২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে অনিশ্চয়তা

কাল থেকে ফিরতে শুরু করার কথা ; ইউএনএইচসিআর মনে করে অনুকূল পরিবেশ নেই
-

কাল থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করার কথা বলা হলেও অনিশ্চয়তা কোনোভাবেই কাটছে না। জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলেছে, রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা, নিরাপদ, মর্যাদাসম্পন্ন ও টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনের পরিবেশ অনুকূল- এ কথা আমরা বিশ্বাস করি না। তবে ইউএনএইচসিআর, ইউএনডিপি ও মিয়ানমার সরকারের সাথে গত জুনে সই হওয়া ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) অনুযায়ী উদ্বাস্তুদের জন্য রাখাইনে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সে দেশের সরকারকে সমর্থন দিতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সংস্থাটি বলেছে, উদ্বাস্তুরা স্বেচ্ছায় ফিরতে চায় কিনা তা যাচাই করার কাজ ইউএনএইচসিআর শিগগির শুরু করবে। তবে প্রত্যাবাসনের পরিণতি কী হবে তা এখনই ধারণা করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র জোসেফ ত্রিপুরা গতকাল নয়া দিগন্তের এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা জানান। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের আদি নিবাসে বা তাদের পছন্দের জায়গায় নিরাপদ ও মর্যাদার সাথে স্বেচ্ছা ও টেকসই প্রত্যাবাসনকে ইউএনএইচসিআর সমর্থন দিয়ে যাবে। এ লক্ষ্য অর্জনে আমরা সব পক্ষের সাথে কাজ করব। তবে প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্তটি আসতে হবে সরাসরি উদ্বাস্তুদের কাছ থেকে। আর এ জন্য তাদের কাছে অবাধ তথ্যের সরবরাহ থাকতে হবে।
এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, গত ৩০ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-মিয়ানমার যৌথ কার্যকরী গ্রুপের (জেডাব্লিউজি) বৈঠকে ১৫ নভেম্বর (আগামীকাল) থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য বাংলাদেশ যাচাই-বাছাই করা দুই হাজার ২৬০ জন রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারকে দিয়েছে। একই দিন এ তালিকা জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়কের কাছে সরবরাহ করা হয়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনের জন্য কাজ শুরু করতে ইউএনএইচসিআরকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু এ কাজ শুরু করতে ইউএনএইচসিআর অস্বাভাবিক বিলম্ব করেছে। অবশেষে আজ থেকে সংস্থাটির তৎপর হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
কর্মকর্তা বলেন, ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসে রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে তার দেশের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন। রোহিঙ্গারা টেকনাফের দু’টি ট্রানজিট পয়েন্ট থেকে মিয়ানমার সীমান্তে যাবে। মিয়ানমার সীমান্তে দু’টি ক্যাম্পে তাদের গ্রহণ হবে।
ক্যাম্প ছেড়ে পালানোর তথ্য নেই : প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের পালিয়ে যাওয়ার কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক। এ ছাড়া বৃহস্পতিবার থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেছেন। গতকাল রাজধানীর হোটেল রেডিসনে ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’ শিরোনামে এক কর্মশালা শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন।
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে কি-না জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘দেখা যাক, আমরা আশাবাদী। আমরা চেষ্টা করছি।’ তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার মিলে একটি সময় ঠিক করেছে। সে অনুযায়ী কাজ করছি। এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া। রোহিঙ্গারা তাদের দেশে ফেরত যাবে এটিই স্বাভাবিক।’
মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী উইন মিয়াত আই গত রোববার ইয়াঙ্গুনে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ১৫ নভেম্বর থেকে প্রত্যাবাসন শুরুর করার ব্যাপারে দুই দেশ আগেই একমত হয়েছে। নির্ধারিত দিনে প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য মিয়ানমার প্রস্তুত রয়েছে। প্রত্যাবাসন শুরু হলে প্রতিদিন ১৫০ শরণার্থী মিয়ানমার ফিরতে পারবে।
দিল্লিতে কূটনীতিকদের ব্রিফ : বাংলাদেশের অতিরিক্ত দায়িত্ব রয়েছে, দিল্লিভিত্তিক এমন ৬০ জন কূটনীতিককে রোহিঙ্গা পরিস্থিতির ওপর ব্রিফ করেছেন ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মুয়াজ্জিম আলী। রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা ও নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য তিনি কূটনীতিকদের প্রতি আহ্বান জানান।
হাইকমিশনার বলেন, মিয়ানমারের ওপর অব্যাহত ও টেকসই আন্তর্জাতিক চাপ রোহিঙ্গা সঙ্কটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমার এই জঘন্য মানবিক সঙ্কট সৃষ্টি করেছে, যার বোঝা বাংলাদেশকে বহন করতে হচ্ছে।
জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে ‘মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ বিষয়ক ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রস্তাবের প্রতি কূটনীতিকদের সমর্থন চান মুয়াজ্জিম আলী। আগামীকাল বৃহস্পতিবার ভোটাভুটির জন্য তা তৃতীয় কমিটিতে উত্থাপন করা হবে।
