২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

একটি দুর্ঘটনা : জীবনের বাঁকে বাঁকে

-

পাকা রাস্তায় উঠতেই মোটরসাইকেলে একজন বলে গেল, সামনের মোড়ে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, জিয়া মারা গেছে। আমি হতভম্ব হয়ে ছুটে গেলাম। বেশি দূরে নয়, কয়েক সেকেন্ডের রাস্তা। আমি গিয়ে দেখলাম এক ভয়ানক দৃশ্য। ইজিবাইক ও মালবোঝাই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ। একদম দুমড়ে-মুচড়ে গেছে ইজিবাইক। টেনেহিঁচড়ে ইজিবাইকের মানুষগুলোকে বের করল ওই মোড়েই দোকানদার আসাদ ভাই, ছোট ভাই জান্নাত ও রনি। ইজিবাইকে দুটি শিশুও ছিল। একজন আড়াই মাসের আরেকজন দুই বছর বয়সী হবে। ইজিবাইকের ড্রাইভারসহ সব যাত্রী গুরুতর আহত। মহিলাসহ শিশুদের নিয়ে যাওয়া হলো পাশের বাড়িতে। আর একজনকে টেনে রাস্তার নিচেই নামানো হলো। তার পুরো শরীরের ততক্ষণে রক্তের নদী বইছে। ইজিবাইকসহ রাস্তায় তার রক্তের স্রোত। দু’জনে ধরে উঁচু করতেই মারে-বাবারে বলে চিৎকার দিয়ে উঠল। উঠবেই বা না কেন। তার দুই হাত ভেঙে চামড়া ভেদ করে হাড় বাইরে বেরিয়ে গেছে। মাথায় ইজিবাইকের কোনো একটা রড এসে বিঁধে গেছে খানিকটা। তাগড়া জোয়ান। মোটাসোটা দেহ। রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হচ্ছে। আশপাশে সাড়া পড়ে গেলে মানুষ বিদ্যুৎ গতিতে এসে জড়ো হতে লাগল। পরে বুঝলাম যে মানুষটা মোটরসাইকেলে আমাকে বলেছিল সে-ই সবাইকে খবর দিছে। ঘটনা গঙ্গারামপুর গালর্স স্কুলের সামনের। মনোখালী তথা সিঙিয়া বাজার থেকেও মানুষ চলে এসেছে ততক্ষণ। আর গঙ্গারামপুর বাজারের মানুষসহ অনেক দোকানদারও ছুটে এসেছেন। মানুষ আর মানুষ। আমি বাড়ির ভেতরে গেলাম। একটা মহিলা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে সিঁড়িতে। আর একজন চিৎকার দিয়ে কান্নাকাটি করছেনÑ আর আমার মনি, আরে আমার মনি রে বলে হৃদয়ফাঁটা কান্নাকাটি করছেন। আমি বুঝতে পারলাম ওই আড়াই মাসের শিশুটার মা এই মহিলা। আর উঠানের মাঝখানে একটা মহিলা সেই আড়াই মাসের শিশুটিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পরীর বাচ্চার মতো সুন্দর একটা নিষ্পাপ মুখ। সবাই বলছে মারা গেছে। মাথায় আঘাত লেগে ছোট্ট মাথাটা খানিকটা চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। আর নাক-কান দিয়ে রক্ত বের হয়ে গেছে। শুভ দাদা শিশুটির হাত ধরে বলে উঠলÑ এখনো আছে। শিশুটিকে নিয়ে কয়েকজন দৌড়াল বাজারে। আহা! কী হৃদয়বিদারক দৃশ্যের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হচ্ছি আমি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে খুঁজতে লাগলাম আরো একটা মানুষকে যাকে টেনেহিঁচড়ে বের করতে দেখেছিলাম ইজিবাইক থেকে। মানুষের ভিড়ে গিয়ে পেলাম আসাদ ভাইয়ের দোকানের সামনে টানটান শুয়ে রয়েছে আমাদের বয়সী একজন মানুষ। তার কোথাও কাটেনি, ভাঙেও নি, কিন্তু বুকে বড্ড আঘাত পেয়েছেন। যার দরুণ নিশ্বাস নিতে পারছেন না ঠিকভাবে। আর তাই তো ছটফট করছেন আর বুক ডলছেন। কথা বের হচ্ছে না তবুও কথা বলার চেষ্টা করছেন বেচারি। আবছা আবছা কথার মাঝে বুঝতে পারলাম তিনি বলছেন, আমার সন্তানের কী অবস্থা? আমি কাউকেই কিছু বলতে পারছি না। কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছি না। এর আগেও আমি অনেক দুর্ঘটনা দেখেছি। কিন্তু সেগুলো ঘটার পরবর্তী অবস্থার সাক্ষী হয়েছি আমি, কিন্তু এই প্রথমবার চোখের সামনে দেখলাম। কোথাও না কাটলেও রক্তে ভিজেছে তার গায়ের সাদা স্যান্ডো গেঞ্জিসহ পরনের প্যান্টও। বুঝতে বাকি রইল না রক্তটা কার। আর একটা মানুষ আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না, সেই আড়াই বছর বয়সী শিশুকে। গিয়ে পেলাম রাস্তার পাশে ছটফট করা সেই মানুষটার কাছে, যার রক্তে রঙিন রয়েছে দুর্ঘটনা প্রান্তর। তার আহাজারি, গোনাজারি আর সহ্য হওয়ার মতো নয়। বারবার বলছেন, আমাকে কোথাও নিয়ে চলো। আমার হাত কই। আমার হাতে যে বল পাচ্ছি না। আমার হাতে কী হলো। চেনাচেনা মনে হলেও চিনতে পারছিলাম না। কিন্তু ওই লোকের বলা নাম জিয়া ও চেহারা দেখে আমার মাথায় এলো, এ তো আমার পাশের গ্রামের বন্ধু মইনুরের বড় ভাই জিয়া। পাশেই দেখলাম একটা মহিলার কোলে রক্তাক্ত মুখে তাকিয়ে রয়েছে একটা নিষ্পাপ মুখ। সেই আড়াই বছরের শিশুটি। মাটিতে লুটিয়ে থাকা জিয়া নাকি তার বাবা। নিজের রক্তে রাঙা মুখ নিয়ে বাবার জন্য কাদছে শিশুটি। আমি দেখলাম ততক্ষণে ওখানে উপস্থিত হয়েছিল দু’জন ডাক্তারও। দু’জনেই উপসহকারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের। সরকারি ডাক্তার। কিন্তু তারাও আমাদের মতো মাজায় হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছিল তাদের ঘৃণা করছিল আহত মানুষগুলোকে দেখে। কিছু সময়ের মধ্যেই নড়াইল থেকে অ্যাম্বুলেন্স এলো। তার খানিকটা আগেই এসে পৌঁছেছিল নড়াইলের ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা। অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হলো আহতদের। একটা নিষ্পাপ শিশুর নিহত ও আহতদের বেদনাবিধুর মুখচ্ছবি ঈদের আনন্দকে চিঁড়ে এক গভীর শোক ও বিষণœতার ছায়া মুহূর্তের মধ্যেই ঢেকে ফেলল কয়েকটি পরিবারসহ গোটা এলাকাকে।
শালিখা, মাগুরা

 


আরো সংবাদ



premium cement