বিশেষ সুবিধায় নবায়ন করা বেশির ভাগ ঋণই খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। নানা কৌশলে ঋণখেলাপিরা ব্যাংকের ঋণ নবায়ন করেন। কখনো ঋণ পুনর্গঠনের নামে, কখনোবা ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ঋণ নবায়ন করেন। ঋণ নিয়মিত করার পর কিছু দিনের মধ্যেই আবার নতুন করে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। নতুন ঋণ নেয়ার পর সেই ঋণও পরিশোধ করেন না। ফলে আগের পুনঃতফসিল করা ঋণ যেমন ফের খেলাপি হয়ে পড়ে, সাথে সাথে নতুন ঋণও খেলাপি হয়ে পড়ে। এভাবে এক একটি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত ৫ বছরে এমন প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়েছিল, যার বেশির ভাগই আবার খেলাপি হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মাত্র ১ ও ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ২০১৫ সালে ১৪টি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছিল। এর মধ্যে মাত্র দু’টি ব্যবসায়ী গ্রুপ নবায়ন করা ঋণের কিস্তি কিছু দিন পরিশোধ করেছিল। বাকিরা তেমন কোনো অর্থ পরিশোধই করেনি। ফলে বিশেষ সুবিধায় নবায়ন করা এসব ঋণ মাত্র চার বছরের ব্যবধানে সুদাসলে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকায় ঠেকেছে।
আবার কিছু কিছু বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ বিশেষ সুবিধায় নবায়ন করা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছে না। আবার তাদেরকে ঋণখেলাপিও বলা যাবে না। উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়েছে তারা। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণতথ্য বিভাগ তথা সিআইবিতে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা যাচ্ছে না। এমন খেলাপি ঋণের পরিমাণ রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এসব ঋণের বেশির ভাগই কয়েক দফা নবায়ন করা হয়েছিল।
গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্য নিয়ে তৈরি বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টে ঋণ পুনঃতফসিলকৃত তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে ব্যাংকগুলো পুনঃতফসিল করেছে প্রায় ৯০ হাজার টাকার খেলাপি ঋণ। এর মধ্যে শুধু ২০১৮ সালেই পুনঃতফসিল করা হয়েছে ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। এক বছরে এত পরিমাণ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের ঘটনা আগে কখনো হয়নি। ২০১৭ সালে ১৯ হাজার ১২০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করেছিল ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে গত বছরে ঋণ পুনঃতফসিল বেড়েছে ২৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময় নীতিমালা শিথিল করে ঋণখেলাপিদের সুবিধা দিয়ে থাকে। গত কয়েক বছর ধরে এমনই চলছে ব্যাংকিং খাতে। যেমন, ২০১২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পুনঃতফসিলের পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা সার্কুলার আকারে জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরবর্তী সময়ে দুই দফায় তা সংশোধন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব সুবিধা নিয়ে ২০১৩ সালেই ১৮ হাজার ২০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেন ঋণখেলাপিরা। এরপর ২০১৪ সালে ১২ হাজার ৩৫০ কোটি ও ২০১৫ সালে ১৯ হাজার ১৪০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। ২০১৬ সালে ১৫ হাজার ৪২০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করার পর ২০১৭ সালে এর পরিমাণ ২৪ শতাংশ বেড়ে যায়। ওই বছর দেশের ব্যাংকগুলোর পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৯ হাজার ১২০ কোটি টাকা। এরপর ২০১৮ সালে রেকর্ড ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকা পুনঃতফসিল করেছে ব্যাংকগুলো।
দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বিগত দিনে খেলাপি ঋণ নবায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও প্রচ্ছন্ন সাপোর্ট ছিল। কারণ, ব্যাংকগুলো চায় খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ না হোক। কারণ, খেলাপি ঋণ বেশি থাকলে ব্যাংকের বেশি হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। এতে কমে যায় আয়। সেই সাথে ব্যাংকগুলোর মানদণ্ডও খারাপ হয়ে যায়। এ কারণে নানা উপায়ে বছর শেষে ব্যাংকগুলো ঋণখেলাপিদের নানাভাবে ছাড় দিয়ে কিছু দিনের ব্যাংকের ব্যালান্সশিট ক্লিন রাখে। কিন্তু মাস তিনেক পরে ঠিকই তা প্রকাশ হয়ে যায়।
যেমন, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। কিন্তু মাত্র তিন মাসের মাথায় অর্থাৎ ডিসেম্বরে তা না বেড়ে বরং ৭ হাজার কোটি টাকা কমে ৯৩ হাজার কোটি টাকায় আসে। কিন্তু ব্যাংকগুলো থেকে পাওয়া তথ্য মতে, এ অবস্থা বেশি দিন ছিল না। মার্চে আবার ঠিকই বেড়ে যায় খেলাপি ঋণ। বিগত দিনে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ নিয়ে এমন লুকোচুরির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রচ্ছন্ন সায় ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক কখনো ডিসেম্বরের আগে খেলাপি ঋণ নবায়ন করার নীতিমালা শিথিল করেছে। আবার কখনো ঋণপুনর্গঠনের নামে বিশেষ ছাড় দেয়া হয়েছে। আবার কখনো ডাউনপেমেন্ট না নিয়েই ঋণ নবায়নের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
তবে, ডাউনপেমেন্ট না নিয়ে ঋণ নবায়নের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মৌখিক সম্মতি ছিল। এসব কারণেই খেলাপিরা বরাবরই ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। এতে ব্যাংকিং খাতের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনছে। যারা নিয়মিত গ্রাহক তারাও এ সুবিধা নিতে চাচ্ছেন। এভাবেই ব্যাংকিং খাতে ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা বেড়ে গেছে। কমে গেছে নগদ আদায়। এটা ব্যাংকিং খাতের জন্য মোটেও ভালো ফল বয়ে আনছে না। সাময়িকভাবে এতে স্বস্তি মিললেও দীর্ঘ মেয়াদে এর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে ওই কর্মকর্তা মনে করেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা