পাঠশালা ভার্চুয়াল থেকে বাস্তবে : জীবনের বাঁকে বাঁকে
- আরাফাত শাহীন
- ০৩ মার্চ ২০১৯, ০০:০০
গত বছরের প্রথম দিকে কেউ একজন ফেসবুকে আমাকে পাঠশালা নামক একটি গ্রুপের সাথে যুক্ত করে দিয়েছিলেন। এমন কাজটি ঠিক কে করেছিলেন তা একদমই মনে রাখিনি। তার অবশ্য কারণও আছে। প্রতিদিন ফেসবুকে এমন নিত্য নতুন গ্রুপের সাথে মানুষ যুক্ত করে, আবার আমি নিজ উদ্যোগেই এসব গ্রুপ থেকে বের হয়ে আসি। কারণ বেশির ভাগ গ্রুপেই শিক্ষার তেমন কিছুই থাকে না; বরং কিছু বিকৃত রুচির মানুষ এখানে নিজেদের বিকৃত রুচির পরিচয় দিয়ে থাকে। কোনো একটা কারণে পাঠশালা গ্রুপটিকে আমার ভালো লেগে যায়। আমি গ্রুপ থেকে বের না হয়ে বরং সেখানে লিখতে থাকি। অন্য ফেসবুক গ্রুপগুলোর মতো এটাকে মনে হয়নি একদমই। আমার মনে হলো, এখানে যারা কাজ করেন তারা সমাজের শিক্ষিত এবং রুচিবোধসম্পন্ন মানুষ। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে আমি এই গ্রুপটির সাথে যুক্ত আছি। একটিবারের জন্যও আমার এ চিন্তার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
আমি আসলে বলছিলাম ফেসবুক গ্রুপ ‘পাঠশালা- ঈবহঃৎব ভড়ৎ ইধংরপ ংঃঁফরবং’-এর কথা। নামের মধ্যেই একটা শিক্ষা শিক্ষা গন্ধ রয়েছে। বাস্তবে এসেও প্রতিটা মুহূর্তে এর প্রমাণ পেয়েছি। এই গ্রুপটার প্রতিষ্ঠাতা এবং মূল কর্ণধার মো: শাহাদত হোসেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি একজন বিচারক এবং বগুড়ার যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও রুচিবোধসম্পন্ন এই মানুষটি একটি বিশাল স্বপ্ন নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। আগেই বলেছি, আর দশটা ফেসবুক গ্রুপের সাথে এর তুলনা করলে চলবে না। মানুষ এখন ভার্চুয়াল জগতে অনেকটা সময় ব্যয় করছে। এখন তারা যদি এই সময়টাকে শিক্ষার সাথে থেকে পার করতে পারে, তাহলে সেটাই তো লাভের।
প্রতি বছর বইমেলাতে পাঠশালার সদস্যরা মিলিত হন। আমি যেহেতু আগে থেকে তাদের সাথে যুক্ত ছিলাম না, তাই বিগত বইমেলাগুলোতে তাদের সাথে একত্রিত হতে পারিনি। তবে এবারে আগে থেকেই পরিকল্পনা করে আমরা একত্রিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সেই মোতাবেক প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঐতিহ্য প্রকাশনীর সামনে আমাদের আড্ডা হতো। এর আগে পাঠশালার কোনো সদস্যের সাথে সেভাবে আমার পরিচয় হয়নি। মেলায় প্রবেশ করে আমি প্রথমেই ঐতিহ্যের সামনে গিয়ে হাজির হলাম। শাহাদত স্যার আমাকে দেখে দূর থেকে এসে বুকে টেনে নিলেন। আমার মনে হলো, আমি যেন তার আপন ভাই! অথচ এটাই আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ!