কক্সবাজার (দক্ষিণ) সংবাদদাতা গোলাম আজম খান জানিয়েছেন, মিয়ানমার-বাংলাদেশ সমন্বয়ে গঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সিদ্ধান্ত মতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রত্যাবাসনের জন্য টেকনাফের কেরুনতলী ট্রানজিট ক্যাম্প প্রস্তুত করা হয়েছে। অন্য দিকে বান্দরবানের ঘুমধুমে আরো একটি ট্রানজিট ক্যাম্প প্রায় সম্পন্নের পথে। প্রথম ব্যাচে ৪৮৫টি পরিবারের দুই হাজার ২৬০ জন রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফ দিয়ে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে।
এর আগে ঢাকাকে নেইপিডোর পক্ষ থেকে জানানো হয়, এরই মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় মিয়ানমার ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গা নাগরিকদের বসবাসের জন্য ভারত সরকার ২৮৫টি বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছে। আর চীন সরকার এক হাজার বাড়ির কাঠামো পাঠিয়েছে, যেগুলো সংযোগ করলেই পূর্ণ বাড়িতে রূপ নেবে। অন্য দিকে দুই দেশের সীমান্তের শূন্য রেখায় যেসব রোহিঙ্গা বসবাস করছেন তাদের ফিরিয়ে নেয়ার কাজও দ্রুত শুরু হচ্ছে।
ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেড ক্রস (আইসিআরসি) শূন্য রেখায় বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারকে সাথে নিয়ে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। শূন্য রেখায় বসবাসকারীরা তাদের আগের বসতভিটায় সরাসরি ফেরত যাবে।
উখিয়ার থাইংখালী জামতলী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশ্রিত রোহিঙ্গা ও প্রত্যাবাসনের প্রথম ধাপে তালিকাভুক্ত হোছন আহাম্মদ (৪২) ও তার স্ত্রী মিনারা বেগম (৩৭) জানান, এটি তাদের দেশ নয়, সুতরাং তারাও অধীর আগ্রহ রয়েছে কখন মিয়ানমারে ফিরবে সে আশায়। তবে সে ক্ষেত্রে তারা বলেন, মিয়ানমার সরকার তাদের ট্রানজিট ক্যাম্পে রাখতে পারবে না। সরাসরি তাদের নিজ ভিটেমাটিতে ফেরত দিতে হবে।
তালিকাভুক্ত আরেকজন মো: ফায়সাল (৩০) জানায়, মিয়ানমার থেকে এখনো রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসছে। মিয়ানমারে এখনো নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। এরপরও আমাদের ফেরত যেতে হলে নিরাপত্তাসহ আমাদের যেসব দাবি-দাওয়া রয়েছে তা পূরণ করতে হবে মিয়ানমারকে।
একই কথা মংডু শিলখালী এলাকার বাসিন্দা ছৈয়দা খাতুন (৪০)-এর। তার পরিবারে পাঁচ সদস্য রয়েছে প্রত্যাবাসনের তালিকায়। সে জানায় সম্প্রতি মিয়ানমারের পররাষ্ট্রসচিব মিন্ট থোয়ে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনকালে আমাদের বলেছে মিয়ানমারে গিয়ে এনভিসি (ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড) নিতে হবে। এটি নেয়া মানে আমাদের আজীবন বাঙালি করে রাখা। এ ছাড়াও আমাদের নিরাপদ পরিবেশ, ভিটেমাটি ফেরতসহ মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা না হলে আমরা কিভাবে যাব?
নাগরিকত্ব, বসতভিটা, জমিজমা ফিরিয়ে দিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হলে নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরতে রাজি রোহিঙ্গারা।
গত বছরের ২৪ আগস্ট নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর রাখাইনে পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। নিপীড়নের মুখে গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাত লাখেরও অধিক রোহিঙ্গা। এর পূর্ব থেকে আশ্রয় নেয়াসহ ১১ লাখের অধিক রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩০টি ক্যাম্পে অস্থায়ীভাবে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বিভিন্ন সংস্থা তাদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, অস্থায়ী বাসস্থানসহ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ও সসম্মানে স্বদেশে ফেরত পাঠাতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে সরকার। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দুই দেশের সমন্বয়ে গঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভায় একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর।
স্মারকের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ মিয়ামারের কাছে আট হাজার রোহিঙ্গার তালিকা পাঠায়। যাচাই-বাছাই শেষে মিয়ানমার ওই তালিকা থেকে পাঁচ হাজার ৫০০ জনকে প্রত্যাবাসনের ছাড়পত্র দেয়। সেই ছাড়পত্রের মধ্য থেকে প্রথম ধাপে দুই হাজার ২৫১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন করা হবে। চুক্তি অনুযায়ী প্রতিদিন ফেরত নেয়া হবে ১৫০ জন রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গাদের প্রথম ধাপের প্রত্যাবাসন কার্যক্রম ১৫ নভেম্বর থেকে শুরু হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার এবং জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য মো: আবুল কালাম জানান, মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব মিন থোয়ে গত ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশ সফরে এসে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, প্রত্যাবাসনের পর রোহিঙ্গাদের প্রথমে মংডু শহরে স্থাপিত আইডিপি ক্যাম্পে নেয়া হবে। এরপর নিজেদের গ্রামে ফেরত যেতে পারবে। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মানবিক বিষয়গুলো নিশ্চিত করারও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। চলতি নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রত্যাবাসনের বিষয়টিও নিশ্চিত করেন তিনি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম ফলপ্রসূ করার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে প্রশাসন।

 


আরো সংবাদ



premium cement