১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলকদ ১৪৪৫
`


কিছু কথা কিছু ব্যথা : জীবনের বাঁকে বাঁকে

-

ডায়েরি লিখি, এ স্বভাব আমার বেশ পুরনো। মধ্যরাতে যখন একাকী ক্ষণ আসে, তখন কলম ধরে ডায়েরি খুলি। লিখে যাই দৈনন্দিন জীবনের ঘটনামালা। বছর শেষে সেসব লেখার কিছু ঘটনা মনের ভেতরে বিশেষ জায়গা দখল করে নেয়। ডায়েরির পাতা থেকে কিছু কথা, আর কিছু ব্যথা জাগানিয়া ঘটনা তুলে ধরলাম।
৩.১.২০১৮
নোয়াখালীর গাঁও-গেরামে সাধারণত বাঘ-হাতি দেখা যায় না। আজ আমিশাপাড়া বাজারে হাতি এসেছে। হাতির মালিক বাজারের প্রতিটি দোকান থেকে ১০ টাকা করে চাঁদা নিচ্ছেন। বিক্রেতারা ১০ টাকা দিলেই হাতি তার শুঁড় দিয়ে টাকা গ্রহণ করে। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে ছেলে-বুড়ো সবার চোখে রাজ্যের বিস্ময়। সেই সুদূর শৈশবে ঢাকার চিড়িয়াখানায় হাতি দেখে আমারও চোখে এমন বিস্ময় ফুটেছিল। কত দিন ঢাকার চিড়িয়াখানায় যাই না। শুনেছি চিড়িয়াখানায় নাকি পশুপাখির সংখ্যা দিন দিন কমছে!
৯.৩.২০১৮
রাবেয়া আন্টিকে আমার বিশেষ পছন্দ। প্রথমত, তিনি মায়ের বয়সের। দ্বিতীয়ত, তিনি সুশিক্ষিত। তৃতীয়ত, তিনি সব সময় আমার খোঁজখবর রাখেন। রাবেয়া আন্টির সাথে ফেসবুকে পরিচয়। দুই বছর আগের কথা সেটি অবশ্য। বাড়ি চট্টগ্রামে। হঠাৎ করে রাবেয়া আন্টি ফেসবুক থেকে উধাও হয়ে গেলেন। সেভাবে মিস করিনি, এমন কি তার প্রোফাইলেও যাওয়া হয়নি। আজ আমার পুরনো এক ছবিতে রাবেয়া আন্টির লাইক দেখে তার প্রোফাইলে ঢুকলাম। তিনি যে তার সব ছবি ফেসবুক থেকে মুছে ফেলেছেন, সেটি চোখে লাগল আমার। রাবেয়া আন্টিকে মেসেজ দিলাম, ‘কতদিন পর।’ সিন হলো। রিপ্লাই এলো না। আবার মেসেজ দিলাম, ‘কতকাল দেখি না।’ সিন হলো। এবারও রিপ্লাই এলো না। সন্ধ্যায় রাবেয়া আন্টির মেসেজ, ‘আমাকে দেখবি?’ ছোট্ট করে লিখলাম, ‘হ্যাঁ।’ তারপর ইনবক্সে রাবেয়া আন্টির যে ছবি এলো, দেখে চমকে উঠে। এ কার ছবি! রাবেয়া আন্টির! বিশ্বাস হচ্ছে না।
রাবেয়া আন্টি লিখলেন, ‘আমার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। কেমোথেরাপি আমার এ অবস্থা করেছে। আমার জন্য দোয়া করো বাবা।’ আমি ভেঙে পড়লাম। আমি লক্ষ করেছি, আমার পৃথিবীর অনেক সৌন্দর্য হঠাৎ করেই নষ্ট হয়ে যায়।
২৮.৪.২০১৮
জেলা সদর মাইজদির প্রাইম হসপিটালে আজ এসেছি নানীজানকে দেখতে। ক্যান্সারে আক্রান্ত নানীজানকে এখানের ৫০৭ নম্বর কেবিনে আনা হয়েছে আরোগ্য লাভের আশায়।
হাসপাতাল। খুব নির্মম একটি জায়গার নাম। এ হাসপাতালের প্রতি আমার চরম রাগ। ২০০১ সালে রোগমুক্তির দুর্দান্ত আশা নিয়ে আম্মা এখানে এসে চুপচাপ মারা গেলেন। সেই থেকে হাসপাতালের প্রতি আমার ভীষণ অভিমান। ২০০১ থেকে ২০১৮, জীবনের এই দীর্ঘ সময়জুড়ে কখনো কোনো হাসপাতালের করিডোর মাড়াইনি আমি। আজ এই হাসপাতালে এসে দেখি আমার চিরদিনের স্বাস্থ্যবতী পরিশ্রমী নানীজান ক্যান্সারের কাছে বলি হতে হতে কঙ্কালসার দেহ নিয়ে শুয়ে আছেন ৫০৭ নম্বর কেবিনের বেডে। শরীরের কী এক করুণ দশা তার। মধ্যবিত্ত পরিবারের বউ হয়ে আসা আমার সংসারী নানীজানকে সারাজীবন দেখেছি সংসারের কঠিন সব কাজে নিবেদিত থাকতে। নানাবাড়ির দুপুরগুলোতে দেখতামÑ তিনি রসইঘরের চুলোর ধারে বসে আগুন আর ধোঁয়ার সাথে যুদ্ধ করে ভাতÑতরকারি রান্না করতেন ছেলেমেয়েদের জন্য। আমার আম্মা, মানে তার বড় মেয়ের আকস্মিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নানীজান চিরতরে হয়ে উঠলেন কান্নাবতী।
৩.১১.২০১৮
মেডিসিন ব্যবসা থাকার সুবাদে আমাদের ঘরে সবসময় বিভিন্ন ওষুধ-বড়ি পাওয়া যাবে, এ ধারণা পুরো মহল্লাজুড়ে। দেড় ঘণ্টা আগে এ মহল্লার উঠতি বয়সের ছেলে রোমান এলো আমাদের বাড়ি। দরজা খুলে দিলাম। অস্থির কণ্ঠে বললÑ ‘ভাইয়া, হার্টের ওষুধ আছে? আম্মুর হার্টের পেইন উঠেছে। নিডোকার্ড থাকলে ভালো হয়।’ আব্বাকে ঘটনাটা খুলে বললাম। আব্বা তার ওষুধের ঝুড়িতে নিডোকার্ড পেলেন না, পেলেন ক্লপিড নামক হার্টের ট্যাবলেট। বের করে দিলেন। রোমান স্বস্তির দম ফেলে ক্লপিড নিয়ে চলে গেল। আমি রোমানের চলে যাওয়া দেখলাম। মায়ের সেবা করা রোমান ক্লপিড নিয়ে দ্রুত চলে গেল। মায়ের রোগমুক্তির জন্য ওর দ্রুত চলে যাওয়া এক অপূর্ব দৃশ্য হয়ে ধরা দিলো আমার চোখে।
এখন অনেক রাত। জানি না নিডোকার্ড সেবন করা রোমানের মা ক্লপিড খেয়ে কতটুকু সুস্থ হলেন। নাকি হার্টের পেইন আরো বেড়েছে। এসব যতই ভাবছি, ততই রোমানের অচেনা মায়ের জন্য টান অনুভব হচ্ছে। রোমানের ফোন নম্বর থাকলে ভালো হতো। কল করে খবরটি নেয়া যেত।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী


আরো সংবাদ



premium cement