২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ফিলিস্তিন রাষ্ট্র নাকি ‘বাফার জোন’

ফিলিস্তিন রাষ্ট্র নাকি ‘বাফার জোন’ - নয়া দিগন্ত

অবাক করা বিষয়, নেতানিয়াহু গাজা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর একটি বাফার জোন তৈরির প্রস্তাব দিয়েছেন। গাজা যুদ্ধ আদৌ তাড়াতাড়ি শেষ হচ্ছে কি না বা কখন শেষ হবে এর কোনো আলামত কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তবে গাজাকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে জনমানবহীন করার পরিকল্পনার সাথে বর্তমান ইসরাইলি যুদ্ধপরিস্থিতির মিল রয়েছে। বাফার জোনটি কত বড় হবে বা কত লম্বা হবে তা এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে সেটি গাজা বা গাজার অংশ হবে তা নিশ্চিত। বাফার অঞ্চলটি উত্তর থেকে দক্ষিণ গাজা পর্যন্ত বিস্তৃ—ৃতি হবে মর্মে সূত্র গোপন রেখে রয়টার্স জানিয়েছে।

বাফার জোনের বিষয়টি জর্দান ও মিসরকে জানানো হয়েছে মর্মে রয়টার্স জানিয়েছে। বিষয়টি আমিরাত, অনারব তুরস্ক এমনকি সৌদি আরবকেও জানানো হয়েছে। তবে কিভাবে বার্তাটি রিয়াদে গেছে জানা যায়নি। বর্তমানে গাজা যুদ্ধ নিয়ে রিয়াদের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইলের সরাসরি যোগাযোগের চ্যানেল নেই। যুদ্ধ শেষ হলে ছিটমহলের প্রস্তাবের অংশ হিসেবে ও আক্রমণ প্রতিরোধের অংশ হিসেবে গাজার সীমান্তে বাফার জোন তৈরি করতে চায়। এটি এমন এক গরম সংবাদ যা ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত আরব মধ্যস্থতাকারী মিসর ও কাতারের বাইরে পৌঁছেছে। এখন পর্যন্ত, মিসর, ইসরাইলের সাথে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরকারী প্রথম আরব রাষ্ট্র এবং কাতার, যার সাথে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই তবে যোগাযোগের চ্যানেল খোলা রয়েছে। কাতার এই চ্যানেলের মাধ্যমে গাজায় এতদিন নগদ অর্থ ও ওষুধপত্র পাঠাত এবং বর্তমানে বন্দী বিনিময়ে মধ্যস্থতা করছে।

বাফার জোনকে এক কথায় নিরাপদ অঞ্চল বলা হয়। বাফার জোনের মাধ্যমে দুই বা আলাদা অঞ্চল সংযুক্ত হতে পারে। বাফার অঞ্চল মূলত অসামরিক বা অসামরিক সীমান্ত অঞ্চল এসব কিছু বোঝায়। দু’টি সার্বভৌম দেশ বাফার জোনের মাধ্যমে যুক্ত হতে পারে। তবে ভূ-রাজনৈতিক কারণে প্রকৃত অবস্থায় ভিন্নতা হতে পারে। ইসরাইলের এক সিনিয়র নিরাপত্তা সূত্র মতে, বাফার জোন ধারণাটি ‘পরীক্ষা করা হচ্ছে’, ‘এটি গাজার ভেতরে এক কিলোমিটার, দুই কিলোমিটার বা কয়েক শ’ মিটার হতে পারে, তবে এ মুহূর্তে পরিষ্কার নয়।’ ২০০০ সালে লেবাননের হিজবুল্লাহর সাথে যুদ্ধ এবং আক্রমণের পর ইসরাইল দক্ষিণ লেবাননে এক অঞ্চল খালি করেছিল, যেটি প্রায় ১৫ কিলোমিটার (১০ মাইল) গভীর ছিল।

গাজা স্ট্রিপ ৪১ কিলোমিটার বা ২৫ মাইল দীর্ঘ, ছয় থেকে ১২ কিলোমিটার (৩.৭ থেকে ৭.৫ মাইল) প্রশস্ত এবং এর মোট এলাকা ৩৬৫ কিলোমিটার (১৪১ বর্গমাইল)। এ ছোট ভূমিতে প্রায় ২.৩ মিলিয়ন (২৩ লাখ) ফিলিস্তিনির বসবাস। গাজা যুদ্ধে আজ পর্যন্ত কমবেশি ১৫ হাজার লোককে হত্যা করা হলেও আরব আমিরাত বা মিসর- কেউ স্বাভাবিকীকরণ চুক্তি বাতিল করেনি। বাফার জোনের পরিকল্পনা প্রসঙ্গে নেতানিয়াহুর অফিস জানিয়েছে, ইসরাইলকে নিরাপদ রাখতে বাফার জোন পরিকল্পনা তিন স্তরের হবে। এটি অনেক বড় একটি বিষয় যেমন- তিন স্তরের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে হামাসকে ধ্বংস করা, গাজাকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ ও ছিটমহল বা বাফার অঞ্চলকে উগ্রবাদীমুক্ত করা। সমালোচকরা বলছেন, গাজা সীমান্তে কি বাফার জোন হবে নাকি পুরো গাজা বা ফিলিস্তিন বাফার স্টেট হবে- সে প্রশ্নটি এমন একসময় উঠে আসবে যখন পিছু ফেরার কোনো সুযোগ থাকবে না। যেমনটি সাত দশক ধরে বিশ্ব নিশ্চুপ থাকার কারণে বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তেমন অবস্থা বা তার চেয়েও অমানবিক অবস্থায় চলে যাবে ফিলিস্তিন ও গাজা। এর মধ্যে আমিরাতের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘স্থিতিশীলতা ও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র অর্জনের জন্য সব পক্ষ সম্মত হওয়া সাপেক্ষে যেকোনো ব্যবস্থাকে সমর্থন করবে সংযুক্ত আরব আমিরাত।’

বাফার জোন বা বাফার স্টেট হবে নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়ার অংশ। আন্তর্জাতিক অংশীদারদের কাছে পরিকল্পনার বিষয়টি সরাসরি উত্থাপিত হয়েছে কি না সে বিষয়ে বিশদ বিবরণ সব পক্ষ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, মানে গরম কড়াইতে ঘি ঢালা বাকি আছে।

আরব রাষ্ট্রগুলো এখন বলছে, হামাসকে নিশ্চিহ্ন করা অসম্ভব, তারা সন্ত্রাসী তো নয়ই; বরং কোনো জঙ্গি সংগঠনও নয়। ফিলিস্তিনিদের প্রতীক এসব হামাসযোদ্ধা। দলে দলে সাধারণ ফিলিস্তিনিরা হামাসে যোগদান করছেন। হাতে অস্ত্র এলে যেকোনো যোদ্ধাদের সামনে ভয়াল হয়ে উঠেতে পারে সে প্রমাণ ইতোমধ্যে দেয়া হয়েছে। তাই ফিলিস্তিন সমর্থক সব গোষ্ঠী ও সরকার তাদের কাছে অস্ত্র পাঠাতে চায়। অস্ত্র প্রেরণের বিষয়টি আরো কয়েক দশক আগে থেকে শুরু হলে সমস্যা হয়তো এতদূর গড়াত না এবং সন্ত্রাসী বাহিনীর সামনে শুধু ইট-পাটকেল মেরে নিজেদের শেষ করতে হতো না।

ফিলিস্তিনিদের জন্য, পশ্চিমা সরকারগুলো নিজেরা ইহুদিবিদ্বেষী বোকামির মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে। নাৎসি হলোকাস্ট নৃশংসতার বিরুদ্ধে একটিও শক্তিশালী দেশ প্রতিরোধের জন্য হাত তোলেনি। ইহুদিবাদীরা এই অপরাধকে অবৈধ ডি ফ্যাক্টো উপাধিতে পরিণত করেছিল নিরীহ বাসিন্দাদের থেকে চুরি করা জমিজমা ও সম্পদ হাতিয়ে। ১৯৪৭-৪৮ সালের দিকে এই নিরীহ মানুষগুলো ইহুদিদের খাবার ও পানীয় সরবরাহ করেছিল। আজ তারাই গাজায় খাবার ও পানি আটকে দিয়ে তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।

ব্রিটিশ বেলফোর ডিক্লারেশনের সাথে ইহুদিবাদী প্রকল্প তুলে নেয়ার পরে, ব্রিটিশ সামরিক ও ইহুদি সন্ত্রাসী গেরিলাদের মধ্যে হাগানাহ, ইরগুন ও স্টার্ন গ্যাংয়ের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয় যখন ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শেষ হয় এবং হত্যাকারীরা ফিলিস্তিন আক্রমণ করে। এ গণহত্যায়, ইহুদিবাদীরা সাত লাখ নিরীহ ফিলিস্তিনিকে তাদের মাতৃভূমি থেকে বন্দুকের পয়েন্টে বিতাড়িত করে, লুণ্ঠন ও হত্যা করে।

ব্রিটিশরা পালিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে, যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণকারীদের হত্যা করে, ইহুদিবাদী সহিংসতার প্রতিটি ভয়াবহতাকে নীরবভাবে সমর্থন করে যা অদ্যাবধি শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত হচ্ছে। মুসলিম বিশ্ব সেটি থামানোর চেষ্টা করেছে, তবে সেখানে কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেই। বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠার জন্য ফিলিস্তিনি ভূমি ছাড়াও জর্দান, সিরিয়া এবং মিসরের ভূমি দখল ও ব্যবহারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তাও তিন যুগ পেরিয়ে গেছে। রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও বারবার হোঁচট খেয়ে সর্বপ্রথম মিসর নতজানু হয়ে আত্মসমর্পণ করেছে।

জায়নিজমের তথাকথিত ‘যুদ্ধ’ বিশ্বের কাছে বিক্রি করা হয়েছিল দরিদ্র, নির্যাতিত ইসরাইলের মরিয়া প্রতিক্রিয়া ও বীরত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা হিসেবে। আমেরিকান সরকার ও প্রেস সেগুলো নিশ্চিত করেছিল, এমনকি যখন আমেরিকার নিজস্ব সেনারাও ইসরাইলি সহিংসতার শিকার হয়েছিল।

ইসরাইলি যুদ্ধবিমানগুলো ইউএসএস লিবার্টিকে আক্রমণ করে এবং গুলি করে ধ্বংস করে, তারা জানত যে, এটি আমেরিকান গুপ্তচর জাহাজ, ছয় দিনের যুদ্ধে, ৩৪ নাবিককে হত্যা করা হয় এবং ১৭১ জন আহত হয়। ইহুদিবাদী হাই-কমান্ড এটিকে একটি ভুল বলে অভিহিত করে, মার্কিন সরকার এটি একটি ডাহা মিথ্যা জেনেও ‘বড়ি’ খেয়েছিল। এবারের গাজা যুদ্ধেও জাতিসঙ্ঘের মানুষ মরেছে তারাও পশ্চিমা দেশের লোকজন। আজ কথাগুলো এ জন্য বলা হচ্ছে যে- একটি পৈশাচিক শক্তিকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য কিভাবে আপন করে নিয়ে মানবতার টুঁটি চেপে ধরেছে তা বুঝানোর জন্য। কিভাবে দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া মজ্জাগত হয়েছে।

আরব দেশগুলোকে চেপে ধরার জন্য দুর্বৃত্ত পোষা যে কত বিপজ্জনক হতে পারে গাজা যুদ্ধ সেটি প্রমাণ করেছে। বাইডেনকে তার দেশের লোকজন সামনা সামনি গালাগালি করেছে। ব্লিংকেনের প্রতিটি সফর ব্যর্থ হয়েছে, ব্যর্থ হয়েছে বাইডেনের সফরও। প্রেসিডেন্টের কথার সাথে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের কথার কোনো মিল নেই। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি মুখথুবড়ে পড়েছে।

ইসরাইল নিজের সামরিক শৈলীর নিষ্ঠুরতার সমালোচনাকে এ যুক্তিতে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে যে, রাষ্ট্রের সমালোচনা নিন্দনীয় ‘ইহুদিবিদ্বেষ’। পেচানো এই বক্তব্য, হলোকাস্ট দ্বারা উদ্ভাবিত। সেই বীভৎস নাৎসি ভয়াবহতার পর থেকে ইহুদিবিদ্বেষ দর্শনকে মুসলিম বিশ্বে দৃঢ়ভাবে চাষ করা হয়েছে, যখনই ইহুদিবাদী সরকারগুলোর বর্ণবাদী সহিংসতার জন্য কভারের প্রয়োজন হয়, তখন তারা ফিলিস্তিনিদের উপর ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে। ‘বৃহত্তর ইসরাইল’ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলোর উপর আকস্মিক আক্রমণের ন্যায্যতা হিসেবে হলোকস্ট ব্যবহার করছে। ইসরাইল জর্দান উপত্যকা ও জেরুসালেমকে সম্পূর্ণ দখলের লক্ষ্যে কাজ করছে, এ পরিস্থিতিতে দুই রাষ্ট্র নয়, একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বও মেনে নেবে না। এ সত্য যত তাড়াতাড়ি আরব বা মুসলিম বিশ্ব বুঝবে ততই মঙ্গলজনক। বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য বাফার জোন বা বাফার স্টেট একটি সাময়িক পদক্ষেপ। বর্তমান গাজা যুদ্ধ জায়নিজমের লক্ষ্যে পৌঁছার এক সিঁড়ি যা ফিলিস্তিনি মানুষের বেদনাদায়ক নির্মমতা।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement