২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নগর সংস্কৃতির বৈশাখ

-

বাংলা নববর্ষের প্রথম মাস বৈশাখ। আবহমান বাংলার জনমানসের জীবনায়ন, মনমানসিকতা, আচার অনুষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পয়লা বৈশাখ জড়িয়ে আছে। বাংলা সন তথা বাংলা নববর্ষের দিন হিসেবে পয়লা বৈশাখ এসেছে সম্রাট আকবরের শাসনামল থেকে।
সম্রাট আকবর ৯৬৩ হিজরির ২ রবিউস সানি শুক্রবার ইংরেজি ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ এপ্রিল দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। সম্রাট আকবর তার অভিষেক দিবসকে স্মরণীয় করার লক্ষ্যে হিজরি সনের পরিবর্তে সৌরবর্ষ পালনের জন্য জ্যোতিষী আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীকে নির্দেশ দেন। সিরাজী সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে চন্দ্র মাসের সাথে সৌরমাসের সামঞ্জস্য এনে ৯৬৩ হিজরি সন থেকেই সৌরমাস গণনা রীতির প্রচলন করেন। অর্থাৎ ৯৬৩ হিজরি সন থেকে বাংলা নববর্ষ গণনায় বৈশাখ মাস স্বীকৃতি পায়।
চৈত্রের তাপদাহ শেষে প্রকৃতি যখন ধীরে ধীরে নিজেকে সাজাতে থাকে। পাতাঝরা ন্যাড়া গাছে সবুজ কিশলয়ের উপস্থিতি, ঈষাণ কোণে জড়ো হওয়া খণ্ড খণ্ড মেঘ, পুবের মাতাল হাওয়ার দোলা, গুরুগম্ভীর সবকিছু মিলেমিশে প্রকৃতি জানান দেয় বৈশাখ আসছে। শুরু হয় বৈশাখ বরণের প্রস্তুতি। নানা বর্ণে নানা সাজে নববর্ষের প্রথম দিনটি পয়লা বৈশাখ উদযাপন করে। জাতীয় জীবনে সার্বজনীন উৎসব হিসেবে পয়লা বৈশাখ পালিত হয়। এ যেন প্রাণের উৎসব, মিলন মেলার আনুষ্ঠানিকতার ঘাটতি নেই কোথাও। ইতঃপূর্বে গ্রামীণ জনপদকেন্দ্রিক নববর্ষ উদযাপিত হলেও আজকাল শহর, নগর সর্বত্রই নানাবিধ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নববর্ষ উদযাপিত হয়।
রাজধানী ঢাকার রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বৈশাখকে সাদরে বরণ করে নেয়া হয়। শিল্পীদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বরের মূর্ছনায় ধ্বনিত হয় আবাহনী সঙ্গীত এসো এসো। এসো হে বৈশাখ/এসো এসো তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষেরে দাও উড়ায়ে/বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।
অবশ্য রমনার বটমূল না অশ্বত্থ তলা এ নিয়ে যুক্তিতর্কের শেষ নেই। এ প্রসঙ্গে বলা যায়Ñ
‘বট’ শব্দের অর্থ ‘সংসদ বাঙ্গালা অভিধান’ মতে ‘সবৃহৎ ও দীর্ঘজীবী বৃক্ষবিশেষ।’ জ্ঞানেন্দ্র মোহন দাসের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’-এ [বট্ বেষ্টন করা) + অ (র্ত্তৃ), যে অধিক ভূভাগ আচ্ছাদন করে] তা ছাড়া ‘পঞ্চবটী’ শব্দের অর্থ প্রসঙ্গে [পঞ্চ (পাঁচ) বটের (বৃক্ষের) সমাহার-ঈ (স্ত্রীং), দ্বিগু] লিখে জ্ঞানেন্দ্রমোহন লিখেছেন, ‘অশ্বত্থ, বিল্ব, বট, ধাত্রী (আমলকী) ও অশোক বৃক্ষের বন।’ ফলে ‘বট’ যদি হয় বৃক্ষ, বিশেষ করে ‘অধিক ভূ-ভাগ আচ্ছাদন’ করা ‘সুবৃহৎ ও দীর্ঘজীবী’ তবে তো যাঁহা অশ্বত্থ তাহা বট।’
(বটমূলের নববর্ষ/সনজীদা খাতুন)
বটমূলের ছায়ানটের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি চারুকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের শোভাযাত্রা রঙ-বেরঙের মুখোশ পরে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা নগরবাসীর মনে ভিন্ন ব্যাঞ্জনায় বৈশাখ বরণের আয়োজন দেখি। এ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠন নানাবিধ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বৈশাখকে বরণ করে। জাতিধর্ম-নির্বিশেষে সবাই একত্রে মিলেমিশে ফেলে আসা অতীতের সব গ্লানি, হানাহানি দুঃখকষ্ট ভুলে গিয়ে আগামীকে বরণ করে নেয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে পয়লা বৈশাখ সার্বজনীন উৎসবে রূপ পায়।
বৈশাখী উৎসবের সাথে বৈশাখী মেলা যেন এক সূত্রে গাঁথা। বৈশাখী মেলা ছাড়া যেন বৈশাখের আয়োজন পূর্ণতা পায় না। শহরের বিভিন্ন স্থানে বাংলা একাডেমী, শিশু একাডেমী কিংবা ধানমন্ডি মাঠ এমনকি ফুটপাথজুড়ে মেলা বসে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আশা কামার-কুমার ছুতার সম্প্রদায় তাদের পসরা সাজিয়ে বসেন। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার ও চিত্তবিনোদনের উপযোগী সব সামগ্রী যেমন, কুলা, ডালা, তালপাতার হাতপাখা, হাঁড়ি-পাতিল, বঁটি/দা ইত্যাদি সাজিয়ে গুছিয়ে দোকানি তার দোকান সাজান। কিশোর-কিশোরীদের আকৃষ্ট করার জন্য মাটির তৈরি নানা রঙের পুতুল, হরিণ, মোরগ, ময়না, টিয়াসহ নানান ধরনের ফলÑ আম, কাঁঠাল, পেঁপে, পেয়ারা, বাঙ্গি দোকানের শ্রীবৃদ্ধি করে। কখনো কখনো ফলের উপরিভাগে পয়সা ফেলার ছিদ্র করে মাটির ব্যাংকের আদল দেয়া হয়। মুড়ি, মোয়া, বাতাসা, মুড়লিসহ নানারকম মুখরোচক খাবারের জিনিস নিয়ে দোকান সাজান কেউ কেউ। এ ছাড়া ঘরে তৈরি নানা ধরনের খাবারÑ খই, চিঁড়া, নাড়–, বাদ যায় না। ইট-পাথরের ইমারতঘেরা শহরে-শহরবাসী একদিনের জন্য হলেও ফিরে পান তার শৈশবের ফেলে আসা গ্রামের বৈশাখী মেলার হারানো দিন।
নববর্ষের উৎসব অনুষ্ঠানের মাঝে হালখাতা অন্যতম। গ্রামগঞ্জের মহাজনদের মতো শহরের অভিজাত বিপণিবিতানের মহাজনেরা লালসালু মোড়া জবেদা খাতা ব্যবহার না করলেও তারা নামী-দামি ক্রেতাদের ঠিকানায় নববর্ষের শুভেচ্ছা সংবলিত কার্ড পাঠান। মূলত হালখাতা হচ্ছে ক্রেতা-বিক্রেতার আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি লিপিবদ্ধ করা। অর্থাৎ পুরনো দিনের দেনা মিটিয়ে বছরের শুরুতে আবার নতুন করে হিসাব শুরু করা। যেন নতুন করে হৃদয়ের যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হওয়া।
বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে বৈশাখী মেলা বিশেষ তাৎপর্যবহ। ভোজনবিলাসী বাঙালির খাদ্যতালিকায় পয়লা বৈশাখের পান্তা-ইলিশ, ডাল-চর্চরি, কাসুন্দি মাখা কাঁচা আমভর্তা না হলে যেন বৈশাখী উৎসব অনেকটাই অপূর্ণ থেকে যায়। ঢাকা শহরের রমনা পার্ক থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন মহল্লায় একদিনের জন্য পান্তাভাত আর ভাজা ইলিশ মাছসহ খুদে দোকানিদের সরব উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। শুধু কি তাই; আগাম বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে শহরের নামকরা পাঁচতারা হোটেলের খাদ্যতালিকায় পয়লা বৈশাখের বাঙালির নানারকম খাবার পরিবেশন করা হয়।