শুধু শাহাদত স্যার একা নন, পাঠশালার সব সদস্যই আমাকে পরম মমতায় বুকে টেনে নিয়েছেন। প্রথমবার বইমেলায় গিয়ে এবং সবার সাথে প্রথম সাক্ষাতে এভাবে যে ভালোবাসার ঝুলি উপহার পাব কল্পনাও করতে পারিনি। আমি অভিভূত হয়েছি পাঠশালার সদস্যদের আন্তরিকতা এবং নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা দেখে। ফেসবুকে লক্ষ-কোটি গ্রুপ রয়েছে, যারা ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে থাকে। আর কারো মধ্যে তো এমন হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক দেখিনি! বলা হয়ে থাকে, ফেসবুক আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং মানুষের কাছ থেকে মানুষকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। পাঠশালার সদস্যদের সাথে মিলিত হওয়ার পর আমার একবারের জন্যও এমনটা মনে হয়নি।
পাঠশালার সদস্যদের ক্ষেত্রে এমনটা হওয়ার কারণ কী? এর প্রকৃত কারণ হলো, পাঠশালার সদস্যদের চিন্তাশীলতা এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা। শাহাদত স্যার সবার মাঝে এ চিন্তার বীজ বপন করে দিয়েছেন। পাঠশালার সদস্যরা পঠন-পাঠনের দিকে প্রথম থেকেই সর্বোচ্চ পরিমাণ মনোযোগ দিয়ে আসছেন। গভীর পড়ালেখা ব্যতীত নিজের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার আর কোনো উপায় নেই। প্রতি মাসে পাঠশালা থেকে এর সদস্যদের জন্য তিন-চারটি বই পড়ার জন্য নির্ধারিত করে দেয়া হয় এবং পড়া শেষ করে ওই বইগুলোর ওপর পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখতে উৎসাহিত করা হয়। আরেকটি কথা, প্রতি মাসে পাঠশালা গ্রুপে যে লেখাগুলো জমা হয়, সেখান থেকে বেশ কয়েকটি ক্যাটাগরি ভাগ করে প্রত্যেক ক্যাটাগরিতে তিনজনকে পুরস্কার দেয়া হয়। আর পুরস্কার হিসেবে সবার ঠিকানায় পৌঁছে যায় মহামূল্যবান বই। এবং এই বইগুলো হয় বাংলা এবং বিশ্বসাহিত্যের বাছাই করা শ্রেষ্ঠ বই।
পাঠশালার প্রধান লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি হলোÑ একটি শিক্ষিত, দক্ষ এবং প্রাণবন্ত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা। স্যার আমাকে ডেকে বললেন, শাহীন প্রস্তুত হও। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা পাঠচক্র চালু করব। তোমাকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করব। এভাবে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি একটি পাঠকশ্রেণী গড়ে তোলা যায়, সেটা দেশের জন্যই মঙ্গলজনক বলে বিবেচিত হবে। পাঠশালার সদস্যরা কি শুধু বই পড়েই সময় পার করেন, নাকি সমাজ ও দেশ নিয়েও চিন্তাভাবনা করেন? হ্যাঁ, দেশের প্রতিও আমাদের দায়বদ্ধতা অনেক। স্যার বললেন, শুধু নিজের ভালো চিন্তা করলে চলবে না? সমাজে যেসব বঞ্চিত শিশুরা রয়েছে, তাদের নিয়েও ভাবতে হবে। আমি চিন্তা করেছিÑ বগুড়াতে পথশিশুদের জন্য একটা স্কুল চালু করব। এখানে আমার পাশাপাশি পাঠশালার সদস্যরাও এসে ক্লাস করাবেন।
কী মহৎ একটা পরিকল্পনা! এভাবে পাঠশালার প্রতিটি সদস্যই সমাজ ও দেশকে নিয়ে গভীরভাবে ভেবে থাকেন। সবার চিন্তাভাবনা এক বিন্দুতে এসে মিলিত হতে পেরেছে বলেই তো বাস্তবেও সবাই একত্র হতে পেরেছেন! আমি পাঁচ দিন বইমেলায় গিয়েছি। প্রতিদিনই গিয়ে পাঠশালার সদস্যদের সাথে আড্ডা দিয়েছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় পার করেছি, তাদের সাথে। একটুও বিরক্তি লাগেনি কখনো, বরং প্রতিটা মুহূর্তে সমৃদ্ধ হয়েছে আমার জ্ঞান। আমি বিশ্বাস করি, যে মহৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পাঠশালা পরিবারÑ তা একদিন সফল হবেই।
দেশের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সব সদস্য যদি দেশের উন্নতির জন্য কাজ করতে পারেন, তাহলে একদিন তা মহীরুহ হয়ে দেশের সার্বিক উন্নতি ঘটিয়ে দিতে পারে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশ হয়তো পাঠশালার হাত ধরেই একদিন সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা