১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলকদ ১৪৪৫
`


শতবর্ষী অনীল দাদু : জীবনের বাঁকে বাঁকে

-

মিরাজের দোকানে প্রায়ই দেখা হয় বৈখালীর অনীল দাদুর সাথে। রসিক এই মানুষটি রসিকতায় ফাস্ট। হাসিরহস্য আর বিভিন্ন পুরাতন গানে মানুষ মজিয়ে ফেলতে পারেন সহজে। অন্যদের থেকে আমাদের সাথে রসিকতা একটু বেশিই করেন। আমাকে দেখলেই টুলে বেদেদের মতো টান মেরে ডাক দেন ও সামাদ ভাই কেমন আছেন! দিনকালই বা কেমন যাইছে আপনার? আমার দাদার নাম সামাদ। দাদার বন্ধু ছিল অনীল দাদু। তাই তো কাছে পেলেই শুরু করে দেন দাদার আমলের নানান গল্প। দোকানের সামনে বিভিন্ন রকমের মানুষ থাকে। ওরা আধুনিক মানুষ। চিন্তা-চেতনা ও ভাবধারাও ভিন্ন। ওদের কাছে দাদুর গল্প বকবকানি আর বিরক্তিকর ছাড়া কিছুই মনে হয় না। ওরা নাটক-সিনেমা নয়তো মোবাইল চালাতে ব্যস্ত। ওরা নানা কৌশল অবলম্বন করে অনীল দাদুকে দোকানের সামনে থেকে বিদায় করার জন্য। আমি শুনতে চাইলেও ওরা আমাকেও শুনতে দিতে চায় না। অবশেষে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনীল দাদু বিদায় নিতে বাধ্য হন। আমার বিষয় আবার ভিন্ন।
অনীল দাদুর দু’জনের সংসার। ছেলেমেয়েরা সব নিজের জীবন নিয়ে বিপাকে। খোঁজ রাখে না বাবা-মায়ের। তার দাবি, তার বয়স ১০০ বছরের বেশি। তার দাবি ও বিশ্বাসের জায়গা এটা যে তার বড় ভাই ছিলেন সেই সময়কার বড় পণ্ডিত। তিনি লিখে রেখেছিলেন। জন্ম তার মাগুরা জেলার সিংড়ায়। ক্রীড়ামন্ত্রীর এলাকা। অনীল দাদু বলেন, ক্রীড়ামন্ত্রীর পাশেই ছিল আমাদের বাড়ি। এপাড়া আর ওপাড়া। আমি সম্পর্কে মন্ত্রীর কাকা হই। এখনো কোথাও এলে আমাকে দেখলেই ডেকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন। অনীল দাদু বলেন, মন্ত্রীর বাবার সাথে তার এক অন্তর্মুখী সম্পর্ক। পরে ওখানে থেকে চলে আসেন বৈখালী মামার বাড়িতে। পরে এখানেই থেকে যান। আর ফিরে যাননি সিংড়ায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কেমন ছিলেন জানতে চাইলেই বললেন, তখন আমি তাগড়া জোয়ান। কিন্তু দুর্ভাগ্য, যুদ্ধে যোগ দিতে পারি নাই। তখন আমার বাবা খুব অসুস্থ। বাবাকে নিয়ে ইন্ডিয়া ছিলাম চিকিৎসা করাতে। দুই বছর ইন্ডিয়া থেকে তখনকার সময়ের নামীদামি ডাক্তার দেখিয়েও বাঁচাতে পারলাম না বাবাকে। অবশেষে বাবার লাশ ইন্ডিয়ার পশ্চিমবঙ্গের এক শশ্মানে সমাধিস্থ করলাম। বাবার এক মামাত ভাইয়ের বাড়িতে থেকে বাবার কাজ সারলাম। পরে বর্ডার পার হয়ে দেশে এলাম। দেশ তখন স্বাধীন। দেশ থেকে তখনো বারুদের গন্ধ আর লাশের পচা গন্ধ যায়নি। বেনাপোল বর্ডার পার