২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সুশাসন

সংবিধান ও আইনের ব্যত্যয় বিপর্যয়ের বার্তাবহ

সংবিধান ও আইনের ব্যত্যয় বিপর্যয়ের বার্তাবহ - নয়া দিগন্ত

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ পাকিস্তান থেকে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন-পরবর্তী শেখ মুজিবুর রহমান ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। মুজিবনগর সরকারে শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতির পদ দেয়া হলেও তিনি পাকিস্তানের কারাগারে অন্তরীণ থাকায় সে পদে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদানে সক্ষম হননি। ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের বাসভবনে শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
বাংলাদেশের সংবিধান ৪ নভেম্বর ১৯৭২ প্রণয়ন-পরবর্তী একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর এটি কার্যকর হয়। এ সংবিধানটি ’৭২-এর সংবিধান নামে পরিচিত। ’৭২-এর সংবিধানে রাষ্ট্রের শাসন কাঠামোয় সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার বিধান ছিল।

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বিল উপস্থাপন-পরবর্তী ১৫ মিনিটের আলোচনায় বিলটি সংসদে পাস হয়। এ বিলটির মাধ্যমে বহুদলীয় সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে একদলীয় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয় যা বাকশাল নামে অভিহিত। চতুর্থ সংশোধনী পাস-পরবর্তী স্পিকার সংসদ ভবনে শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করান। যদিও ’৭২-এর সংবিধানে প্রধান বিচারপতি কর্তৃক রাষ্ট্রপতির শপথ পাঠ পরিচালনার বিধান ছিল।

চতুর্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতি সংক্রান্ত বিশেষ বিধান প্রণয়ন করে বলা হয়- এ আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতি পদে থাকবেন না এবং রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হবে; জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হবেন এবং রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করবেন এবং উক্ত প্রবর্তন থেকে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকবেন, যেন তিনি এ আইনের দ্বারা সংশোধিত সংবিধানের অধীনে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন।

সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী প্রবর্তন পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতির সংসদ সদস্য কর্তৃক নির্বাচিত হওয়ার বিধান ছিল। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়ার বিধান প্রবর্তন করা হলেও সংবিধানে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করে শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ-পরবর্তী ওই পদে বহাল রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে কার্যত দেখা যায়, জনগণকে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত করা হয়।

’৭২-এর সংবিধানে রাষ্ট্রপতি আগে ভেঙে না দিয়ে থাকলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী সংসদের প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে পাঁচ বছর অতিবাহিত হলে সংসদ ভেঙে যাওয়ার বিধান ছিল। বাংলাদেশের সংসদের প্রথম নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় ৭ মার্চ ১৯৭৩ সালে এবং ওই বছরের ৭ এপ্রিল সংসদের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী প্রবর্তন-পরবর্তী প্রথম সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি করে বলা হয় এ সংশোধনীটি কার্যকর-পরবর্তী পাঁচ বছর অতিবাহিত হলে সংসদ ভেঙে যাবে। প্রথম সংসদটি ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে ভেঙে দেয়া হলে দুই বছর ছয় মাসের ব্যাপ্তিকালে এ সংসদটির অবসান ঘটে, যদিও চতুর্থ সংশোধনীর বিধান অনুযায়ী মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে এ সংসদটি ১৯৮০ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত বহাল থাকার কথা ছিল। অপর দিকে, ’৭২-এর সংবিধানের বিধান অনুযায়ী, প্রথম সংসদকে মেয়াদ পূর্ণ করার সুযোগ দেয়া হলে এটি ১৯৭৮ সালের ৬ এপ্রিল অবধি বহাল থাকত।

’৭২-এর সংবিধান এবং সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী প্রবর্তন-পরবর্তী সংবিধানের বিধানগুলো পর্যালোচনায় দেখা যায়, শেখ মুজিবুর রহমানকে সময়-কাল উল্লেখ ব্যতিরেকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠান এবং চতুর্থ সংশোধনী প্রবর্তনের তারিখ থেকে সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর বর্ধিতকরণ তৎকালে কার্যকর সংবিধানের বিধানাবলির ব্যত্যয়ে করা হয়েছিল। অনেকে যুক্তি দেখাতে পারেন, ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলির আলোকে বিধানদ্বয়কে রক্ষাকবচ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সংবিধানের প্রস্তাবনায় গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিতের বিধান সমুন্নত রেখে এ ধরনের যুক্তি অসাড় এমনটিই গণতান্ত্রিক শাসনে বিশ্বাসীদের অভিমত।

সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় দল হিসেবে একটি দল বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠা করে বিদ্যমান অপর সব রাজনৈতিক দলের বিলোপসাধন করা হয়। বাকশাল গঠনের পটভূমি ব্যাখ্যা করে বলা হয়- দেশ ও জাতি গঠনে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিতের লক্ষ্যে এটি অত্যাবশ্যক বিধায় সময় ও যুগের চাহিদার আলোকে এমন পদক্ষেপ কাক্সিক্ষত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়ক হবে।

প্রণিধানযোগ্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীকার আন্দোলন ও মুক্তি সংগ্রামের রণকৌশল ছিল গেরিলা যুদ্ধ। গেরিলা যুদ্ধে সফলতা পেতে হলে দেশের আপামর জনগণ তথা- ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, চাকরিজীবী, সৈনিক প্রভৃতির অকুণ্ঠ সমর্থন ও অংশগ্রহণ প্রয়োজন। এ দেশের সাধারণ জনমানুষ ভারতে ও দেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থ, খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে সমর্থন জুুগিয়েছিল। সব শ্রেণিপেশার সাধারণ জনমানুষের সর্বাত্মক সমর্থনের কারণেই স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এ দেশের স্বাধিকার আন্দোলন তথা মুক্তিসংগ্রাম সফলতা পেয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থ, খাদ্য ও আশ্রয়দানের কারণে সাধারণ জনমানুষের মধ্যে অনেকের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। সাধারণ জনমানুষ এ ক্ষতির জন্য কোনো ধরনের বিনিময়প্রত্যাশী না হলেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত অনেকেই অপ্রত্যাশিত আনুকূল্য ও সুযোগ সুবিধা পেয়েছে বা পেয়ে আসছে।

স্বাধীনতার চার বছর পর পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াসে জাতীয় দল বাকশাল গঠনের মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণের যে আহ্বান জানানো হয়েছিল এমন আহ্বান স্বাধীনতার অব্যবহিত পর প্রদান করে জাতীয় সরকার গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলে তা যে রণকৌশলের ভিত্তিতে অর্থাৎ গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীকার আন্দোলন তথা মুক্তিসংগ্রাম সফলতা পেয়েছিল তার প্রতিফলন ঘটত।

বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে যে গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছিল তাতে একজন সামরিক শাসকের দীর্ঘ ৯ বছর মেয়াদি শাসনের অবসান ঘটে। এ সামরিক শাসক বা এর আগেকার সামরিক শাসক উভয়ের ক্ষমতায় আরোহণ সংবিধানের ব্যত্যয়ে সংগঠিত হলেও সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে উভয়ের ক্ষমতা আরোহণ এবং ক্ষমতায় থাকাকালে যাবতীয় কার্যক্রমকে বৈধতা দেয়া হয়। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে যে অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছিল তা যদিও তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে করা হয়েছিল কিন্তু তাও যে সংবিধানের ব্যত্যয়ে হয়েছিল এ প্রশ্নে কোনো দ্বিমত নেই। এ অস্থায়ী সরকারটিকে সংবিধানের একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেয়া হয়।

বাংলাদেশের ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন একতরফা ও একদলীয় হলেও এ সংসদে সব রাজনৈতিক দলের দাবির প্রতিফলনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন সপ্তম ও অষ্টম এ দু’টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ দু’টি নির্বাচনের প্রথমটিতে আওয়ামী লীগ ও দ্বিতীয়টিতে বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) বিজয়ী হয়। এ দু’টি নির্বাচন তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত অপর যেকোনো সংসদ নির্বাচনের চেয়ে পরিচ্ছন্ন, স্বচ্ছ এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, উভয় নির্বাচন বিজিত দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, এ দেশে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে, অপর দিকে কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকার, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন যে চারটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এর কোনোটিতেই নির্বাচন পরিচালনাকারী সরকারের অব্যবহিত পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীনরা বিজয়ী হতে পারেনি।

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সব রাজনৈতিক দলের সমঝোতার ভিত্তিতে একটি মীমাংসিত বিষয় ছিল। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার একতরফাভাবে রদ দেশে যে রাজনৈতিক বিভাজনের জন্ম দিয়েছে এর অবসান না হলে রাজনীতির মাঠের আকাশে উদিত কালো মেঘের অপচ্ছায়া দূরীভূত হবে না।

সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচন, ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন সংবিধানের ব্যত্যয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারটি অসাংবিধানিক হওয়া সত্ত্বেও এটিকে সাংবিধানিক বৈধতা দেয়ার কোনো প্রয়াস নেয়া হয়নি। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অসাংবিধানিক গণ্যে এর বাতিল-বিষয়ক মামলাটির আপিল শুনানিকালে অপ্রাসঙ্গিক আলোচনার অবতারণায় অযাচিতভাবে বিচার্য বিষয় না হওয়া সত্ত্বেও উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিচারিক রায়ে এটির বৈধতা দেয়া হয়। সাংবিধানিক বৈধতার অনুপস্থিতিতে এ ধরনের বৈধতা আদৌ গ্রহণযোগ্য কি না তা সময়ের পরিক্রমায় নির্ধারিত হবে।

দশম সংসদ নির্বাচনে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে উন্মুক্ত ১৫৪টি আসনের প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিল। এমন নির্বাচন যে সংবিধানের ব্যত্যয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এতে দ্বিমত পোষণের কোনো অবকাশ নেই। একাদশ সংসদ নির্বাচনে দেখা গেল, সংবিধান ও নির্বাচনী আইনের ব্যত্যয়ে দিনের ভোট নির্বাচন-পূর্ববর্তী মধ্যরাতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। উভয় নির্বাচনের সম্যক বিষয়ে দেশের সচেতন জনমানুষসহ বিশ্বের গণমাধ্যম ওয়াকিফহাল।
সংবিধান ও আইনের ব্যত্যয়ে অনুষ্ঠিত পর্যায়ক্রমিক তিনটি নির্বাচন দুঃশাসন, নৈরাজ্য, অব্যবস্থাপনার উন্মেষে দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ভিতমূলে যেভাবে আঘাত হেনেছে এটির লাগাম টেনে ধরতে না পারলে অনিবার্য বিপর্যয়ের হাতছানি থেকে রেহাই আদৌ সম্ভব হবে কি না তা ভেবে দেশবাসী উদ্বিগ্ন।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
Email : iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement

সকল