২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


প্রকৃতির প্রতিক্রিয়া প্রতিশোধ

প্রকৃতির প্রতিক্রিয়া প্রতিশোধ - ফাইল ছবি

দিন দিন ভূপৃষ্ঠ গরম হয়ে উঠছে এমন কথা আজকাল রেডিও টেলিভিশনে প্রায়ই শোনা যায়। ভূপৃষ্ঠ গরম হওয়ার প্রতিফল প্রকৃতির বিরূপ আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে। এক সময় রেডিওতেই শুনতে হতো সব। সরকারি রেডিও। সিনেমার গান থেকে শুরু করে সুনীল গাভাস্কারের শতরান করার কাহিনী সবই। দেখার কিছু ছিল না, সবই শোনার। কানটা খাড়া রাখলে চলত। যা হোক, আজকাল বেসরকারি টেলিভিশনেই সবকিছু সচিত্র দেখানো হয়। হৃদয়ে মাটি ও মানুষ ধরনের অনুষ্ঠানে গাছে পোকা লাগা থেকে শুরু করে, সেই পোকা থেকে রক্ষা এবং ফল ফসলের বাড়তি জোগান পেতে খাদ্যে বীরের মতো বিষপ্রয়োগসহ সব কিছু দেখা যায়, গ্রামের মানুষ শহরে বসে তা দেখেই চলেছে। কারো রাখাল সেজে গরু ও ছাগল নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার স্মৃতি রোমাঞ্চিত করে। মনে পড়ে একটা ছাগল কিছুটা বেয়াদব প্রকৃতির ছিল, তার সাথে সহযোগিতা করত না।

আজকাল ছাগলটির এই আচরণকে মিডিয়ায় হয়তো কিছুটা বামপন্থী, সাম্প্রদায়িক মায় অমানবিক, নাশকতাকারী এ ধরনের শব্দ সুষমায় তুলে ধরা হতো। টিভির ভাষ্যকার হয়তো ছাগলটির একটি সাক্ষাৎকার নেয়ার লোভ সংবরণ করতে পারত না। ছাগলটি নিয়ে বড় ধরনের কোনো সমস্যার কারণ উদ্ভব হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে সেখানে টিভি চ্যানেলের প্রতিনিধি ক্যামেরা নিয়ে স্পট থেকে স্টুডিওতে সরাসরি রিপোর্ট করার জন্য প্রস্তুতও থাকত। মিডিয়া কভারেজ পেয়ে ছাগলটি হয়তো হিরো বনে যেত। আজকাল কুকুরের দাঁত মাজা নিয়ে টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনও তো হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় আইলা কোন পথ দিয়ে আইল আর গেল তা বোঝার আগে বেশুমার ঘরবাড়ি লোনা পানিতে একাকার। সয়লাব হয়ে যাওয়া মাছের ঘের, নগেন মাঝির খেয়াঘাট, নইকাটির নুকো মাহাজনের চাতাল, ঘরদোর সবই। সুন্দরবনের কোলঘেঁষে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যে জনপদ তারা সুন্দরবনের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে বেশ ভালো থাকত। ঘূর্ণিঝড়ের সময় সিডরের বড় ধাক্কা সুন্দরবন বুক পেতে নিলো, আইলার আঘাতও তার ওপর দিয়েই গিয়েছে কিন্তু জলোচ্ছ্বাস ঠেকাবার পুরো ক্ষমতা আর ছিল না। নদী দিয়ে সে পানি হঠাৎ অমাবস্যার গোনে (জোয়ারে) লোকালয়ের দুর্বল বেড়িবাঁধ ছাপিয়ে মাড়িয়ে পাড়িয়ে ঘাস ফল ফসলের মাঠ ঘাট সব তলিয়ে দিয়ে গেল। লবণাক্ত পানি মুহূর্তের মধ্যে পাখিমারা পদ্মপুকুর প্রতাপনগর কয়রা বেদকাশী গাবুরা পাতাখালীর সব পুকুরগুলোকে বিধবা করে দিয়ে গেল।

