২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ভারতকে সামাল দিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে

ভারতকে সামাল দিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে - নয়া দিগন্ত

ভারত পরাশক্তি হয়ে উঠতে চায়, এটি নতুন কোনো খবর নয়। পরাশক্তি হতে যা যা করা দরকার সব করছে দেশটি। পরাশক্তি হতে যা দরকার, তার অনেকগুলো ভারতের আছে। বৃহৎ ভূখণ্ড, বিশ্বের সবচেয়ে বড় জনসংখ্যা, তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি, বিশাল সামরিক শক্তি ইত্যাদি। তবে ভিন্নমতের জায়গাও রয়েছে। সামরিক বাহিনীর আকার বড় হলেও দেশটি সমরাস্ত্রে স্বনির্ভর নয় এবং তা অর্জনের কাছাকাছিও নেই। ভারতের অর্থনীতি নানা হিসাবে বিশে^র তৃতীয় বৃহৎ বলা হলেও এটি নিশ্চিত নয়। এমনকি অর্থনৈতিক অর্জনের পক্ষে যেসব তথ্য-উপাত্ত ভারত সরকার প্রদর্শন করে তাও পুরো সত্য নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রাহ্মনিয়ান (২০১৪-২০১৮) তার “India’s GDP Mis-estimation: Likelihood, Magnitudes, Mechanisms and Implications” শীর্ষক গবেষণাপত্রে কোনোরকম রাখঢাক না করে সে কথা বলেছেন। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের সেই প্রকাশনা গুগল করলে যে কেউ পেতে পারেন। ভারতের অর্থনীতি যেহেতু আজকের আলোচনার বিষয় নয়, তাই এ নিয়ে বিস্তারিত বলছি না।

কোনো দেশের পরাশক্তি হওয়ার জন্য আরো কিছু অর্জন থাকা দরকার। যেমন, বৈশি^ক অঙ্গনে রাজনৈতিক প্রভাব এবং শক্তিশালী কূটনীতি। রাষ্ট্রীয়ভাবে সব নাগরিকের একটি অভিন্ন পরিচিতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ঔৎকর্ষও এক্ষেত্রে অন্যতম সূচক হতে পারে। ভারতীয়দের কোনো একক অভিন্ন পরিচিতি নেই। সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদির সরকার হিন্দুত্বকে জাতীয় পরিচয় হিসাবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। সব মানুষের ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয় মুছে দিয়ে হিন্দুত্বের ধারণায় লীন করে দেয়ার এ চেষ্টা কার্যত দেশটিকে চরম উগ্রবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। হিন্দুত্ব এখন যেভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে তা এটি মূলত হিংসা ও বিদ্বেষপ্রসূত একটি ধারণা হয়ে সবার কাছে ধরা দিচ্ছে। একই সাথে তা ধর্মীয় বিশ^াসে হিন্দু ছাড়া অন্য সব মানুষের সব অধিকার অস্বীকার করে। ফলে দেশটি ক্রমশ কথিত গণতান্ত্রিক মুখোশটুকু বর্জন করে নাৎসিবাদী বা ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করতে যাচ্ছে। তার লক্ষণ এরই মধ্যে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলিম বা খ্রিষ্টানদের প্রতি হিন্দুত্ববাদী বিজেপি বা আরএসএসের মতো উগ্র দলগুলোর গত দুই দশকের মারকুটে আচরণে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দেশটির সাম্প্রতিক অর্জন বেশ প্রশংসনীয় তা বলতে হবে। চন্দ্র অভিযানে সাফল্য মোটে অন্যূন নয়। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সাফল্য উল্লেখযোগ্য। আমেরিকার এ সময়ের বৃহত্তম প্রায় সব প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে ভারতীয়রা দাপটের সঙ্গে জায়গা করে নিয়েছেন। যদিও প্রযুক্তি পণ্যেও দেশটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। আর করোনার টিকা রফতানি করতে গিয়ে চরমভাবে পরাস্ত হয়েছে চীনের কাছে। সেইসাথে বলতে হয়, পরাশক্তি হয়ে সারা বিশে^ মোড়লি করবে কিন্তু নিজ দেশের মানুষ রাতে না খেয়ে ঘুমাতে যাবে, মাথা গোঁজার নিরাপদ আশ্রয় পাবে না, প্রয়োজনীয় পানীয়জলের অভাবে ভুগবে এমনটা হতে পারে না। অর্থাৎ জনগণের একটি ন্যূনতম জীবনমান নিশ্চিত করতে হবে। ভারত এদিক থেকে যোজন যোজন দূরে।

বৈশ্বিক অঙ্গনে রাজনৈতিক প্রভাব ভারতের খুব বেশি নেই। ব্রিকসে তার সক্রিয় ভূমিকা কিংবা জি-২০ তে সফল সম্মেলন অনুষ্ঠান এগুলো বাহ্যত বড় সাফল্য হলেও ভেতরের দুর্বলতাগুলো স্পষ্ট হয়েছে। সেই দুর্বলতা ঢাকার চেষ্টা হিসাবে দেশটি গায়ের জোরে এমন কিছু কাজ করেছে যা দুর্বলতা আরো চাউর করে দিচ্ছে। জি-২০ সম্মেলনের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে ভারতের মাটিতে টুঁ শব্দটি করতে না দেয়া অথবা কানাডার প্রধানমন্ত্রীকে নানাভাবে হেনস্তা করা, বলা যায়, সেই গায়ের জোর খাটানোর উদাহরণ। ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের পর নিন্দা না করে, গণতান্ত্রিক বিশ্বকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তাদের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন বটে। তাতে একটি বিষয় পাশ্চাত্যের কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে, দেশটি পাশ্চাত্যের পায়ে পা মিলিয়ে চলতে রাজি নয়। এতে করে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক বিশ্বের প্রতি ভারতের নিষ্ঠার অভাব পরিষ্কার হয়েছে।


গত জানুয়ারিতে ভারত ‘ভয়েস অব দ্য গ্লোবাল সাউথ শীর্ষ সম্মেলনের’ আয়োজন করে অনলাইনে। এর মধ্য দিয়ে দেশটি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে নিজের ভূমিকা জোরদার করার আকাক্সক্ষার জোরালো প্রকাশ ঘটায়।

ভারত বলেছে, ১২৫টি উন্নয়নশীল দেশ ওই সম্মেলনে অংশ নেয়। উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘আপনার কণ্ঠ ভারতের কণ্ঠস্বর এবং আপনার অগ্রাধিকার ভারতের অগ্রাধিকার। আমাদের লক্ষ্য হলো ভয়েস অব দ্য গ্লোবাল সাউথকে প্রসারিত করা।’ কিন্তু আমরা যদি কেবল দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্কের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনা দেশে ভারতের কোনো অবস্থান নেই। বাংলাদেশেও শুধু সরকারের সাথে ভারতের সুসম্পর্ক সীমাবদ্ধ, যে সরকারটি দুর্বল এবং ক্ষমতায় টিকে থাকতে ভারতের ওপর নির্ভরশীল। এমনকি মালদ্বীপের মতো ছোট দেশ থেকেও এখন ভারতকে সেনা সরিয়ে আনতে হচ্ছে। নিজের আঞ্চলিক সীমার মধ্যে এমন একটি অসফল কূটনীতির দেশ কিভাবে গ্লোবাল সাউথের কণ্ঠস্বর হবে বোঝা মুশকিল। বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার গলা টিপে ভারত যেভাবে একটি অজনপ্রিয় ও দুর্নীতিপরায়ণ সরকারকে উপর্যুপরি ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে প্রকাশ্যে কলকাঠি নাড়ছে তাতে মোদির বক্তব্য যে নিছক কথার কথা তা স্পষ্ট।

ভারত শুধু তার গণতান্ত্রিক মুখোশ খুলে ফেলছে তা-ই না, বরং দেশটি ক্রমশ আন্তর্জাতিক রীতিনীতি উপেক্ষা করতে শুরু করেছে। কানাডার মাটিতে শিখদের খালিস্তান আন্দোলনের নেতা নিজ্জরকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। প্রকাশ্যে সেই অভিযোগ তোলায় শিষ্টাচারবহির্ভূত প্রতিক্রিয়া দেখায় দেশটি। কিন্তু ঘটনা সেখানে থেমে থাকেনি। সম্প্রতি খোদ যুক্তরাষ্ট্রও অভিযোগ করেছে, সে দেশের মাটিতে একজন শিখ নেতাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল ভারত। সেই চক্রান্ত নস্যাৎ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের পর কানাডার সাথে যেমনটা করেছিল সেরকম আচরণ করার হিম্মত দেখাতে পারেনি মোদি সরকার। কারণ পরাশক্তি হওয়ার বাসনা পূরণে তার দরকার যুক্তরাষ্ট্রকে। কিন্তু সেই আকাক্সক্ষা কতটা পূরণ হবে বলা মুশকিল।

ভারত যে, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এবং চীনের চেয়েও বড় চিন্তার কারণ হয়ে উঠতে পারে সে হিসাব অনেকে এরই মধ্যে করছেন।
দ্য নিহন কেইজাই শিম্বুন বা নিক্কেই হলো অর্থনীতিবিষয়ক বিশে^র বৃহত্তম দৈনিক। প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ প্রচারসংখ্যার দৈনিকটি গত ২৯ জানুয়ারি এক নিবন্ধে স্পষ্ট করে বলেছে, ‘ভারত এমন একটি পরাশক্তি হতে চাইছে যা চীনকে গ্রাস করতে পারে।’
নিবন্ধে বলা হয়, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের কর্মকাণ্ড থেকে মনে হচ্ছে যে শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশটি গণতন্ত্র থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যদি একবিংশ শতাব্দী চীনের পরিবর্তে ভারতের যুগে পরিণত হয়, তাহলে বিশ্ব নিজেকে এমন এক নতুন পরাশক্তির সাথে মোকাবিলা করতে দেখবে যা (চীনের চেয়ে) কম ঝামেলার নয়।’

আশির দশক থেকে চীনের উত্থানের সময় প্রধান পশ্চিমা শক্তিগুলো ধরে নেয় যে, বৈশ্বিক অর্থনীতির সাথে একীভূত হলে এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ ঘটলে উদীয়মান শক্তি চীন শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হবে। কিন্তু পাশ্চাত্যের বিশ্লেষণ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। চীন গণতন্ত্রের দিকে আসেনি বরং বিশে^র দেশে দেশে একনায়কতান্ত্রিক শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে শুরু করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক বিশ^ব্যবস্থার প্রতি হুমকি।

ভারতের ক্ষেত্রে সেই একই ভুল করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ওবামার সময় থেকে চীন ঠেকানোর নামে ভারতকে পেয়াদা বানিয়েছে দেশটি। কিন্তু চীনকে ঠেকানো নয়, পেয়াদার দায়িত্ব পেয়ে ভারত নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ বানানোর চেষ্টায় উঠে পড়ে লেগেছে। আমেরিকাতে একটি জরিপে দেখা যায়, বেশির ভাগ ভারতীয় চীনের পর আমেরিকাকে বৃহত্তম সামরিক হুমকি হিসাবে দেখে। বৈশ্বিক বিজনেস ইন্টেলিজেন্স কোম্পানি মর্নিং কনসাল্ট এ জরিপ করে। গত ১৭ জানুয়ারি তা বিশ্বখ্যাত ব্লুমবার্গ পত্রিকায় প্রকাশ পায়।

আমেরিকার পিঠ চাপড়ানো পেয়ে ভারত এখন নিজের দেশের মানুষের সব অধিকারও পদদলিত করার সাহস দেখাচ্ছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলিমদের মানবাধিকার হরণের চেষ্টা করে ক্ষান্ত হয়নি, এখন তাদের নির্মূল করার প্রকাশ্য ঘোষণা দিচ্ছেন বিজেপির নেতাকর্মীরা।
তবে আশার কথা, ভারতের এসব কর্মকাণ্ড সম্ভবত আমেরিকার নজর এড়ায়নি। বাইডেন প্রশাসন ভারতের চোখে দক্ষিণ এশিয়া দেখার পুরনো নীতি বর্জন করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে নম্রভাবে হলেও বলতে শুরু করেছে। আর ভারতের মুসলিমদের বিরুদ্ধে অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ না হলে ভারত বিভক্ত হয়ে যাবে বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পাশ্চাত্যের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে ভারতের মতো দোদেল বান্দা দিয়ে কাজ হবে না। আমাদের ধারণা, চীন নয়, বরং ভারত হয়তো আমেরিকার জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সেই সক্ষমতা অর্জনে যতটুকু সুযোগ নেয়া যায় সেটুকু নিচ্ছে ভারত আমেরিকার বন্ধু সেজে।

অদূর ভবিষ্যতে এমন হতে পারে যে, যুক্তরাষ্ট্রকে হয়তো ভারতের মোকাবেলা করতে হবে। কারণ, ভারত ব্রিকসের মাধ্যমে রাশিয়া ও চীনের বলয়ে থেকে যেতে পারে। যেমন চীনের সাথে একই সঙ্গে মিলেঝুলে আছে বাংলাদেশে ও মিয়ানমারে।

mujta42@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement