২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


মধ্যপ্রাচ্যের চ্যালেঞ্জিং বছর ২০২৪

মধ্যপ্রাচ্যের চ্যালেঞ্জিং বছর ২০২৪ - নয়া দিগন্ত

২০২৩ সালের ঘটনাগুলো ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত পরিস্থিতিতে বৈচিত্র্য এনেছে। এসব ঘটনা ২০২৪ সালে মধ্যপ্রাচ্য ও বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশকে উত্তপ্ত রাখবে। এখন চলছে ভয়াবহ গাজাযুদ্ধ। বিভিন্ন দেশ এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে। লেবানন সীমান্তে কিছু ভারতীয় সেনা ঢুকে পড়ে মর্মে সার্কেল ৩৬০ রিপোর্ট করেছে। নেতানিয়াহুর আবেদনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরই এই তথ্য ফাঁস হয়। তবে কোনো নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যমে ভারতীয় সেনাদের উপস্থিতির বিষয়ে জানা যায়নি। গাজাযুদ্ধ ইসরাইলকে আর্থিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

অর্থনীতির আকার, মাথাপিছু আয় ও সামরিক শক্তি- এসব বিবেচনায় ইসরাইলের অর্থনীতি অনেক অগ্রসর বলে বিবেচিত। ২০২২ সালে ইসরাইলের মোট দেশজ উৎপাদন ছিল ৫২২ বিলিয়ন ডলার। এই অর্থনীতি মিসর, ইরান, মালয়েশিয়া ও নাইজেরিয়ার চেয়ে বেশি। ইসরাইলের জনপ্রতি দেশজ উৎপাদন ৫৫ হাজার ডলার। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির মতো উন্নত দেশগুলোও জনপ্রতি দেশজ উৎপাদনে ইসরাইলের চেয়ে পিছিয়ে আছে। এ ছাড়া তেলসমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরব, কুয়েত, এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতের চেয়েও ইসরাইল অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। চীন ছাড়া দ্রুত বাড়তে থাকা অর্থনীতিগুলোর মধ্যে ইসরাইলি অর্থনীতির অবস্থান প্রথম বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ২০০০-২২ সাল মেয়াদে ইসরাইলি অর্থনীতি, মার্কিন, ইউরোজোন ও জাপানের অর্থনীতির চেয়ে দ্রুত এগিয়েছে। গত ২২ বছরে ইসরাইলের অর্থনীতির আকার তিনগুণ পর্যন্ত বেড়েছে। মাইক্রোসফট, আইবিএম, ইনটেল, গুগলসহ প্রায় ৫০০ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইসরাইলের টেক-সেক্টরে বিনিয়োগ করেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ইসরাইলে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখবে কি না, সেটি এখন পুনর্বিবেচনার টেবিলে।

ইসরাইলের নগদ অর্থের জন্য এখন ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘরে মূলবান সব কিছু লুট করার ভিডিও প্রকাশিত হচ্ছে। সেনারা পশ্চিম তীর থেকে প্রায় ২.৭৬ মিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ নগদ অর্থ চুরি করেছে। এক দিনে একাধিক শহরে, একযোগে জায়নবাদী সেনারা এই চুরির ঘটনা ঘটায়। সে সময় একাধিক ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জের দোকানে হামলা চালিয়ে তাদের কাছ থেকে প্রচুর নগদ অর্থ বাজেয়াপ্ত করে। ইসরাইলি দখলদাররা আরব ব্যাংক, আলকুদস ব্যাংক, আল খালিজ এক্সচেঞ্জ ও ফখর আদ দিন মানি এক্সচেঞ্জে হামলা চালিয়ে নগদ অর্থ জব্দ করে।

ইসরাইলের এই আর্থিক সঙ্কটে বাইডেন গত ৯ ডিসেম্বর ১০ কোটি ৬০ লাখ ডলার মূল্যের ১৪ হাজার গোলাবারুদ বরাদ্দ দেন। ২৯ ডিসেম্বর এক প্রতিবেদনে সিএনএন জানায়, পার্লামেন্টকে এড়িয়ে চার কোটি ৭৫ লাখ ডলারের সামরিক সহায়তা বরাদ্দ করেছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ নিয়ে দ্বিতীয় দফায় কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে এই বরাদ্দ দেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ইসরাইলকে এভাবে সাহায্য দেয়ার মাত্র চারটি রেকর্ড আছে। জো বাইডেনের আমলেই পরপর দু’টি ঘটনা ঘটল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক অবস্থানে একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ। যদিও চীন বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারসাম্য বজায় রাখতে চেষ্টা করছে। এ সম্ভাবনা চীনকে অচিরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে প্রকাশ করবে। ৭ অক্টোবর পরবর্তী ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক নাজুক অবস্থার দিকে টেনে নিয়ে গেছে। গাজা সঙ্ঘাত মার্কিন কূটনীতির বিশ্বাসযোগ্যতাকে বিনষ্ট করেছে। এটি যুদ্ধে পরাজয়-জয়ের চেয়েও বড়। আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জো বাইডেনের প্রশাসনের লক্ষ্য ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

বিদ্যুৎ, পানি, ওষুধ-চিকিৎসা, খাবার ও ধ্বংসযজ্ঞের সাথে চাকরিহারা হয়েছে ফিলিস্তিনিরা। ৭ অক্টোবরের পর এক লাখ ২০ হাজার ফিলিস্তিনি কাজ হারিয়েছেন। এই শূন্যতা পূরণে ফিলিস্তিনি শ্রমিকদের জায়গায় ভারতীয়দের নিয়োগ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। নেতানিয়াহু ভারত থেকে এক লাখ কর্মী চেয়েছেন।

ইসরাইল যুদ্ধ বন্ধ না করায় ইসরাইলি জাহাজ ও সমর্থনকারী দেশের জাহাজে ইয়েমেনি হুথিরা আক্রমণ চালাচ্ছে। শতাধিক মিসাইল আক্রমণ করেছে তারা। নৌ-চলাচলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ জোটের পাঁচটি যুদ্ধজাহাজ টহল দিলেও, টাস্কফোর্সে ডেনমার্ক যোগ দেয়ার এক দিন পর ডেনিশ জাহাজে আক্রমণ চালিয়েছে হুতিরা। আরব সাগর এবং ভারত মহাসাগর অঞ্চলে পাঁচটি রণতরী মোতায়েন করেছে ভারতীয় নৌবাহিনী।

ইসরাইলের কাছে লোহিত সাগরে ইতোমধ্যে তিনটি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে পাকিস্তান। পাকিস্তান বলেছে, তাদের বাণিজ্যিক জাহাজের নিরাপত্তার জন্য এগুলো পাঠানো হয়েছে। ফিলিস্তিনের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য ইয়েমেনের ২০ হাজার মানুষ প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সানা। অচিরেই লোহিত সাগরে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দেশ যুক্ত হয়ে পড়বে বলে মনে হচ্ছে।

নতুন বছরে বিশ্বব্যাপী নানা দেশের নির্বাচনে চার বিলিয়নের বেশি মানুষ ভোট দেবে ও সেই পরিমাণ মানুষ নির্বাচন ইস্যু নিয়ে মাঠ গরম রাখবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ভারত, তাইওয়ান ও বাংলাদেশ নির্বাচন ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। মিসরে মূল নির্বাচন শেষ হয়েছে, চলমান বছরের মার্চে নতুন মেয়াদে তিনি দেশ শাসন করবেন। সিসি পুনরায় স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করতে ও গণতন্ত্রকে নির্বাসন দিতে সমর্থ হয়েছেন। তবে অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক থাকায় পাউন্ডের মূল্যের পতন, জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতির কারণে জনজীবনে অস্থিরতায় মিসরীয়রা দুর্ভোগ পোহাবে বেশি। রাশিয়ার আসন্ন নির্বাচনে পুতিনের রাষ্ট্রপতিত্বকে ব্যাহত করার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। পুতিনের ক্ষমতায় থাকা বা না থাকা বৈশ্বিক রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার সাথে ইউক্রেন, পোলান্ড, নতুন করে ফিনল্যান্ডও গাজা যুদ্ধে জড়িত হয়েছে। এ সবই মধ্যপ্রাচ্যের গাজা ও লোহিত সাগরে সঙ্ঘাতের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পরিবেশকে জটিল করে তুলেছে।

নেতানিয়াহু বলেছেন, যুদ্ধ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। গাজা উপত্যকায় যুদ্ধ চলবে আরো কয়েক মাস। সব ফ্রন্টেই ইসরাইলি বাহিনী লড়ছে। বিজয় অর্জন করতে সময় লাগবে। ইরানের প্রতিও হুমকি ছুঁড়েছেন তিনি। তিনি আরো বলেন, ফিলাডেলফিয়া করিডোর বাফার জোন, যা মিসরের সাথে গাজার সীমান্ত বরাবর চলে গেছে, তা অবশ্যই ইসরাইলের হাতে থাকতে হবে। এটি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। নেতানিয়াহু এসব দাবি করলে যুদ্ধ থামার কোনো সম্ভাবনা নেই বরং তা বিস্তৃতি লাভ করবে। ট্রাম্পের সময় কাসেম সুলেইমানিকে হত্যা করা হয়, এবার সিরিয়ায় ইরানের সেনা কমান্ডার সৈয়দ রাজি মুসাভিকে হত্যা করায় ইরান বদলা নেবে বলে ঘোষণা করেছে। উপসাগরীয় এলাকায় যুদ্ধ বিস্তৃত হওয়ার ও মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞের আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

ইসরাইল-গাজা যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ ফ্রন্ট। যদিও ইসরাইল সামরিক বিজয় অর্জন করে, দেশটিকে কৌশলগত ক্ষতি, আরব বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়াকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। গাজা নিয়ে ইরানের সাথে যুদ্ধ হতে পারে। লোহিত সাগরে ও হরমুজ প্রণালীতে ইতোমধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। গাজাযুদ্ধ এই অঞ্চলে একটি ইসরাইলবিরোধী রাজনৈতিক ব্লক গঠনের সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠেছে।

৭ অক্টোবরের আগে সৌদি আরব ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য হুথিদের সাথে একটি চুক্তির প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল, ইসরাইলের সাথেও আরেকটি চুক্তির আলোচনা চলছিল এবং ইসরাইল ও তুর্কিয়ের মধ্যে স্বাভাবিককরণের জন্য একটি কাঠামোগত ভিত্তি তৈরির কাজ চলছিল। এসব এখন কোনোটিই সম্ভব নয়। মধ্যপ্রাচ্যে আক্রমণাত্মক প্রক্রিয়াবলির পুনরুত্থান হয়েছে এবং ২০২৪ সালে এসব নির্বাপিত না হয়ে আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠবে।


আরো সংবাদ



premium cement