২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সিসিকে পরাস্ত করা যাবে না

নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সিসিকে পরাস্ত করা যাবে না - ফাইল ছবি

আরব বিশ্বে শাসকরা সচরাচর পদত্যাগ করেন না। যারা গণতন্ত্রকে বা নির্বাচনকে ব্যবহার করে ক্ষমতারোহণ করেন তারাও ক্ষমতা ছাড়তে চান না। মিসরের মরহু প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক ৩০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন, তার সময়ে কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু ছিল না। তার পতনে মূলত ব্রাদারহুডের আন্দোলনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ভোটে মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনিই মিসরের প্রথম নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি। আল সিসি তারই অধীনে সেনাপ্রধান হিসেবে কাজ করার শপথ নিলেও বহিঃশক্তির ইন্ধনে মুরসিকে জেলে পুরে বিনাচিকিৎসায় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেন এবং বন্দী অবস্থায় মুরসির মৃত্যু হয়। মুরসি ক্ষমতায় থাকতেই সিসি মুরসিকে ‘মূর্খ’ বলে ডেকেছিলেন।

ব্রাদারহুডকে নির্মমভাবে কোণঠাসা করার পর তিনি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নির্বাচনকে বেছে নেন। এমন একটি নির্বাচন যেখানে তিনি নির্বাচিত হবেন। সে জন্য তিনি প্রথম সুযোগেই সংবিধান সংশোধন করেন। সিসির কাছে, এই গণতন্ত্র বা নির্বাচন ক্ষমতা ধরে রাখার একটি কৌশল বা রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিচালনার এক আনুষ্ঠানিকতা। এবার তিনি প্রায় ৯০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন; মানে মিসরের তিন কোটি ৯০ লাখ ভোটার তাকে ভোট দিয়েছেন। তার বিরোধীরা, বিরোধী তিন নেতা প্রচারে বাধা, গণহারে গ্রেফতার করে নেতা ও সমর্থকদের জেলে পুরে রাখার অভিযোগ এনেছেন। এর আগের নির্বাচনগুলোতেও এরকম অভিযোগ হয়েছিল। তবে কোনো তদন্ত, পুনঃনির্বাচন এসব হয়নি। বলতে গেলে মিসরের লোকজন ধরেই নিয়েছে যে, আগের প্রক্রিয়ার মতো এবারো সিসি জিতবেন। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালেও সিসি এই প্রক্রিয়ায় জিতে যান। আগামী এপ্রিলে তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেবেন সিসি।

মিসরের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট পদে এটিই হবে তার শেষ মেয়াদ। তার হাতে সংবিধান সংশোধিত হয়ে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ চার বছর থেকে বাড়িয়ে ছয় বছর করা হয়, দুই মেয়াদের পরিবর্তে তিন মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার সুযোগ যুক্ত করা হয়। নির্বাচনের সময় তিনি হাজারখানেক বিরোধীকে জেল থেকে মুক্তি দেন। তবে তার চার-পাঁচগুণ মানুষকে নতুন করে জেলে বন্দী করে রাখা হয় এবং প্রায় সবার বিরুদ্ধে গায়েবি অপরাধের মামলা দেয়া হয়। কেন নির্বাচনে আল সিসি ৯০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন? বিরোধীরা কী বলেন? তারা অভিযোগ করেছেন সিসির সমর্থকরা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া, তারা যেতে চায় কি না, এ সবই নজরদারি করেছেন। কোথাও কোথাও ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে, নির্দেশনা না মানলে শাস্তি দেয়া হয়েছে। বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলো নির্বাচনে কর্মী সংগ্রহ করতে বাধ্য হয়েছে। ভোট না দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বার্ষিক গ্রেড হারানোর হুমকি দেয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট প্রার্থীকে ভোট দেয়ার জন্য দরিদ্র লোকদের অর্থ ও খাবার ঘুষ দেয়া হয়েছে।

মিসর বর্তমানে অর্থনৈতিক সঙ্কটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। দেশটিতে মুদ্রামানের ধারাবাহিক পতন এবং বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি ৩৬.৪ শতাংশে পৌঁছেছে। বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের আগেও মিসরের প্রায় ১০ কোটি ৬০ লাখ জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে। যারা বয়স্ক, পেনশনভোগী, সলিডারিটি ও ডিগনিটি সরকারি তহবিলের সুবিধাভোগী এবং দাতব্য সমিতি থেকে উপকৃত বিধবা, বিয়ে-বিচ্ছেদের সংহতিশীল গোষ্ঠী; এগুলো এমন গোষ্ঠী যা নির্বাচনের সময় খাদ্যদ্রব্যের বিনিময়ে বা তাদের আনুষঙ্গিক সাহায্য বন্ধ হওয়ার ভয়ে ভীত। এরা নিজে বাঁচার জন্য ভোটকেন্দ্রে যায়। যেকোনো প্রার্থী বিশেষ করে সরকার এদের ওপর সহজলভ্যতার কারণে বাজি ধরতে পারে। এদের একটি জনপ্রিয় সেøাগান হলো- ‘আসুন, কিছু পাওয়া যাক’। তাদের আক্ষেপও রয়েছে : পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পরিবহন বিলসহ সব সেবার মূল্যবৃদ্ধির সুরাহা কীভাবে হবে? আবু হুসাইন নামে একজন কাঠমিস্ত্রি ভোটার সাংবাদিকদের সামনে বলেন : ‘মিসরীয় পাউন্ডের (মিসরীয় ১০০ পাউন্ড সমান তিন ডলার) মূল্যের পতন, জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতির কারণে মিসরীয়রা ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে।’

ভোটারদের উৎসাহিত করতে দেশাত্মবোধক গান ও প্রচারমূলক বিজ্ঞাপন তৈরি করে প্রচারিত হয়েছে। কোথাও ভোট দিতে না গেলে জরিমানা করার হুমকি দেয়া হয়েছে সাধারণ নাগরিকদের। ফলে বিরোধী অনেক সংগঠন তাদের অস্তিত্ব ও নিশ্চিহ্ন হওয়া থেকে রক্ষার জন্য ভোট দিয়েছে। ভোটের দিনে সিসির কর্মীরা শত শত বাস ব্যবহার করে যা নির্বাচন বিধির লঙ্ঘন; এমনকি বিরোধী প্রার্থী ফরিদ জাহরানের প্রতিনিধিদের ভোট গণনায় উপস্থিত হতে বাধা দেয়া হয়েছিল।
নির্বাচনে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো তরুণ ভোটারদের অনুপস্থিতি, যারা দৃশ্যত নির্বাচন বয়কট করেছে। সম্ভবত, তারা উচ্চস্তরের বেকারত্ব এবং দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থার প্রতিবাদে অথবা নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের প্রতিবাদে এবং তরুণ প্রার্থী আহমেদ তানতাউইকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং তাকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধিকার হরণ করার জন্য বা সম্ভবত একসাথে এসব কারণে বয়কট করেছে। তরুণ ভোটারদের অংশগ্রহণের অভাব বৃহত্তর কায়রোর রাস্তায় এবং রাজধানীর আশপাশের এলাকাগুলোতে স্পষ্ট লক্ষ করা গিয়েছিল।

২০১১ সালের গণ-আন্দোলন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পর স্বৈরাচারী সরকারের পতন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সার্থক হলেও সিসি পুনরায় স্বৈরশাসন ও গণতন্ত্রকে নির্বাসন দিতে সমর্থ হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য কিছু দেশ সেনাশাসনকে সহায়তা দিয়ে পুষ্ট করেছে। আল সিসি ‘বিশেষ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়’ ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য গণতন্ত্রের ক্যাপসুল ব্যবহার করছেন। সে এক বিচিত্র গণতন্ত্র। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এই বিশেষ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছে। শক্তিধর গণতান্ত্রিক দেশগুলো সিসির পক্ষে থাকায় তাই তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। বিরোধীদের বিরুদ্ধে যাঁতাকলে যে নির্মম পেষণতত্ত্ব কাজ করছে সে অবস্থায় ‘ফ্রি ও ফেয়ার’ ভোট অসম্ভব বিষয় বলে সংস্থাগুলো সোচ্চার হয়েছে। মানবাধিকারবিষয়ক পরিচালক মাইকেল পেজ এক প্রতিবেদনে বলেছেন, ‘এর আগে শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থাকা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে দমননীতি পরিচালিত হয়েছিল। রাজনৈতিক কারণে ৬০ হাজার মানুষকে জেলে ঢুকানো হয়েছিল। জেলখানায় কয়েক শ’ মৃত্যুবরণ করেছিল।’

দেখা যাচ্ছে যে, কাক্সিক্ষত ফলাফল পাওয়ার জন্য রাষ্ট্র তার সব প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা অ্যাপারেটাস ব্যবহার করেছে। সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী ও প্রচুর আর্থিক মূলধন জোগাড়ের কারণে সিসির পক্ষে এসব কাজ আঞ্জাম দেয়া কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেনি। জনসংখ্যার একটি বড় অংশ নিশ্চিত হয়েছে যে, এটি আল সিসির জন্য একটি পূর্বনির্ধারিত বিজয়। পঙ্গু অর্থনৈতিক সঙ্কট সত্ত্বেও সিসির ভূমিধস বিজয় হয়েছে। গাজায় গণহত্যা বন্ধ করতে সরকারের অক্ষমতা চোখে পড়ার মতো। ইথিওপিয়ান গ্র্যান্ড রেনেসাঁ বাঁধ প্রকল্প ও নীল নদের ওপর প্রভাব সর্বোপরি মিসরীয় সভ্যতার ওপর আঘাত ঠেকাতে তিনি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেননি।

এই অর্থহীন নির্বাচনে অন্য তিন প্রার্থী ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রধান ফরিদ জাহরান, ওয়াফদ পার্টির প্রধান আবদেল সানাদ ইয়ামামা ও রিপাবলিকান পিপলস পার্টির প্রধান হাজেম ওমর; এই জাল নির্বাচনে কে রানার্সআপ হবেন জনগণকে তা কোনো উত্তাপ ছড়াতে পারেনি। মূলত এই নির্বাচন ছিল গত ১০ বছরের সাজানো পদক্ষেপ। সমালোচকরা বলছেন, ভোটারদের মূল উপস্থিতি ৪৫ শতাংশ মাত্র। বিরোধী জনগণ নিশ্চিত যে, এবার আল সিসি সংবিধানের আরো একহাত নেবেন এবং আরো বেশি দিন ক্ষমতা ধরে রাখার উপায়-উপকরণ তৈরি করবেন।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার
নিউম টাওয়ার, বান্দরবান পার্বত্য জেলা


আরো সংবাদ



premium cement