২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্রিয় স্যার যেখানে ঘুমিয়ে আছেন

-

কী রে মনি, বাসায় এসেই কেমন মুখভার করে বসে আছিস! কী হয়েছে তোর?
জবাব না দিয়ে চুপ মেরে মনিকে বসে থাকতে দেখে মহিম আবারো বলল, কথা বলছিস না কেন? এত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে এলি যে, হাসপাতালে কোনো ঝক্কি-ঝামেলা হয়নি তো?
ডাক্তার আরাফাত রহমান মনি ডিএমসিএইচ-এর এমও, গ্রিন লাইফ হসপিটালে ওর চেম্বার। উদীয়মান সফল ডাক্তারদের মধ্যে ডাক্তার আরাফাত রহমানের সুনাম ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে। সার্জারিতে এফসিপিএস সম্পন্ন করেছে দুই বছর আগে। প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বেরোবার পর রাত ১১টার আগে বাসার ফেরা হয় না ওর। আজ সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরে কারও সাথে কথা না বলে বিষণœমনে বসে থাকতে দেখে পরিবারের সবার মনেই বিচিত্র দুশ্চিন্তার জন্ম দিচ্ছে!
অগ্রজ মাহবুবের একের পর এক প্রশ্নের মুখে কথা বলতে না দেখে সকলের মনের দুশ্চিন্তা আরো চাগিয়ে ওঠে। ওর পাশে বসে বারবার মাহবুব প্রশ্ন করেই যাচ্ছে, কী হয়েছে খুলে বল! মুখ খুলে না বললে, আমরা জানব কী করে তোর কী হয়েছে। তা ছাড়া তোর চোখে কখনো পানি দেখিনি! তোর চোখের টলমল অশ্রু দেখে আমরাও দুশ্চিন্তায় হাবুডুবু খাচ্ছি।
কিছুটা নড়েচড়ে বসল মনি, দীর্ঘশ্বাস বেরোল ওর বুকের গভীর থেকে, নাহ্! আমি ঠিক আছি। ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেখলাম, প্রিয় শিক্ষক মাজহারুল ইসলাম স্যার আর...
এটুকু বলেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল মনি! চমকে ওঠল মাহবুব, হায় হায়! বলিস কি!
হ্যাঁ, স্যারের ছেলে আশিককেও ফোন দিয়েছিলাম।
চোখের পানি মুছতে মুছতে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল মনি, এুনি কুমিল্লায় যাবো। শেষবার প্রিয় স্যারকে একবার দেখতে না পারলে, এই দুঃখটুকু মন থেকে কখনো যাবে না; সারাজীবন পুড়ে মারবে!
মাজহারুল ইসলাম স্যার ছিলেন সকল ছাত্রদের প্রিয় শিক্ষক। অত্যন্ত ভালো, সৎ সাদা মনের মানুষ। একজন আদর্শ শিক্ষকের সব গুণ বিকশিত ছিল তার মধ্যে। বাংলা ও ইতিহাসের শিক্ষক হলেও তিনি ছিলেন সর্ববিদ্যায় পণ্ডিত। ইংরেজি ও ধর্ম দর্শনে তিনি ছিলেন মহাগুরু। চাকরিকালীন হোমনা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের লাইব্রেরিটি ছিল তার দায়িত্বে। নিজে যেমন প্রচুর বই পড়তেন, তেমনি ছাত্রছাত্রীদেরও বইপড়া শিখিয়েছেন অত্যন্ত নৈপুণ্যের সাথে।
খবরটা পেয়েই হু হু করে কেঁদে উঠল মনি। ত্বরিত বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ল কুমিল্লার উদ্দেশে...
মাস দু-এক আগে স্যার হঠাৎ বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তার পিযোষ কুমার রায়ের তত্ত্বাবধানে ভর্তি করানো হয়েছিল গ্রিন লাইফ মেডিক্যাল কলেজ হসপিটালে। অগণিত ছাত্র ও শুভাকাক্সক্ষীরা স্যারের রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনামূলক সংবাদ প্রচার করেছে অনলাইন মাধ্যমে।
অনেকেই দেখতে গিয়েছিল তাকে। মনিও ছুটে গিয়েছিল প্রিয় স্যারকে দেখার জন্য। শয্যাশায়ী স্যারের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই মনির আগাপাছতলায় হিম কাঁপন জেগে ওঠে। পা ছুঁয়ে সালাম করার সময় চোখ মেলে মনির দিকে তাকিয়ে স্যার বলেছিলেনÑ মনি, তুমি কখন এসেছ?
অশ্রুভেজা অবাক চাহনিতে তাকিয়ে রইল মনি। অন্তত বিশ বছর পর স্যারের সাথে দেখা। স্যার কী করে চিনলেন! মনিকে কিছু বলার আগেই স্যার বললেন, মাহবুব, মাহিন ওরা সবাই কেমন আছে?
অল্পদিন গ্রিন লাইফ হসপিটালে চিকিৎসার পর স্যারকে রিলিজ দিয়ে দেন ডাক্তার। বেশ কিছু দিন ডাক্তারি ব্যবস্থানুযায়ী ওষুধ সেবনের পরও রোগমুক্তির সম্ভাবনা না দেখে স্যারকে নিয়ে ভর্তি করালেন বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। বার্ধক্যজনিত রোগ স্যারকে এতটাই ন্যুব্জ করে ফেলেছে যে, দিন দিন অবনতির দিকে নিয়ে গেল তার জীবন।
মাজহারুল ইসলাম স্যার ছিলেন সব ছাত্রদের প্রিয় শিক্ষকদের মাঝেও প্রিয়। মনি তখন নবম শ্রেণীর ছাত্র। তার সাথে ওর আরো দুই ভাই একই স্কুলে বিভিন্ন শ্রেণীতে পড়ত। প্রতি বছরের মতো সেবার উপজেলাব্যাপী ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক রচনা প্রতিযোগিতায় একটা অকল্পনীয় ঘটনা ঘটেছিল, যা পুরো উপজেলাজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। রচনার বিষয়বস্তু নির্ধারণ হয়েছিল প্রিয় শিক্ষক।
‘প্রিয় শিক্ষক’ বিষয়ক রচনা লিখতে গিয়ে হোমনা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সব ছাত্ররাই লিখেছিল মাজহারুল ইসলাম স্যারের জীবনবৃত্তান্ত। বহু আলোচনা ও পর্যালোচনার পর আমিই ওই প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলাম। সকলেই জেনে গেল মাজহারুল ইসলাম স্যার প্রিয় শিক্ষকদের মাঝে সবচেয়ে প্রিয়। তার এমন প্রিয় হয়ে ওঠার জন্য কিছুটা মূল্যও দিতে হয়েছিল স্যারকে। বেশ কয়েকজন শিক্ষক স্যারের পেছনে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। স্যারকে বদলি করার জন্য বহু চেষ্টাই অবশেষে ব্যর্থ হয়েছিল। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি সকলের প্রিয় হয়েই হোমনা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকেই অবসর গ্রহণ করেছিলেন।
দুপরের পর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রচণ্ড যানজট। জ্যামে বসেই অতিবাহিত করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মেঘনা ব্রিজের টোল কাউন্টারে এসে রাস্তায় যানজট দেখে অস্থির হয়ে ওঠল মনি, না জানি প্রিয় স্যারের সাথে শেষ দেখাটা হয় কি না! এমন আশঙ্কায় ডুবে গাড়ি থেকে নেমে গেল মনি। ড্রাইভারকে বিদায় করে দিয়ে সে নৌপথে হোমনা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
মেঘনা লঞ্চঘাট থেকে যন্ত্রচালিত নৌকা (ট্রলার) নিয়ে মেঘনা থানার রামপুরে এসে নেমে গেল মনি। রামপুর থেকে সিএনটি অটোরিকশায় চড়ে সোজা স্যারের গ্রামের বাড়ি জয়পুরে গিয়ে উপস্থিত হয়।
সন্ধ্যা হয় হয় অবস্থা! প্রকৃতিজুড়ে স্তব্ধ মলিনতা! ঘনায়মান সন্ধ্যার আঁধারে শূন্য হা-হাকার হু হু করে কেঁদে ওঠছে! স্যারের কনিষ্ঠ ছেলে আশিকের কান্নার করুণ ধ্বনিতে চার দিকে মাতমের ঢেউ উঠছে। চার ধারের হায় হায় করুণ দীর্ঘশ্বাসে একটি করুণ আওয়াজ সরবে জেগে ওঠছেÑ একজন বড় ভালো মানুষ বিদায় হয়ে গেল, জ্বলন্ত একটি প্রদীপ নিভে গেল...
স্যারের জীবনটা সবদিক থেকেই স্বার্থক। দারিদ্র্যতার শেকলবন্দি হয়ে স্যারের শৈশব ও ছাত্রজীবন অতিবাহিত হলেও কর্মজীবন এবং অবসরকালে বেশ সুখেই অতিবাহিত করে গেছেন। তিন ছেলে এবং তিন মেয়ের সবাই উচ্চ শিক্ষিত। তবে ওদের মধ্যে বড় ছেলে মুসাফির তরুণ গীতিকার এবং সাহিত্যিক।
সন্ধ্যার পর থেকে মানুষের স্রোতে ভেসে বেড়াতে থাকল জয়পুর গ্রাম। গ্রামের লোকজন স্তব্ধ, হতবাক! এমন অন্ধকার রাতে এত মানুষ কোত্থেকে আসছে প্রিয় স্যারকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে!
জয়পুর শাহী ঈদগাহ ময়দান মুহূর্তেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল। কয়েক উপজেলার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা কর্তৃক স্যারের কর্মময় জীবনের স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে রাত গভীর হতে থাকল শোকাহত কান্নার মধ্য দিয়ে।
আকাশের তারাগুলোও আজ অশ্রুসিক্ত হয়ে মলিন আলোতে কাঁদছে! আকাশের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে পেঁজা পেঁজা মেঘরাশি নিঃশব্দে কেঁদে কেঁদে উত্তরাকাশে জড়ো হয়ে কাঁদছে ভাইবোনদের একসাথে গলাগলি করে কান্নার মতো! বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই, তবুও আকাশের বুকে কতই না কান্নার বিজলি-বিচ্ছুরণ...!
তিতাস নদী থেকে একটি চিকন খাল স্যারের বাড়ির সামনে দিয়ে মৃদু স্রোতের জলরাশি বুকে নিয়ে চলে গেছে পশ্চিম দিকে। ওই খালের পাড়ে স্যারের পারিবারিক গোরস্থান। স্যার স্বহস্তে এই গোরস্থানটির পরিচর্যা করে গেছেন যতেœর সহিত। স্যারের ভাবুক ছেলে মুসাফির এক যুগ আগে একটি অশ্বথ গাছ রোপণ করেছিলেন এখানে এসে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করবেন ভেবে। গাছটি বেশ বড় হয়ে ওঠেছে, চার দিকে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে মহীরুহে পরিণত হয়েছে।
এই অশ্বথ গাছটির ছায়াতলে স্যারকে যখন নিয়ে যাওয়া হলো তখনই প্রকৃতির বুকে শোকার্ত কান্নার গীত বেজে ওঠতে থাকল গোপনে নীরবে...! ঘনায়মান অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েই আলোকিত মানুষটিকে শায়িত করা হলো গোরের বিছানায়! অমনি অদেখা আলো ছড়িয়ে পড়তে থাকল চারদিকে... হ

 


আরো সংবাদ



premium cement
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে অংশীদার হওয়া উচিত : শি জিনপিং ওকাব সভাপতি নজরুল ইসলাম, সম্পাদক জুলহাস আলম পাবনায় ১০ কোটি টাকার অনিয়মে ৩ ব্যাংক কর্মকর্তা কারাগারে চুয়েট ১১ মে পর্যন্ত বন্ধ, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত নরসিংদীতে হিট স্ট্রোকে শিশুর মৃত্যু হিলিতে ভটভটি-মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে নিহত ২ ‘গাজার ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করতে ১৪ বছর লাগতে পারে’ সখীপুরে ছাগল চুরির মামলায় মা-ছেলে কারাগারে ‘অন্যায়ের সাথে নয়া দিগন্তের সাংবাদিকরা কখনোই আপোষ করেন না’ রাজশাহীতে হলে ঢুকতে না দেয়ায় রাস্তায় বিসিএস পরীক্ষার্থীর কান্না সালমান-শাকিবের পর এবার জয়কে টার্গেট!

সকল