২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সস্তা ঋণের লাগাম টানায় বেকায়দায় বাণিজ্যিক ব্যাংক

অফশোর ব্যাংকিং নীতিমালা সংশোধন চান এমডিরা
-

সস্তা ঋণের লাগাম টেনে ধরায় বেকায়দায় পড়ে গেছে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। একে তো কাক্সিক্ষত হারে আমানত পাওয়া যাচ্ছে না। আদায় কমে গেছে বিতরণ করা ঋণ। আবার দেশের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের কাছ থেকেও ঋণ আদায় হচ্ছে না। সব মিলে কিছু কিছু ব্যাংকে চরম তহবিল সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে তহবিল যোগের কঠোরতা আরোপ করায় আগের মতো এ খাত থেকে তহবিল জোগাড় করা যাচ্ছে না। এমনি পরিস্থিতিতে চলমান সঙ্কট মোকাবেলায় অফশোর ব্যাংকিং নীতিমালা সংশোধন চেয়েছেন ব্যাংকের এমডিরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মূল ব্যাংকিংয়ের তুলনায় দ্রুত বেড়ে গিয়েছিল অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের (ওবিইউ) ঋণ। বর্তমানে ওবিইউতে বিদেশী ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে প্রায় এক হাজার কোটি ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা। অথচ, ২০১৭ সালের জুনে ছিল ৪৬ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের জুনে যা ছিল ৩৮ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রচলিত ব্যাংকের তুলনায় কম সুদের কারণে অফশোর বাড়তি চাহিদা রয়েছে।
জানা গেছে, অফশোর ব্যাংকিং হলো, দেশে কার্যরত ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ প্রদানের আলাদা ইউনিট। শুধু দেশের বাইরে থেকে তহবিল সংগ্রহ করে রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠানকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দিতে এ ইউনিট গঠন করা হয়। এখন পর্যন্ত ৫২টি ব্যাংক অনুমোদন নিয়ে ৩৫ ব্যাংক ঋণ বিতরণ করছে। এ ইউনিটের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণ বিদেশী ঋণ হিসেবে বিবেচিত। এর সুদের হার ৬ শতাংশের নিচে। অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশে কম। কারণ, ইউনিট নিয়ন্ত্রণের জন্য এতদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা বা নীতিমালা ছিল না। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, ব্যাংক কোনো আমানত সংগ্রহ করলেই তাদের সাড়ে ১৮ শতাংশ সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণ করতে হয়। সিআরআর রাখা হয় সাড়ে ৫ শতাংশ, যা ব্যাংকগুলোকে নগদে সংরক্ষণ করা হয়। আর এসএলআর ১৩ শতাংশ সংরক্ষণ করা হয়, ট্রেজারি, বিল, বন্ড, বিদেশী অ্যাকাউন্টে থাকা বৈদেশিক মুদ্রা ইত্যাদি সম্পদের মাধ্যমে। ওবিইউয়ের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো বিদেশী তহবিল আমানত আকারে এনে তা বিনিয়োগ করে থাকে। স্থানীয় তহবিলের ওপর সিআরআর এসএলআর সংরক্ষণ করতে হলেও বিদেশী মুদ্রায় আনা আমানতের ওপর তহবিল সংরক্ষণ করতে হয় না। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো শতভাগ বৈদেশিক তহবিলই ঋণ আকারে বিতরণ করতে পারত, যেখানে স্থানীয় তহবিলের ১০০ টাকায় সাড়ে ৮১ টাকা বিনিয়োগ করে। ফলে স্থানীয় তহবিলের চেয়ে বিদেশী তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় কম ছিল। এতে কম সুদে বিনিয়োগ করতে পারত। এর ফলে ব্যবসায়ীরা বিদেশী ঋণের প্রতি ঝুঁকে পড়েন।
অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঋণ নেয়াকে নিরুৎসাহিত করতে গত ফেব্রুয়ারিতে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা জারি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নীতিমালা করার পর থেকে ওবিইউয়ের মাধ্যমে ঋণ আসা কমে যায়।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, দেশের আমানত সঙ্কটের কারণে ও বিতরণ করা ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় অনেক ব্যাংকই ওবিইউয়ের মাধ্যমে তহবিল সংস্থান করত। ফলে আমানত প্রবাহ কমে গেলেও এতদিন তেমন প্রভাব পড়েনি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালা দেয়ার পর আগের মতো ওবিইউয়ের মাধ্যমে তহবিল সংস্থান করতে পারছেন না। এতে অনেকেই বিপাকে পড়ে গেছেন। অনেকেরই দৈনন্দিন কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কেউবা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে চলছে। আবার অনেকেই আন্তঃব্যাংক নির্ভর হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ কলমানি মার্কেট থেকে ধার করে চলছে। এমনি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ওবিইউ নীতিমালা সংশোধনের দাবি করেছেন ব্যাংকাররা। গত বুধবার এ নিয়ে এমডিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে। বৈঠকে দেশীয় ব্যাংকগুলোর অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট (ওবিইউ) পরিচালনার নীতিমালায় একাধিক বিষয়ে সংশোধন ও কিছু বিষয়ে স্পষ্টীকরণের দাবি তুলেছেন তারা। বিশেষ করে অফশোর ও মূল ব্যাংকিংয়ের মধ্যে তহবিল স্থানান্তর প্রক্রিয়া ও চার্জ নিয়ে স্পষ্ট করা হয়নি। এ ছাড়া দেশীয় ব্যাংকিংয়ের মতো এসএলআর, সিআরআর সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতার বিষয়ে একাধিক সমস্যার কথা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে সীমিত পর্যায়ে বিদেশী ব্যাংকগুলোর জন্য ওবিইউয়ের মাধ্যমে তহবিল আনার অনুমোদন দেয়া হয়। টাকার সংকটে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করতে না পারায় ২০১২ সালে তা সব ব্যাংকের জন্য খুলে দেয়া হয়। ২০১৩ সালে বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক ভিত্তিতে এ বিদেশী ঋণ আসে বাংলাদেশে।

 


আরো সংবাদ



premium cement