২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রহস্যময় বেদে জীবন

ডাঙ্গায় বেদের অস্থায়ী বসতি; নদীতে বেদে নৌকার বহর -

একদল রহস্যময় মানুষ। যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ায় এখানে-ওখানে ওরা। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দেখা যায় এদের। দেশে দেশে বা অঞ্চলভেদে তাদের একেক নাম, আর বেঁচে থাকার জন্য বিচিত্রসব পেশা। নর-নারী, শিশুর অদ্ভুত তাদের চেহারা, অদ্ভুত তাদের কথাবার্তা। বেদে মানে ভ্রমণশীল বা ভবঘুরে। নদীনির্ভর বাংলাদেশে বেদেদের বাহন তাই হয়ে ওঠে নৌকা। নৌকায় সংসার আবার নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো দেশ-দেশান্তরে। যাযাবর বলেই এদের জীবন বৈচিত্র্যময়। বেদেরা জীবনকে একঘরে রাখতে চায় না, প্রকৃতির ভালোবাসাকে স্বীকার করে। প্রকৃতির মধ্যেই এরা জীবনের বৈচিত্র্যের সন্ধান খোঁজে। বেদেদের এই সন্ধানই আমাদের লোকসাহিত্যেও অন্যতম উপজীবী অংশ বেদে সম্প্রদায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় ও সমস্যাসঙ্কুল হলো বেদে সম্প্রদায়ের জীবন। এরা মূলত আমাদের দেশে বাদিয়া বা বাইদ্যা নামে পরিচিত একটি ভ্রাম্যমাণ জনগোষ্ঠী।
সম্প্রতি মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার তরা সেতুর পাদদেশে দেখা যায় ২০-২৫টি ডেরায় বেদেদের বসতি জীবন। কথা হয় বেদে কন্যা পাপিয়া, দোলা ও কেয়ার সাথে। জানালেন বেদে নারীরা তাদের স্বামীদের আঁচলে বেঁধে রাখার রহস্য। পুরুষ বশে রাখতে তারা শরীরে সাপের চর্বি দিয়ে তৈরি তেল ব্যবহার করে স্বামীর শরীরে তা নিয়মিত মালিশ করে, কারণ স্বামীকে বশ করে রাখবে। তারা আরো জানালেন, আমাদের এখানে যৌথ পরিবার নেই। তবে বেদে সমাজে এখন অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। দিনবদলের হাওয়া তাদের সমাজে লেগেছে। এখন তারা শিতি হচ্ছে সচেতন হচ্ছে। বিনোদনের নতুন নতুন ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে। আগের মতো মানুষ সাপ খেলা দেখে আর আনন্দ পায় না। তাই তাদের পেশাকে পবিরর্তন করে নিয়েছে। তাই বেদেদের ঐতিহ্যগত পেশায় ধস নেমেছে। এত দিনের সংস্কার বিশ্বাসে আঘাত এসেছে। অভাবের কারণে সংসারে ভাঙন লেছে এমন অভিযোগ করে বলেন বেদে বহরের কয়েকজন বয়স্কা নারী।
বেদেরা আমাদের দেশের অন্যতম সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠী। সমাজসেবা অধিদফতরের হিসাবে এদের সংখ্যা প্রায় ৬৩টি লাখ; যার মধ্যে দলিত ৪০ লাখ, বেদে ৮ লাখ ও হরিজন ১৫ লাখ। বাংলাদেশের বেদেরা মোট ৯টি শাখায় বিভক্ত। এগুলো হলো লাউয়ো বা বাবাজিয়া, চাপাইল্যা, বাজিকর, বেজ বা মিচ্ছিগিরি, গাইন, ম্লেছ, বান্দাইরা, মাল ও সাপুড়িয়া। এরা সবাই জমিতে কায়িক পরিশ্রম করাকে অমর্যাদার কাজ বলে মনে করে। এদের পেশা হলো চিকিৎসা ব্যবসা ও ওষুধ বিক্রি। হাটবাজারে সাপের খেলা দেখিয়ে ও নানা রকমের বুনো লতাপাতা আর শেকড়বাকড় এরা ভেষজ হিসেবে ব্যবহার করে। এদের চিকিৎসা পদ্ধতিতে মন্ত্র অর্থাৎ ঝাড়ফুঁকের প্রয়োগ অত্যন্ত বেশি। এ সময় বেদেরা বেশ সাজগোজ করে কোমরে বিছা আর গায়ে ইমটেশন গহনা পরে। খোপায় ফুল গুঁজে রাখে মানুষকে আকর্ষণ করার জন্যই তাদের এমন সাজগোজ।
বেদেরা কৌমসমাজের রীতিনীতি মেনে চলে ও দলবদ্ধ হয়ে থাকে। গোত্রপ্রীতি প্রবল বলে সদস্যরা প্রত্যেকে একে অন্যকে নানাভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে বেদেরা পিতৃপ্রধান সমাজ হলেও মেয়েরা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কথিত আছে, ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে শরণার্থী আরাকান রাজার সাথে এরা ঢাকায় আসে। সে সময় তারা বিক্রমপুরে বসবাস শুরু করে। তার পর সেখান থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও আসামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। পরে তারা ইসলাম ধর্মে দীা নেয়। এরা প্রথমে বিক্রমপুরে বসবাস শুরু করে এবং পরে সেখান থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামেও ছড়িয়ে পড়ে। তাদের আদি নাম মনতং। বেদে নামটি অবজ্ঞাসূচক বাইদ্যা, পরিমার্জিত ‘বৈদ্য’ থেকে উদ্ভূত। বেশির ভাগ বেদেই হাতুড়ে চিকিৎসার সাথে সম্পৃক্ত বলে মনতংরা কালক্রমে বেদে নামে অভিহিত হয়। বেদেরা আরাকান রাজ্যের মনতং আদিবাসী গোত্রের দেশত্যাগী অংশ। তাদের গাত্রবর্ণ ও আকৃতি বাঙালিদের মতো। বেদেদের নিজস্ব ভাষা আছে। এই ভাষার নাম ঠেট বা ঠের। স্বগোত্রীয়দের সাথে কথা বলার সময় এরা এই ভাষা ব্যবহার করে থাকে। তবে বাংলা ভাষাভাষীর সাথে তারা বাংলা ভাষা ব্যবহার করে। এই ঠেট ভাষার সাথে আরাকানদের ভাষার মিল আছে। তাদের ভাষায় ব্যবহৃত বেশির ভাগ শব্দই বাংলা ভাষার আদি রূপ প্রাকৃত থেকে উদ্ভূত।
বেদের বিয়ের ভিন্ন আয়োজনের কথা জানালেন সাভারের বেদে পল্লীর সর্দার বাঘা মোস্তাক, উপার্জনের মওসুম শেষ হলে বেদে পরিবারে বিয়ের আয়োজন করা হয়। তবে বেদেদের বিয়েতে আপ্যায়ন কিংবা উপহার প্রদানের কোনো নিয়ম নেই। সাধারণ বর কনে একে অপরকে পছন্দ করে বিয়ে করে। পছন্দের ব্যাপারটা তার সেরে নেয় বিয়ের অনুষ্ঠানে। বেদেদের বিয়েতে বর কনেসহ উপস্থিত সবাইকে নৃত্যগীত করতে হয়। বাহিরাগত কেউ এলো তাকেও নাচতে হয়। এসব নাচ গান একান্তই বেদে সম্প্রদায়ের। এ সময় অবিবাহিত মেয়েরা খুব আকর্ষণীয় সাজগোজ করে। হেমন্তে ফসল ওঠার মওসুম থেকে শুরু করে পুরো শীত ও বসন্তজুড়ে হাটবারে বেদে নারীরা দলবদ্ধভাবে জীবিকার জন্য হাটে হাটে আর অন্যান্য দিনে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়।
বেদে সম্প্রদায়ের মেয়েদের বিরুদ্ধে সাপ দেখিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে টাকা আদায় করার অভিযোগ বহু পুরনো। এ নিয়ে পথচারীরা উটকো ঝামেলায় পরে। মাঝে মধ্যেই তারা শহর-গ্রাম-হাট বাজার দাপিয়ে বেড়ায়। জীবন ধারণের জন্য তাদের ভিা আদায়ের কৌশল ভিন্ন এবং বেশ আতঙ্কজনক। দেখা যায়, সকাল হলেই তারা দল বেঁধে শহরের বিভিন্ন স্থানে পথচারীদের ওপর হামলে পড়ছে। বিশেষ করে কলেজ, ভার্সিটি ও গ্রাম থেকে আসা মানুষ তারা টার্গেট করে টাকা আদায় করছে। টাকা দিতে অস্বীকার করলে সাপের ভয় দেখায় তারা।
আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে বেদে পল্লীতে। সমাজব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে তাদের জীবনের উন্নতিও হয়েছে। মোবাইল ফোনের ব্যবহার, খুপড়ি ঘরে ব্যাটারি দিয়ে সাউন্ড বক্স, টেলিভিশন ও সৌরবিদ্যুতের বাতির ব্যবহার বেদে সমাজকে আলোকিত করেছে। অথচ একসময় কুপির আলোই ছিল তাদের একমাত্র ভরসা। এখন বেশির ভাগ বেদে পরিবারে মোবাইল ফোন ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। মোবাইল ফোনে তারা ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক ও বিনোদনমূলক যোগাযোগ করছে। এখন প্রায় বেদে শিশুরাই বাংলা, ইংরেজিসহ শিক্ষণীয় বই পাঠ করে। অনেক বহরের সদস্যদের পত্রিকা পাঠ করতেও দেখা গেছে।
পরিবেশ-প্রাণ ও প্রকৃতিবিষয়ক বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থা ‘বারসিক’-এর মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক সমন্বয়কারী বিমল রায় বলেন, ‘বেদেদের জীবনব্যবস্থায় পরিবর্তন দেশের সার্বিক উন্নয়নের একটি প্রতিচ্ছবি। সমাজের অঙ্গ হিসেবে একটি জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাদেরকে সমাজে সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করার সুযোগ করে দিতে হবে। তাদের আর্থিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য পেশা পরিবর্তনের সুযোগ করে দিতে পারলে এই জীবন থেকে মুক্তি পেতে পারে বেদে সম্প্রদায়।’
তাবিজ-কবজ বিক্রি, জাদুটোনা আর সাপ খেলা দেখিয়ে যাদের জীবন সংগ্রামে টিকে থাকা সেই ছিন্নমূল, অসহায় ও অধিকারবঞ্চিত বেদে সম্প্রদায়। যারা রাস্তার পাশে, ফাঁকা মাঠে বা পরিত্যক্ত জমি, খাসজমি, রাস্তার ধার, স্কুলের মাঠে রেললাইনের পাশে অথবা নদীর তীরে অতিথি পাখির মতো অস্থায়ী আবাস গড়ে। আবার এক দিন উধাও হয়ে যায়, কেউ খবর রাখে না তাদের। কোথায় গেল? তারা যে ুধা-দারিদ্র্যের এক নিষ্ঠুর বাস্তবতায় আচ্ছন্ন তার খবর রাখার কেউ থাকে না।
সময়ের আবর্তে উন্নতির পরিবর্তে বেদে সমাজের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্দিন। নদীর রূপ বদলের সাথে সাথে তাদের চলার পরিধি ছোট হয়ে আসছে। আর তাই তারা অনেকেই ছাড়তে শুরু করেছে নদী। নদী ছেড়ে কোথায় যাবে এসব বেদে। তাদের নেই কোনো শিা, নেই কোনো কাজের বিশেষ যোগ্যতা। বাংলাদেশের সমাজে শ্রেণিবিভাজন না থাকলেও বেদেদের দেখা হয় কিছুটা আলাদা চোখে। আর তাই সমাজের মূলস্রোতে মেশাটাও খুব একটা সহজ নয় তাদের জন্য। তবে বেদেরা হারিয়ে গেলে বাংলাদেশের পুরনো ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির একটি অংশ হারিয়ে যাবে। কারণ তারা যাযাবর একটি উপজাতি হলেও কোনোভাবেই মূল বাঙালি সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।


আরো সংবাদ



premium cement