এখানে পান্তা-ইলিশ নিয়ে খানিকটা ভিন্নমত রয়েছে। গ্রামেগঞ্জে বৈশাখ উদযাপনের খাদ্যতালিকায় সত্যি কি পান্তা-ইলিশের প্রচলন ছিল? এ নিয়ে যুক্তিতর্ক যাই থাক না কেন প্রসঙ্গ অনুযায়ী নিচের উদ্ধৃতাংশ প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি।
‘বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানে রাজধানীর রমনা বটমূলে বসে পান্তাভাতে ইলিশ ভাজি মেখে সংস্কৃতির উন্নয়নে যারা লোক দেখানো আচার অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তৃপ্তিবোধ করেন, তাদের জানান দিয়েই বলতে হয় পান্তাভাত ইলিশ ভাজি নতুন বাঙালিদের নবআবিষ্কার ভিন্ন আর কিছুই নয়। তাদের জানা উচিত, বৈশাখী নদীতে ইলিশ পাওয়া যায় না, বরং তারা যদি সরিষা-হলুদের কাসুন্দিতে কাঁচা আমের ভর্তায় ঝাল নুন দিয়ে জিহ্বা তাতাতেন তা হলে লাগসই হিসেবে বিষয়টিকে সহজ বিবেচনায় আনা যেত।’
(বাংলা নববর্ষ : আমাদের দায়/জাফর ইকবাল)
খাবারের পাশাপাশি ভালো থাকার বিষয়টিও যেন বৈশাখের অঙ্গীকার সেই সাথে ভালো পরার বিষয়টিকেও অস্বীকার করা যায় না। এর সাথে জড়িয়ে আছে নানা ধরনের লোকবিশ্বাস। নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি চ্যানেলগুলো দর্শকদের মনোতুষ্টি আর মনোরঞ্জনের কথা ভেবে নানা ধরনের অনুষ্ঠানমালা সাজিয়ে দর্শক আকৃষ্ট করার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালানÑ পাশাপাশি প্রিন্ট মিডিয়া অর্থাৎ জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। বিষয় বৈচিত্র্যের দিক থেকে প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প সেজে ওঠে ক্রোড়পত্রÑ যা কিনা পত্রিকা পাঠকের কাছে বাড়তি উপহার। তা ছাড়া পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে পুরনো ঢাকায় ঘুড়ি উড়ানোর উৎসবও চোখে পড়ে।
বাঙালি উৎসবপ্রিয় জাতি। প্রতিটি জাতির নিজস্ব একেকটি দিন থাকে, উৎসবমুখর দিন; যা একান্তই তার নিজস্ব। বাঙালির জীবনে পয়লা বৈশাখ তেমনি একটি দিন। আর বৈশাখী মেলা! সে তো প্রাণের মেলা। নগর সংস্কৃতির আবরণে বৈশাখকে উপস্থাপিত করতে চেয়েছি বৈশাখী মেলাকে প্রাণের মেলা হিসেবে উপলব্ধি করেছি। হ


আরো সংবাদ



premium cement
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে অংশীদার হওয়া উচিত : শি জিনপিং ওকাব সভাপতি নজরুল ইসলাম, সম্পাদক জুলহাস আলম পাবনায় ১০ কোটি টাকার অনিয়মে ৩ ব্যাংক কর্মকর্তা কারাগারে চুয়েট ১১ মে পর্যন্ত বন্ধ, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত নরসিংদীতে হিট স্ট্রোকে শিশুর মৃত্যু হিলিতে ভটভটি-মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে নিহত ২ ‘গাজার ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করতে ১৪ বছর লাগতে পারে’ সখীপুরে ছাগল চুরির মামলায় মা-ছেলে কারাগারে ‘অন্যায়ের সাথে নয়া দিগন্তের সাংবাদিকরা কখনোই আপোষ করেন না’ রাজশাহীতে হলে ঢুকতে না দেয়ায় রাস্তায় বিসিএস পরীক্ষার্থীর কান্না সালমান-শাকিবের পর এবার জয়কে টার্গেট!

সকল