এসবের কারণ হিসেবে পরিবেশবিদরা বলেন, ভূপৃষ্ঠ গরম হয়ে ওঠার কথা। বেশি গরম হওয়ায় প্রকৃতির মাথা নাকি খারাপ হচ্ছে। হিমালয়ের বরফ গলে নদী দিয়ে পানি গড়াচ্ছে সমুদ্রে অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলেও সমুদ্রের পানি বাড়ছে। আর ছোটবড় ভূমিকম্পে সমুদ্রের তলদেশ এবড়ো খেবড়ো, পাহাড় পর্বত উঁচু হয়ে উঠছে। এই সব হঠাৎ ফুলে ফেঁপে ওঠা, স্থানচ্যুৎ হওয়া পানি যাবে কোথায়? সুনামি হয়ে জলোচ্ছ্বাস হয়ে ছুটছে জনবসতি ভূস্থলের দিকে। এসব নিয়ে গবেষণা করেন যেসব বিজ্ঞ ব্যক্তি তারা বলছেন, সমুদ্র মেখলা ছোট ছোট অনেক দ্বীপরাষ্ট্র নাকি পানিতে তলিয়ে যাবে। অর্থাৎ পৃথিবীর তিন ভাগ পানি আর এক ভাগ ভূস্থল এর হারাহারি হিসাবে কিছুটা গরমিল হবে। সে না হয় হলো, কিন্তু ঘন জনবসতির কী হবে? সুন্দরবনের বাসিন্দাদের সংগঠন বাবাহকু (বাঘ বানর হরিণ ও কুমির) সমিতির সদস্যরা স্মারকলিপি তৈরি করছে। তাদের অনুযোগ পৃথিবী উষ্ণ করছে মানুষ আর তার প্রতিশোধের শিকার কেন হবে তারা?

তাদের পরিসংখ্যান ব্যুরো গেল শতাব্দীর সত্তর দশক থেকে সেবারের সিডরের সময় পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে সুন্দর বনের গাছ পাখ পাখালি আর বাবাহকু সমিতির সদস্যদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তাদের অনুযোগ স্বশিক্ষিত মানুষই এসব দুর্গতির জন্য দায়ী। একবার সুন্দরবনকে ভোট দিয়ে এক নম্বর করাবার যে চেষ্টা তদবির চলছিল তা কাদের স্বার্থে এ প্রশ্ন করেছিলেন সে দিন বাবাহকুর প্রেসিডিয়াম সদস্য হরিণা হাপান। হরিণা কচিখালীতে তড়িঘড়ি করে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে অনুযোগ করেন, সুন্দরবনে বাস করি আমরা, আমরাই সৌন্দর্যের আধার। অথচ আমাদের সাথে আলাপ না করে সংলাপে না বসে, মতামত না নিয়ে একতরফাভাবে মনুষ্য জাতির পক্ষে পর্যটনের চেয়ারম্যান বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালাচ্ছেন। হরিণা প্রশ্ন রাখেন, আমরাই যদি না বাঁচি তাহলে কী দেখতে আসবেন পর্যটকরা? এদিকে সুন্দরী গরান বাইন ও কেওড়া গাছের সংগঠন ‘সুগরাকে’ এক বিবৃতিতে তাদের মৃত্যুদশা যথাযথ পরিদর্শন ও প্রতিকার প্রার্থনা করেছে। সুগবাকে মনে করে যাদের রক্ষণাবেক্ষণের নামে গণি মিয়ারা অর্থ আত্মসাৎ করে বালিশে ঢুকিয়েছে। সিডর আইলা আয়াসে মরে পড়ে থাকলেও কেউ তাদের সৎকারে এগিয়ে আসেনি। অথচ জলবায়ু তহবিলের টাকা চাওয়ার বেলায় উচ্চকণ্ঠ সবাই ষোলআনা।

ধরিত্রির উষ্ণতার উদ্বাহু আচার আচরণে সুকান্তের ঝলসানো রুটিও এখন পাওয়া যাচ্ছে না। পূর্ণিমার চাঁদ দুষ্প্রাপ্য হার্টথ্রব নায়িকার মতো। মনের মাধুরী মিশিয়ে মনমাতানো গান এখন যেন আকাশ আর মাটি বাতাসের বৈরিতায় বিবর্ণ বিকেলে বেতাল বেরসিকতায় বিপন্ন।

এখনো মান্নাদের সেই স্মৃতি জাগানিয়া গান (পৌষের কাছাকাছি রোদমাখা সেই দিন) শুনতে শুনতে অনেকে ফিরে যায় অনেক পর্যায়ের অতীতে। অনেক ধরনের অতীত। অতীতের শ্রেণিবিন্যাস তাদের স্মৃতির বালাম বইয়ে থরে থরে সাজানো। ভাইরাসে যাতে নষ্ট না হয় সে দিকে সজাগ দৃষ্টি সবার। পাইরেসি করা কোনো ভাবালুতাকে সে সেখানে সহজে প্রবেশাধিকার দিতে চায় না। আজকাল সাথী হবার, বনবার অনেক প্রকার উপায় ও উপলক্ষ তৈরি হতে দেখা যায়। পীরভাই, তবলিগি ভাই, চিল্লার দোস্ত, শ্রেণী সাথী, কক্ষ সাথী, জেলা সাথী, ক্যাডার সাথী, বিষয় সাথী, সহপাঠী, সহযোদ্ধা, সতীর্থ, সহোদর, ডামি ও স্বতন্ত্র সঙ্ঘ ওগায়রা ওগায়রা। এতসব নাম ধামভিত্তিক পরিচয় পার্বণের মধ্যে প্রকৃতির প্রতিশোধ প্রতিক্রিয়া পাঠের, উপলব্ধির শক্তিরা বেপথু হয়ে যাচ্ছে। এখন চোরকে চোর বলা যাবে না, দাগি আসামিরও মৌলিক অধিকারের বাহানায় আইনের কাছ থেকেও আশ্রয় প্রশ্রয় মিলছে। মৌলিক অধিকার শুধু ধুরন্ধর ডাকাতদের এখতিয়ার, যার ঘরে ডাকাতি হয়েছে প্রতিকার প্রতিবিধান চেয়ে তার চিৎকারে কান দেয়ার প্রশ্ন সেই ডাকাতি নিয়ে বাইরের কেউ কিছু বলছে কিংবা বলেনি সেটাই ডাকাতের কাছে বাহবা পাওয়ার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

ঘরের নয়, বাইরের বাহবা সংগ্রহে যেমন একটা বিশেষ উদ্দেশ্যময়তা কাজ করে, বাহবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও উদ্দেশ্যময়তা পরিলক্ষিত হয়। এমন কিছু প্রতিষ্ঠানপ্রধান যারা নিজ দফতরের বা অধিক্ষেত্রে কি ঘটছে বা ঘটাচ্ছেন সে দিকে নজর না দিয়ে কিভাবে বাইরের বাহবা অর্জন করা যায় সে ব্যাপারে বেশি মনোনিবেশ করছেন। নিজেকে ‘বিশেষ ধ্যান ধারণার প্রবর্তক’ হিসেবে প্রচারের দিকে নজর বেশি। বাইরের সংস্থা তার সেই বাহ্যিক ব্যবস্থাপনার ভোল দেখে ভদ্রতার খাতিরে হয়তো সামান্য একটু প্রশংসাই করল তিনি এবং তার দফতর সেটিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সবার মাঝে প্রচারে নেমে পড়ল। অনেক সময় তল্পিবাহক অধীনস্থদের ব্যবহার করা হয় অন্যের কাছ থেকে ডিগ্রি সংগ্রহে। এক সময় এই বাবাহকুর রাজ্যে যে যত ডিগ্রি জোগাড় করে দিতে পারবে তার পদোন্নতি এমন কি চাকরির বয়স তত বাড়ার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাধ্য হয়ে অনেকে ঘরে বাইরে নানান সংগঠন নিজেরা তৈরি করে তার ব্যানারে পদক দিয়ে প্রচারে প্রসারে তা বাড়িয়ে তোলেন।

সব সময় ক্ষমতাসীন বা তাদের তল্পিবাহক, স্তাবক ও বিশ্বস্ত অনুসারীদেরকে হাতে রাখার জন্য পদক, সনদ, এনাম, জায়গীর ইত্যাদি দেয়া হয়। আর এসব এনাম পাবার জন্য পদকলোভীরাও নিজেদের ব্যক্তিত্ব, স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদার মাথা খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে এই পদক প্রদান প্রথা অনেকটা গাধার সামনে মুলা ঝোলানোর মতো পর্যায়ে নেমে যায়। নিজের পক্ষের হলে পদক দেয়ার নিয়মকানুন মানার প্রয়োজন পড়ে না। স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য মৌসুমী ও ভূঁইফোঁড় সংগঠন গড়ে তুলে যাকে পদক দেয়া হবে তার কাছ থেকেই বিনিময় নিয়ে তাকে পুরস্কৃত করা হয়। সত্যকে অস্বীকার, সর্বোপরি নীতি-নৈতিকতাবর্জিত কার্যকলাপে প্রতিক্রিয়া প্রকাশে বা প্রতিশোধ গ্রহণে প্রকৃতি দেরিতে হলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় হয়েই থাকে। এটি একটি পরস্পর প্রযুক্ত প্রক্রিয়া।

লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement
রুশ অগ্রযাত্রার মধ্যেই ভারী হামলা প্রতিহত করল ইউক্রেন কাতার ছাড়তে হলে হামাসের পরবর্তী গন্তব্য কোথায় বগুড়ায় বসতবাড়িতে পটকা তৈরির কারখানায় বিস্ফোরণ, আহত ৪ নগরকান্দায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অগ্নিকাণ্ড মঙ্গলবারও ঢাকাসহ ২৭ জেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ নাটোরে গণধর্ষণের দায়ে তিন কিশোরকে ১০ বছরের আটকাদেশ ঘাটাইলে সংরক্ষিত বনে দুর্বৃত্তের আগুন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জন্মদিন ও পতাকা অবমাননা মামলার শুনানি ২১ জুলাই ভালুকায় প্রচণ্ড তাপদাহে ২ শিক্ষার্থী অসুস্থ গাজীপুরে অপহরণের পর স্কুলছাত্রকে হত্যার দায়ে সাতজনের যাবজ্জীবন গাজার ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করতে সৌদিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী

সকল