০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


একজন মুক্তিযোদ্ধা

-

স্কুলে বিজয় দিবসের আনন্দ আনুষ্ঠান চলছে, মাঠের এক পাশে বসে আছে আসমা। ও মতিন পাগলার মেয়ে। প্রতি বছর বাবার সাথেই আসত। এবার তিনি আসতে পারেননি। বয়স হয়েছে বলে আসতে পারেননি।
দেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় অর্ধশত বছর হয়ে গেল। স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা তরুণ যুবক ছিল, তারা আজ বার্ধক্যে পৌঁছেছে। যারা মধ্য বয়সী তারা প্রায় অনেকেই নেই। অনেকের সাথে অস্ত্র হাতে ছুটে গেছেন তিনি দেশকে শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করতে। বয়স এখন পঁচাত্তর থেকে সাতাত্তরের মতো। তার বয়সী অনেকেই বেঁচে নেই। অনেকের বয়স হয়েছে, অনেক বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগেছেন। এখন তাদের সময় কাটে ঘরের কোনায় থেকে যুদ্ধের স্মৃতি মনে করে।
প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর মতিন গ্রামে যান। মতিনকে দেখলেই অনেকেই বলে ওঠেনÑ
Ñওই যে মতিন পাগলা এসেছে।
তিনি এ নিয়ে কাউকেই বকা দেন না। স্কুলের মাঠে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান হয়। সবার আগে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়। সবাই দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গান, মতিন ও সবার সাথে গান। সেবার মতিনের পাশে দাঁড়িয়েছিল ছোট মেয়ে আসমা। বাবার জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া দেখে আসমা হা করে তাকিয়ে থাকে।
বিশেষ অতিথি প্রধান অতিথি বক্তৃতা দেয়। গ্রামের অনেকেই যুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে কথা বলেন। মতিন স্টেজে যান। মতিনের কথা যেন ফুরাতেই চায় না। কিন্তু একজন এত সময় বললে অন্যরা বলবেন কী? তাই মতিন কিছুক্ষণ বলে স্টেজ থেকে নেমে আসেন। দেশাত্মবোধক গান হয়। মুক্তিযুদ্ধের নাটক হয়। অনুষ্ঠান শেষে সবাই নিজ নিজ বাড়ি ফিরে যান। আসমা ওর বাবাকে প্রশ্ন করে,
Ñআচ্ছা বাবা সবাই তোমাকে মতিন পাগলা বলে কেনো?
Ñডাকটা শুনতে কি তোর খুব খারাপ লাগে রে মা?
Ñনা বাবা, আমি জানি এটা শুধু ডাক নয়। এই ডাকটার অনেক গল্প আছে।
Ñঠিক বলেছিস মা। এই ডাকটাই যে আমার সোনার বাংলা। এই ডাকটাই যে স্বাধীন আমার মাতৃভূমি। এই ডাকটাই যে স্বাধীনতা। শুধু আমার নয়, আমাদের সবার।
Ñআমি সেই কথাগুলোই শুনতে চাই। কে তোমায় এ নাম দিয়েছে তা শুনতে চাই।
এই বলেই আসমা ওর বয়সী সবাইকে ডেকে নেয়। স্কুলের পুকুর পাড়টা পাকা করা, ধাপে ধাপে সিঁড়িগুলো। আসমা আর ওর সাথের সবাই সিঁড়িতে লাইন করে বসে। আর মাঝখানে বসায় বাবাকে। মতিন বলেন তাহলে শুনো সেই গল্পÑ
১৯৭১ সালের মার্চ মাস। দেশের অবস্থা খুবই খারাপ। আমি তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় চাকরি করি। ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাইরে যারা তাদের চেয়ে আমরা ভেতরের খবর বেশি জানি। পাকিস্তান থেকে অনেক সৈন্য এসে গেছে। আমরা বুঝে যাই যুদ্ধ ঠিক হবেই। পাক সেনারা আমাদের নজরবন্দি করল। ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। আমার সাথে ছিল পাঠান বন্ধু মুর্তোজা। ওর সাহায্যে ১৭ মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় পাক সেনাদের নজরবন্দি থেকে পালাতে সক্ষম হই। সাথে নিই নিজের এসএমজি (চাইনিজ) হাতিয়ার। সেদিন সোজা চলে যাই আওয়ামী লীগের দলীয় অফিসে। সেখানে গিয়ে শুনি আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। মিলাদ মাহফিল হচ্ছে, দোয়া পড়ছেন মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ। তর্কবাগীশ ছিলেন কৃষক লীগের সভাপতি। মিলাদের পর তাজউদ্দীন আহমদের সাথে কথা হয়। সেদিনই প্রথম দেখা হয় বঙ্গবন্ধুর সাথে। তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই। তারপর বলি, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের এক ডিভিশন সৈন্য থাকার কথা, তার মাঝে ইতিমধ্যে ৩৩ হাজারের বেশি পাকসৈন্য চলে এসেছে। আমরা এখন কি করব।’
বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি যা বলার তা ৭ মার্চের ভাষণে বলে দিয়েছি।’
১৭ মার্চ রাতেই আমি ট্রেনে নোয়াখালীর পথে রওনা দিই। ১৮ মার্চ বাড়ি যাই। বাড়ি গিয়ে আমার প্রিয় স্কুল (কামালপুর মো: হাসেম উচ্চ বিদ্যালয়, চাটখিল, নোয়াখালী) আসি। স্কুলের নবম দশম শ্রেণীর ছাত্রদের এক করি। নিজের হাতের সেই অস্ত্র দিয়েই খশরু, আবু তাহের, সফিক, কিবরিয়াসহ অন্যদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় ২৬ মার্চ থেকে। এর আগেই আমার এমন ট্রেনিং দেয়া দেখে সবাই আমাকে পাগল বলতে শুরু করে। গ্রামের সবাই ভেবেছে আমি পাগল হয়েই অস্ত্র নিয়ে পালিয়েছি।
২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে পাক সেনারা আমাদের বাঙালিদের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। সবাই বুঝতে পারে আমি পাগল নই, আসলেই আমি জানতাম যুদ্ধ শুরু হচ্ছে। সেই যে সবাই আমাকে মতিন পাগলা ডাকা শুরু করল আর থামেনি। ২৬ মার্চ রামগঞ্জ থানায় গিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি হাবিব ভাইয়ের নেতৃত্বে রামগঞ্জ থানার অস্ত্র লুট করি। (৩৬টি রাইফেল, ৩টি এলএমজি, দুই লাখ ৩.৩ গুলি, ৩টি রিভলবার) এ সময় রামগঞ্জ থানার অধীনে ছুটিতে আসা সেনাবাহিনী, নেভী, এয়ারফোর্স, আনসার, পুলিশ সবাইকে জড়ো করে এক প্লাটুন সৈন্য গঠন করি। এভাবেই তিনি স্মৃতিচারণ করে চলেন।


আরো সংবাদ



premium cement