হতেই আমার বুকের ভেতর কেমন যেন হু হু করে উঠল। দেশটাকে ওরা মরুভূমি বানিয়ে ফেলেছে। রাতে গ্রামে ফিরলাম। গ্রামে ঢুকেই আগে গেলাম সামাদ ভাইয়ের কাচারিতে। ডাক দিতেই ভাই আমার বলে উঠল বেঁচে আছিস অনীল? তোর বাবার কী অবস্থা। আমি ঘটনা শুনালাম। সামাদ ভাই আমাকে বুকে টেনে নিয়ে সান্ত্বনা দিলেন। সেদিন রাতে আর বাড়ি আসতে দিলেন না। কাচারিতেই ঘুমালাম। সকালে বাড়ি এসে দেখি ঘরবাড়ি কিচ্ছু নাই। এরপর নারকেলগাছের পাতা দিয়ে চাল বানিয়ে একটা চুপড়ি ঘর উঠিয়ে তাতে থাকলাম। ঘর উঠাতে যে কয়দিন লেগেছিল সে কয় দিন সামাদ ভাইয়ের কাচারিতে কাটল। পরে সামাদ ভাই জোর করে বিয়ে দিলেন।
গল্প অন্য দিকে বাঁক নিতে লাগল। আমি বললাম, এখন আপনার সময় কেমন কাটছে। দাদু বললেন, এই কাটে আর কি। না কাটার মতো কাটে। শরীর ভালো যায় না প্রায়ই। হাত-পায়ে জোর আসে না মাঝে মাঝে। তার পরও পেটের দায়ে ভালো দুই চারটা পলো, ঝুড়ির অর্ডার পেলে সেগুলো বসে বসে বানাই। তাই দিয়ে সদাই বাজার করি আর টুনাটুনি খাই। আমি জানতে চাইলাম, শুধু ওই করে কি সংসার চলে? দাদু বললেন, ওই চলে। বাড়তি কোনো খরচ নাই তো সংসারে। মনে করো ওষুধের কোনো গন্ধ নাই। তোমার দাদিও কোনো দিন ওষুধ খায় না। আর আমি তো আমার জীবনে এক ফোঁটা ওষুধ গিলেছি বলে মনে পড়ে না। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। সারা জীবনে একটুও ওষুধ খাননি। ছোটবেলায় কিছু হলে গাছগাছড়া খেতাম, সেরে যেত। রোগ তেমন হতো না। হবে কী করে, আমরা কী কী খেতাম জানো? বড় বড় তাজা কইমাছ, নদীর টাটকা মাছ, জমিতে সার-ওষুধ বাদে তৈরি ধান, শাকসবজি। এগুলো খেলে শরীরে এক শ’ এক শ’ বল মনে হতো। দুই মণের বস্তা মাথায় করে তাবুড়ে নৌকায় উঠতাম। দাদুর কথাগুলোর সত্যতা যাচাই করতে গোপাল স্যারের কাছে গেলাম। কেননা, অনীল দাদুর সমবয়সী কাউকে পেলাম না আশেপাশে। গোপাল স্যার জানালেন, অনীলের বয়স এত না হলেও এক শ’র কাছাকাছি হবে। আমি বললাম, তিনি নাকি জীবনে এক দাগ ওষুধও খাননি। স্যার বললেন, ওর খুব ভালো শরীর স্বাস্থ্য ছিল। যেমন লম্বাচওড়া তেমনি জওয়ান মর্দ। তাগড়া মানুষ ছিল। স্যার আরো বললেন, আমার যত দূর মনে পড়ে, একবার গঙ্গারামপুরের সলেমান ভাইয়ের কাছে অনীল গেছে জ্বরের জন্য। সলেমান ভাই তাকে ওষুধ দিলেন। ও বলল, আমি ওষুধ খাবো না, আমাকে শিউলি ফুলের কিছু পাতা দাও। আমি তোমার ওষুধ নিতে আসি নাই। তারপর শিউলি ফুলের পাতা স্ত্রীকে দিয়ে রস করে খেলো। সেদিন বিকেলেই গঙ্গারামপুর মাঠে অনীল হা-ডু-ডু খেলল। তার মানে ওর জ্বর সেরে গেছে।
শালিখা, মাগুরা


আরো সংবাদ



premium cement