২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


নির্বাচন না শবে বরাতের উৎসব

মুজতাহিদ ফারুকী - নয়া দিগন্ত

দেশে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা আগামী ৭ জানুয়ারি। গত এক দেড় বছর ধরে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত প্রশ্ন ছিল, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ হবে কিনা। গোটা জাতি এবং বাংলাদেশের সুহৃদ বিভিন্ন দেশ এ বিষয়ে তাদের আগ্রহের কথা বলে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র রীতিমতো চাপ দেয়ার পর্যায়ে। তার সাথে সুর মিলিয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও অন্য মিত্ররাও। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে শুধু অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিই জানায়নি। তারা মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের অধিকার নিশ্চিত করাসহ গণতান্ত্রিক অনুশীলনের দাবিতে সক্রিয় থেকেছে। প্রথমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও তার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। পরে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ নিয়ে সরকার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই বিরূপ হয়ে ওঠে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সরাসরি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ সরকার। তবে দেশের জনগণ আবার এমন দ্বন্দ্বের সাথে নেই।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কথাবার্তায় কিছুটা সংযত রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে হামলা ও হুমকির মুখে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের ছুটিতে যাওয়ার পর বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ কিছুটা যেন ঝিম ধরেছিল। বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে উপর্যুপরি হরতাল অবরোধ পালন করছে। অপর দিকে চলছে গ্রেফতার, মামলা ও রাষ্ট্রের স্তম্ভের কাঁধে বন্দুক রেখে হরদম চলছে পাখি শিকার। অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের সাজা দেয়ার নিপুণ প্রক্রিয়া। পুড়ছে গাড়ি, ঘটছে একের পর এক গুপ্তহত্যা। আততায়ী ধরা পড়ছে না। পুলিশ কাদের পক্ষে কাজ করে, কোন কোন অপরাধীকে ছাড় দেয়, খুঁজে পায় না সেটা দেশবাসী ভালো করেই জানে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদারের অত্যাচারে এক কোটি মানুষ দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিয়েছিল। এবার আওয়ামী পুলিশের নির্যাতনে সারা দেশে বিএনপি-জামায়াতের এক কোটি নেতা-কর্মী ঘরে থাকতে পারছে না। তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

এদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও তার জোট এবং অনুগত জাতীয় পার্টিসহ কিংস পার্টি বলে কথিত ভুঁইফোড় দলগুলো নির্বাচনী আবহ তৈরিতে ব্যস্ত। আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের আণুবীক্ষণিক অস্তিত্বের দলগুলোর কার্যালয় এখন সরগরম।

১০-১৫ বছর আগেও শবেবরাতের রাতে ঢাকার মসজিদ ও গোরস্থানগুলোতে ফকির-মিসকিনদের বিরাট ভিড় জমত। সে রাত ছিল ওদের উৎসবের মতো। দূরের ও কাছের সব মিসকিন হাজির হতো ঢাকায়। ভিড়ের চাপে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ, আজিমপুরের গোরস্তানসহ সব মসজিদ ও কবরগাহের আশপাশের রাস্তায় চলাচলের উপায় থাকত না। শৌখিন পাজামা-পাঞ্জাবি পরা মৌসুমি নামাজিরা শুধু নয়, সব শ্রেণীর মানুষই রাত জেগে এবাদত বন্দেগির পাশাপাশি হাত খুলে দান-খয়রাত করতেন। ফকিরদের থালা-বাটি উপচে পড়ত টাকা-পয়সার চালানে। অন্তত এক রাতের জন্য ওদের বরাত খুলে যেত।

সেই একই রকম ভিড় এখন সরকারপন্থী ছোট ছোট দলের অফিসে। নির্বাচন এখন শবেবরাতের রাতের মতো উৎসবের মৌসুম। মিসকিনদের কাছে সে রাত যেমন ছিল আয় রোজগারের মৌসুম, তেমনি এবারের নির্বাচনও কথিত দলগুলোর জন্য টুপাইস কামিয়ে নেয়ার মওকা এনে দিয়েছে। কিংস পার্টিগুলোর আয়-রোজগার কেমন হচ্ছে তা নিয়ে কারো তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সবাই কিছু না কিছু পাবে। এটাই বা কম কি? কিন্তু সেই হালুয়া-রুটির লাইনে দাঁড়িয়ে সবচেয়ে ধিকৃত মিসকিনের পরিচয় পেয়েছেন বিএনপি জোটের শরিক কল্যাণ পার্টির প্রধান মেজর জেনারেল অব. সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম। তিনি ভাগে কত পেয়েছেন তা এখনো জানা যায়নি। কেউ বলেন, ১০ কোটি, কেউ ৩০। অঙ্কটা অনেককে বিস্মিত করেছে; কারণ, এত কম রেটে তিনি নিশিকুটুম্ব বা এমবেডেড পার্টনার হবেন তারা ভাবতে পারেননি।

নির্বাচন কেমন হবে সেই প্রশ্ন এখন আর মাঠে নেই। এ প্রশ্নের উত্তর সবারই জানা। সম্প্রতি দেশের অন্যতম একটি দৈনিকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এক উপদেষ্টা। তিনি অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সমাজবিজ্ঞানী ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। বলেছেন, ‘প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচন দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কট তৈরি করবে।’ আমরা তার কোনো মন্তব্য পাঠককে শোনাতে চাই না। বরং পত্রিকাটির সাংবাদিক তাকে যেসব প্রশ্ন করেছে তারই একটি তুলে ধরতে চাই। সাংবাদিক প্রশ্ন করছেন, ‘সবারই প্রত্যাশা ছিল, এবার একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে। সরকারি দলের নেতারাও বলেছিলেন, তারা ২০১৪ ও ২০১৮-এর মতো নির্বাচন চান না। এরপরও আমরা সে ধরনের নির্বাচন পেলাম না কেন?
এ প্রশ্নেই আগামী নির্বাচন কেমন হতে যাচ্ছে তা স্পষ্টভাবে বিধৃত। অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আশা আর নেই।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল সোমবার বলেছেন, ‘দেশের অর্থনীতি ও পোশাক শিল্প বাঁচাতে হলে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে।’ জানা মতে, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে সংবিধান অনুযায়ী সম্পূর্ণ অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন করা, যেখানে কারচুপি, জালিয়াতি, ভয়ভীতিমুক্ত পরিবেশে প্রতিটি ভোটার তার পছন্দের প্রার্থীকে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন। যেখানে যোগ্য নাগরিকদের প্রত্যেকেই প্রার্থী হতে পারবেন, প্রার্থী হিসাবে প্রচার-প্রচারণায় প্রত্যেকে সমান সুযোগ-সুবিধা পাবেন, কেউ নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘন করলে নির্বাচন কমিশন কঠোর ব্যবস্থা নেবে, যাতে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কেউ অন্যায় প্রভাব বিস্তার করতে না পারে কিন্তু সেই দায়িত্ব ইসি পালন করছে না। এখানে ড. জিল্লুর রহমানের সাক্ষাৎকার থেকে সামান্য অংশ পাঠকের জন্য তুলে দিচ্ছি। হোসেন জিল্লুর বলেন, ‘খবরে দেখলাম, নির্বাচন কমিশনের যে আইনি ক্ষমতা আছে, তা প্রয়োগে তারা অনীহ। এটাকে আমি বলি স্বেচ্ছা নিষ্ক্রিয়তা। আপনার সামনে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে আপনি যদি নিষ্ক্রিয় থাকেন, সেটা তো দায়িত্ব পালন করা হলো না। ভোট দেয়ার গোপনীয় স্থান, যেখানে ভোটার ছাড়া অন্য কারো উপস্থিত থাকার কথা নয়, সেখানেও বাইরের লোক এসে সিল মারে। এটা না দেখাও নিষ্ক্রিয়তা।’

এই রকম নিষ্ক্রিয় একজন সিইসিকে দেশের অর্থনীতি ও পোশাক শিল্প বাঁচানোর দায়িত্ব কে দিলো বুঝতে পারছি না। তিনি নিজের দায়িত্ব ছেড়ে কেন প্রধানমন্ত্রীর বা সরকারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন সেটিও বোধগম্য নয়। নিতে পারেন একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে, কিন্তু তা নিজের দায়িত্বটা ঠিকঠাক পালনের পর নিলেই ভালো হতো না!
নিজের দায়িত্ব পালনে সক্ষমতার বিষয়ে সিইসির আক্ষেপ শুনলে হাসি চেপে রাখা অনেকেরই মুশকিল হতে পারে। গত বৃহস্পতিবার ‘নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি’র সদস্যদের প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে সিইসি হাবিবুল আওয়াল বলেন, ‘অতি সম্প্রতি আমরা খুব কষ্ট পেয়েছি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং লক্ষ্মীপুরে, ওখানেও সিল মারা হয়েছে। আমরা সেটা প্রতিহত করতে পারি নাই। আমাদের প্রশাসন পারেনি। আমাদের নির্বাচন কর্মকর্তারা পারেনি। এটা লজ্জাস্কর।’

ঘটনাটি লজ্জাকর বলে স্বীকার করলেও তা নিছকই কথার কথা। অত লজ্জাশরম থাকলে তিনি কী করে ওই দুটি উপনির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করতে পারেন? কীভাবে একজন লজ্জিত মানুষ কিছুই করতে না পেরেও নির্লজ্জের মতো পদে বসে থাকতে পারেন?

আসলে ব্যর্থতা স্বীকারের পরও পদ ধরে রাখা কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব। সিইসি খাঁটি বাঙালি তাতে সন্দেহ নেই। এখানে নির্লজ্জ বেহায়ারাই রাজনীতির মাঠ দখল করে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখে। তারা দৃশ্যমান সব ব্যর্থতা অস্বীকার করে গলা ফাটিয়ে শতমুখে নিজের সাফল্যের দাবি সম্প্রচার করে। বিএনপির সময়কার ইমার্জিং টাইগার বাংলাদেশকে যারা ১৫ বছরে নির্বিচার লুটপাটে ছিবরে করেছে, দেশের অর্থনীতিকে শোচনীয় অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে তারাই উন্নয়নের সবচেয়ে বড় দাবিদার। অর্থনীতির প্রতিটি সূচক যখন দ্রুত নিম্নমুখী, দেশ দেউলিয়া হয়ে পড়ে কি না এমন জল্পনা অর্থনীতিবিদদের মুখেই শোনা যাচ্ছে, তখন সিইসি মনে হয় সরকারকে উদ্ধারের দায়িত্ব নিয়েছেন। উপরে তার বক্তব্যের যে উদ্ধৃতি দিয়েছি তার আগে তিনি আরো কিছু কথা বলেছেন। বলেছেন, আমাদের নির্বাচনে কিন্তু বাইরের থাবা এসে পড়েছে। আমাদের অর্থনীতি, আমাদের ভবিষ্যৎ অনেক কিছু রক্ষা করতে হলে নির্বাচনটাকে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে হবে।

এই মন্তব্যে একটি পরিষ্কার বার্তা তিনি সরকারকে দিতে চেয়েছেন। সেটি পাঠকের কাছে অস্পষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থেকে বাঁচতে হবে। বাঁচতে হলে নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হবে। কিন্তু এই উপলব্ধি সিইসির হলে লাভ কী? যিনি নিজের দায়িত্ব পালনে অক্ষম তিনি কীভাবে সরকারকে বলেন, এবার কারচুপি, কারসাজি, নৈশভোট ইত্যাদি করতে যাবেন না। করলে বিপদ হবে!

নির্বাচন সামনে রেখে সরকার যে বেপরোয়া দমন নিপীড়নের পথ নিয়েছে সেটি তার একমাত্র বৈদেশিক মিত্রকেও ভাবিয়ে তুলেছে। এর প্রতিফলন ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাম্প্রতিক সম্পাদকীয় নিবন্ধ। ‘বাংলাদেশ-ভারতের স্বার্থে হাসিনাকে থামানো উচিত’ শিরোনামের ওই নিবন্ধে তাদের মতো করে হাসিনার পীড়ননীতির পরিণতি ব্যাখ্যা করা হয়। সে নিয়ে আমাদের ভাবনার কারণ নেই।

আমরা বরং আমাদের কথাই ভাবি। নির্বাচনের দেড় মাসেরও কম সময় আগে এখনো কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, নির্বাচন আদৌ হবে কী? আমরা জবাব দিতে পারি না। চুপ থাকি। কারণ, নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হঠাৎ উচ্চবাচ্য পরিহার কেমন এক থমথমে পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ঝড়ের আগে যেমন হয়। আকাশজুড়েই তো ঘন কালো মেঘের ঘনঘটা।

mujta42@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement