অব ইন্ডিয়া ও এশিয়া সেন্টার। এ নিয়ে বয়কট মিয়ানমার ডট অর্গ গতকাল লন্ডন থেকে তাদের ওয়েবসাইটে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে।
বয়কটের আহ্বানের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসে এসব সংগঠন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মিয়ানমারকে বর্জনের আহ্বানসংবলিত প্রচার অভিযান শুরু করেছে। এতে আরো বলা হয়, মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নৃশংসতা, গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। এর পক্ষে প্রত্যক্ষ ও ডকুমেন্টারি প্রমাণ রয়েছে। সারা বিশ্ব এর নিন্দা জানালেও হতাশার কথা, এ অভিযোগগুলো প্রত্যাখ্যান করছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি।
জার্মানভিত্তিক ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা নাই সান লুইন বলেছেন, জাতিসঙ্ঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জাতিকে নির্মূল করে দেয়ার একটি নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী হিসেবে আমরা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অধীনে ১৫ বছর গৃহবন্দী থাকা অং সান সু চির মুক্তির আন্দোলন করে এসেছি; কিন্তু তিনি সেই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি শুধু খুনি সেনাবাহিনীকে সাথে নিয়ে চলছেন। তাই আমরা মিয়ানমারের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে সবার প্রতি আহ্বান জানাই।তিনি আরো বলেন, উপরন্তু ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার নিন্দা জানিয়েছে, মিয়ানমারে মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসঙ্ঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ইয়াংহি লি দেখেছেন, একইভাবে রাষ্ট্র নির্দেশিত সেনাবাহিনী তার জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে একই রকম নির্যাতনে লিপ্ত। এসব সংখ্যালঘুর মধ্যে রয়েছে শান, কাচিন, তা’আং, কারেন, রাখাইন ও চিন সম্প্রদায়।
অং সান সু চিকে ২৮ বছর আগে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয় নরওয়ের নোবেল কমিটি; কিন্তু তিনি সম্মানের কোনো মূল্যই দেন না এমন দাবি করে সু চির ওই পুরস্কার কেড়ে নিতে অনলাইনে আবেদন চালু করেছে এই গ্রুপটি। ১৯৯০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে ছাত্রাবস্থায় ফ্রি বার্মা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন অধিকারকর্মী ড. মুয়াং জারনি। তিনি বলেন, বর্ণবাদবিরোধী ক্রেতা ও সংস্কৃতির মানুষের কাছে আমার দাবি মিয়ানমারকে বয়কট করুন।
তা ছাড়া ডাচ শহরে আজ রোহিঙ্গাদের কয়েকটি দলের পাশাপাশি সরকার সমর্থকরা বেশ কয়েকটি বিক্ষোভের পরিকল্পনা করেছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement