২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকের ৩৫৯টি শাখা লোকসানি

খেলাপি ঋণের উচ্চ হারই প্রধান সমস্যা
-

ঋণ ব্যবস্থাপনা এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিপালন ব্যবস্থায় দুর্বলতার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। উচ্চ হারের খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়ায় ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি বাড়ছে। আর আয় খাত থেকে টাকা এনে প্রভিশন ঘাটতি মেটাতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর লোকসানি শাখা বাড়ছে। লোকসানি শাখা বাড়ায় ব্যাংকগুলোর সামগ্রিক অর্থনৈতিক সূচক দিন দিন খারাপ অবস্থানে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে ব্যাংকগুলোর এ চিত্র উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি লোকসানি শাখা সোনালী ব্যাংকের। ব্যাংকটির এক হাজার ২১২টি শাখার মধ্যে ১৮৩টিই লোকসানি শাখা। জনতা ব্যাংকের ৯০৮টি শাখার মধ্যে ৫৭টি লোকসানি। অগ্রণী ব্যাংকের ৯৩১টির মধ্যে ৪৩টি, রূপালী ব্যাংকের ৫৬২টির মধ্যে ৩৩টি, বেসিক ব্যাংকের ৬৮টি শাখার মধ্যে ২১টি এবং বিডিবিএল’র ৪০টির মধ্যে ২২টিই লোকসানি শাখা।
লোকসানি শাখা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো খেলাপি ঋণের উচ্চ হার। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, মার্চ শেষে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা, মোট ঋণের ৩৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ। জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৯ হাজার ৭০২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২১ দশমিক ৯৩ শতাংশ। বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫৯ দশমিক ২২ শতাংশ বা ৮ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণ মোট ঋণের ৫৫ দশমিক ১৪ শতাংশ বা ৮০৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ কমিয়ে সম্পদের গুণগত মান বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতি বছরই শীর্ষ ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেধে দেয়া হয়। প্রতি তিন মাস অন্তর ব্যাংকগুলো কী পরিমাণ ঋণ আদায় করতে পারছে তা অগ্রগতির জন্য পর্যালোচনা বৈঠক আয়োজন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। শীর্ষ ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায় করতে পারছে না দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। বিশেষ করে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিলেও তা অর্জন করতে পারছে না। শীর্ষ ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায় করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণ সম্পর্কে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, শীর্ষ ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগই উচ্চ আদালতে রিট করায় তাদের কাছ থেকে ঋণ আদায় করতে পারছে না। এর বাইরে অন্য খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায় করতে না পারার কারণ হিসেবে ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটছে না। ব্যবসায়-বাণিজ্য স্থবিরতার কারণে ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। এর ফলে আদায় কাক্সিক্ষত হারে হচ্ছে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বেশির ভাগ ঋণই রাজনৈতিক বিবেচনায় বিতরণ করা হয়েছিল। আর এ কারণে রাঘব বোয়ালরা ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। এর ফলে ব্যাংকগুলোর আয় থেকে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। পাশাপাশি বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণের ফলে ব্যাংকের আয় কমে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে মূলধন ঘাটতি। আর এ ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে জনগণের করের টাকা থেকে।
খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণ ব্যবস্থাপনা এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিপালন ব্যবস্থায় দুর্বলতার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককগুলোর বিতরণ করা ঋণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। আবার এসব খেলাপি ঋণ আদায়ও সন্তোষজনক নয়। বিপরীতে ব্যাংকগুলোর আয় খাত থেকে অর্থ এনে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকের আয় ও মূলধনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সরকারি ব্যাংকগুলোর এ অবস্থার জন্য প্রধানত দুর্নীতি ও অনিয়মই দায়ী। এ ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতি হয়েছে লুটপাট ও অনিয়মের কারণে। ব্যাংকগুলো থেকে অনিয়ম দূর করা জরুরি। উল্লেখ্য, সরকার এ ব্যাংকগুলোতে পরিচালক ও চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়। তাদের মেয়াদ বৃদ্ধি করেও প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও ডিএমডির নিয়োগ দেয় সরকার। পদোন্নতির ক্ষেত্রে থাকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রতিনিধিত্ব। এসব কারণে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ছুটে যায় মন্ত্রণালয়ে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক কর্মকাণ্ডে সূচকের উন্নতির দিকে আগ্রহ থাকে না ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও পরিচালনা পর্ষদের। এসব কারণেই ব্যাংকগুলো ক্রমশ অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement