২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ভারতে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পত্তির হিসাব কে রাখে

ভারতে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পত্তির হিসাব কে রাখে - সংগৃহীত

সম্প্রতি ভারতে ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট এতে হস্তক্ষেপ করেছে এবং তা বেআইনি ঘোষণা করেছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে ভারতীয় বাম দলগুলোর একটি পরিচিত স্লোগান ছিল ‘টাটা-বিড়লার কালো হাত ভেঙ্গে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’। ইদানীং বামেরা তো বটেই, কংগ্রেসও বলতে শুরু করেছে, ‘আদানি-আম্বানির কালো হাত ভেঙ্গে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’।

ওই সময়ের টাটা-বিড়লা থেকে বর্তমান আদানি-আম্বানি- অভিযোগের মূল সুরটি আসলে এক। স্বাধীন ভারতে অভিযোগ ছিল, টাটা-বিড়লাকে এক চেটিয়া মুনাফার সুযোগ করে দিচ্ছে শাসকদল শাসক। আর বদলে শাসক কংগ্রেসকে চাঁদা, অনুদানে ভরিয়ে দিচ্ছে এই দুই শিল্পগোষ্ঠী। কংগ্রেসের কোষাগার ফুলে ফেঁপে উঠছে। ঠিক একই অভিযোগ উঠেছে বর্তমান শাসকের বিরুদ্ধেও। কংগ্রেস ও বামেদের অভিযোগ, আদানি-আম্বানিকে একচেটিয়া ব্যবসা এবং মুনাফার সুযোগ করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় শাসক বিজেপি। আর তার পুরস্কার স্বরূপ কোটি কোটি ভারতীয় রুপির অনুদান ঢুকছে বিজেপির অর্থভাণ্ডারে।

একটি হিসাবের দিকে চোখ রাখা যাক। কোভিড পরবর্তী সময়ে ভারতীয় অর্থনীতি যখন কার্যত ধুঁকছে, ওই সময়েও রাজনৈতিক দলগুলোর আয় আগের চেয়ে বেড়েছে। ২০২১-২২ আর্থিক বর্ষে বিজেপির মোট আয়ের পরিমাণ এক হাজার ৯১৭ কোটি রুপি। মোট সম্পত্তি নয়, এক বছরে মোট আয়ের পরিমাণ এটি। আর এর মধ্যে এক হাজার ১৬১ কোটি রুপির আয়ের উৎস অজানা। অর্থাৎ মোট আয়ের ৬১ শতাংশ আয়ের উৎস অজানা।

এই তালিকায় দ্বিতীয় নাম পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। এই অর্থবর্ষে তাদের আয়ের পরিমাণ ৫৪৬ কোটি রুপি। যার মধ্যে ৫২৮ কোটি রুপির আয়ের উৎস অজানা। অর্থাৎ, মোট আয়ের ৯৭ শতাংশ আয়ের উৎস অজানা।

কেন্দ্রে বিরোধী দল কংগ্রেস। ২০২১-২২-এ তাদের মোট আয়ের পরিমাণ তৃণমূলের চেয়ে সামান্য কম। ৫৪১ কোটি রুপি। এর মধ্যে আয়ের উৎস অজানা ৩৮৯ কোটি রুপির। অর্থাৎ, মোটা আয়ের ৭২ শতাংশের উৎস অজানা।

কেন এমনটা ঘটল? কয়েকটি তথ্য এখানে দিয়ে রাখা প্রয়োজন। ভারতে রাজনৈতিক দলগুলো অনুদান, চাঁদা ইত্যাদির মাধ্যমে যে আয় করে, তা কর বহির্ভূত সম্পত্তি নয়। ৮০ জিজিসি ফর্মের মাধ্যমে দলগুলোকে আয়কর দিতে হয়। ফলে মোট সম্পত্তির একটি অডিটও করতে হয়। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, রাজনৈতিক দলগুলো মোট সম্পত্তির একটি বড় অংশ প্রকাশ্যে আনে না। যা আনে, তার একটি বড় অংশের উৎস স্পষ্ট করে না। ২০২১-২২ সালের হিসাব থেকে তা পরিষ্কার।

হিসাব কেন অপরিষ্কার?
এখানেই রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে শিল্পপতি বা শিল্পগোষ্ঠীগুলোর সম্পর্কের বিষয়টি চলে আসে। আয়ের সম্পূর্ণ উৎস স্পষ্ট করলে বোঝা যাবে, কোন শিল্পপতি কী পরিমাণ অনুদান কোন রাজনৈতিক দলকে দিচ্ছেন। আর তার পরিবর্তে শাসক তাকে এবং তার গোষ্ঠীকে কী পাইয়ে দিচ্ছে তাও পরিষ্কার হয়ে যাবে। দুর্নীতির রাস্তাটি সকলের সামনে স্পষ্ট হয়ে যাবে।

সাংবাদিক এবং গবেষক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক দলের সম্পত্তি নিয়ে একাধিক গবেষণামূলক কাজ করেছেন।

তিনি জানান, ‘খেয়াল করলে দেখা যাবে, যখন যে শিল্পগোষ্ঠীর অফিসে ইডি, সিবিআই বা আয়কর দফতর তল্লাশি চালিয়েছে, তখন সেই শিল্পগোষ্ঠীর শাসক দলকে দেয়া চাঁদার পরিমাণ বেড়ে গেছে। এটি নিছক কাকতালীয় নয়।’

স্নিগ্ধেন্দুর বক্তব্য, ভয় দেখিয়ে শিল্প গোষ্ঠীগুলোর থেকে চাঁদা এবং অনুদান নেয় রাজনৈতিক দলগুলো। এবং এই সম্পত্তির হিসাব দেয়া হলেও তার উৎস বলা হয় না।

স্নিগ্ধেন্দু মনে করেন, বছর পাঁচেক আগে সম্পত্তির উৎস গোপন করতেই তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ইলেকটোরাল বন্ডের প্রস্তাব এনেছিলেন এবং পরে তা বাস্তবায়িত হয়েছিল। ভারতীয় স্টেট ব্যাংকে গিয়ে যে কেউ এই ইলেক্টোরাল বন্ড কিনতে পারে এবং যে কোনো রাজনৈতিক দলকে অনুদান দিতে পারে। উল্লেখ্য, কে বন্ডের মাধ্যমে অনুদান দিচ্ছে, তা সম্পূর্ণ গোপন থাকবে। বিভিন্ন গবেষক, গোড়া থেকেই এই প্রক্রিয়াকে অসাংবিধানিক বলে অভিহূত করেছিল। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টও একই কথা বলেছে।

সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য
সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, ইলেক্টোরাল বন্ড একটি অসাংবিধানিক প্রক্রিয়া। স্টেট ব্যাংক এই লেনদেনের সমস্ত নথি দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি তাদের ইউনিক নম্বরের তথ্যও দিতে বলা হয়েছে। যে তথ্যের মাধ্যমে বোঝা যাবে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কোন দলকে কখন কত রুপি দিয়েছে। ইউনিক নম্বরের এই তথ্য স্টেট ব্যাংক এখনো সম্পূর্ণ দিয়ে উঠতে পারেনি।

ইলেক্টোরাল বন্ডের হিসাব
এসবিআই এখনো পর্যন্ত ইলেক্টোরাল বন্ডের যে হিসাব পেশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে মোট বন্ড বিক্রি হয়েছে ১৬ হাজার ৫১৮ কোটি রুপির। এর মধ্যে বিজেপি একাই পেয়েছে আট হাজার ২৫১ কোটি রুপির বন্ড। অর্থাৎ, মোট বন্ডের প্রায় অর্ধেক গেছে শাসক বিজেপির পকেটে। দ্বিতীয় স্থানে আছে কংগ্রেস। তাদের মোট আয় হয়েছে এক হাজার ৯১৫ কোটি রুপি। মাত্র একটি রাজ্যে শাসন ক্ষমতায় থেকেও তৃতীয় স্থানে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস। তাদের মোট আয় হয়েছে এক হাজার ৭০৫ কোটি রুপি। কোন সংস্থা কোন দলকে কত রুপি দিয়েছে, তা এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট না হলেও সমস্ত ইউনিক নম্বর পাওয়া গেলে সেই ছবিটিও স্পষ্ট হয়ে যাবে বলে মনে করছে সুপ্রিম কোর্ট।

একটি বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য, যে সংস্থাগুলো সবচেয়ে বেশি ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছে, তাদের বেশিভাগ সংস্থায় এক বা একাধিকবার ইডি, সিবিআই এবং আয়কর দফতরের তল্লাশি হয়েছে। অর্থাৎ এর থেকে পরিষ্কার, রাজনৈতিক দলগুলো যে রুপি পেয়েছে, তা দুর্নীতিমুক্ত নয়। তল্লাশি অভিযানের সাথে অনুদানের একটি সমানুপাতিক সম্পর্ক আছে।

রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয় নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করছেন সুমন সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, ‘যে তথ্য সামনে আসছে, তা কেবল হিমশৈলীর চূড়া মাত্র। কোন করপোরেট সংস্থা কোন রাজনৈতিক দলকে কত টাকা দেয়, তার সম্পূর্ণ হিসাব সামনে এলে দুর্নীতির এক বিরাট পর্দা খুলে যাবে।’

ভারতে ভোট প্রচারে অর্থ ব্যয়ের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ স্থির করে দেয়া হয়েছে। তার চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করা অপরাধ। অভিযোগ, প্রথম শ্রেণীর রাজনৈতিক দলগুলো সেই নিয়ম কখনোই মানে না। নির্দিষ্ট অর্থের দ্বিগুণ, তিনগুণ অর্থও খরচ হয় করা হয় প্রচারে। হিসাব বহির্ভূত অর্থ থেকেই সেই অর্থ ব্যয় করা হয়।

সুমনের বক্তব্য, কেবলমাত্র ভোটের সময় রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থ খরচের হিসাব মিলিয়ে দেখলেই দুর্নীতির হিসাব স্পষ্ট হবে।

বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট যে চাপ তৈরি করেছে, তাতে রাজনৈতিক দলগুলোর অবৈধ লেন-দেন, শিল্পগোষ্ঠীগুলির সাথে তাদের সম্পর্কের চরিত্রটি স্পষ্ট হবে। আর সেই সূত্র ধরে দলগুলোর আর্থিক লেন-দেনের সমস্ত হিসাব যদি সামনে আনা যায়, তাহলে এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটবে। উন্মুক্ত হবে, অরাজকতা এবং দুর্নীতির এক বিরাট কাহিনী।
সূত্র : ডয়চে ভেলে


আরো সংবাদ



premium cement