২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইসরাইল সৃষ্টিতে জাতিসঙ্ঘ

ইসরাইল সৃষ্টিতে জাতিসঙ্ঘ - নয়া দিগন্ত

ফিলিস্তিন ২০ শতকের শুরুতেই ইসরাইলে পরিণত হয়। স্থানটি তুর্কি উসমানী খেলাফতের অংশ ছিল। ১৮৯৬ সালে জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশ ছিল আরব তাদের হাতে ফিলিস্তিনের ৯০ শতাংশ জমির মালিকানা ছিল। সাগর তীরবর্তী স্থানটির লোকজনের ভাষা সুমিষ্ট ছিল। নিকট অতীতে আমরা দেখেছি তারা উচ্চৈঃস্বরে কথা বলত না এবং নোঙরা ভাষা ব্যবহার করত না।
সুইস শহর বাসেলে ১৮৯৭ সালে জায়নবাদী ইহুদি কংগ্রেস ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়। ঘটনার ১০ বছর পর ১৯০৭ সালে ব্রিটেন ঔপনিবেশিক সম্মেলনে মধ্যপ্রাচ্যে একটি বৈরী শক্তি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয় যাতে শক্তিশালী তুর্কি সাম্রাজ্য ও মধ্যপ্রাচ্য অশান্তির আঁধারে ঢাকা পড়ে। এই ষড়যন্ত্র ব্রিটেন ও জায়নবাদী ইহুদিকে একত্রিত করে। এরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কারসাজি করে উসমানী সাম্র্রাজ্যের পতন ঘটায়। এ জন্য তুরস্কের সামরিক প্রধান বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। পরিকল্পনা অনুসারে প্যালেস্টাইনকে ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ বাধ্যতামূলক কর্তৃপক্ষের অধীনে আনা হয়, যাতে ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইহুদিদের অভিবাসনের পথ প্রশস্ত হয়।

ফিলিস্তিনিরা প্রতিরোধ করে। অভিবাসী ইহুদিরা মেনাচেম বেগিন, আইজাক শামির এবং এরিয়েল শ্যারনের নেতৃত্বে হাগানা, স্টার্ন, ইরগুন এবং জাই লিউমের মতো সন্ত্রাসী ব্রিগেড গঠন করে এবং ফিলিস্তিনিদের গ্রামে গ্রামে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে যা এখনো চলমান।
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ ধ্বংস করার জন্য মেনাচেম বেগিন হত্যা খুনের তাণ্ডব চালিয়ে শত শত নিরীহ ফিলিস্তিনি পুরুষ, মহিলা ও শিশুকে হত্যা করেছিল। মেনাচেম বেগিন ১৯৭৮ ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির কারণে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। সিমন প্যারেজও মধ্যপ্রাচ্যে ভ্রাতৃত্ব ও শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য ১৯৯৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান।
জেরুসালেম থেকে কয়েক মাইল দূরে ডের ইয়াসিন একটি গ্রাম। সেখানে গণহত্যা চালানো হয় যা মানবতার বিরুদ্ধে সঙ্ঘটিত বর্বর অপরাধগুলোর অন্যতম। এই গণহত্যাকে ভিয়েতনামের লাইমাই গণহত্যার সাথে তুলনা করা যায়। অসহায় ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদকে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ নিষ্ঠুরভাবে দমন করে। নিজ দেশ থেকে ফিলিস্তিনিদের জীবন শরণার্থী শিবিরে মিশে যায়। সেই দৌড় ও আশ্রয়ের সন্ধানে এখনো উত্তর গাজা থেকে দক্ষিণ গাজায় ও রাফা ক্রসিংয়ে অব্যাহত রয়েছে। হারাচ্ছে পূর্ব জেরুসালেম ও পশ্চিম তীরের বাসস্থান। নেতানিয়াহু সেদিন ঘোষণা দিলেন, যারা আমাদের শত্রু তাদের নিশ্চিহ্ন করতে হবে। জানুয়ারিতে তেলআবিবে তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের তাড়াতে আমরা পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করব। জনগণ করতালি দিয়ে সে কথাকে স্বাগত জানায়। ইসরাইলের পরমাণু অস্ত্র এমন এক গোপন বিষয় যা সবাই জানে। ইহুদিদের আগমনের পর পরিকল্পনা মতো ইহুদিবাদীরা ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করার জন্য জাতিসঙ্ঘকে ব্যবহার করে।

১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান জাতিসঙ্ঘে বিভক্ত করার প্রস্তাব পাস করে অভিবাসী ইহুদিদের ফিলিস্তিনে একটি রাষ্ট্রের প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রেও ১,০০৮,৯০০ জনসংখ্যার মধ্যে আরবদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আরব-ইহুদি অনুপাত ৫০৯,৭৮০ থেকে ৪৯৯,০২০ ছিল।

ব্রিটিশ হাইকমিশনার ১৯৪৮ সালের ১৪ মে, জেরুসালেম ছেড়ে ব্রিটেনে ফিরে যান, পরের দিন ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণার জন্য রাস্তা খোলা ইসরাইলিরা পরদিন ১৫ মে অপেক্ষা না করে বিকেল ৪টায় বেন গুরিয়েন তেল আবিবে সব স্বীকৃত নৈতিক ও আইনি নিয়ম লঙ্ঘন করে ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা করেন। জাতিসঙ্ঘের বিভাজন প্রস্তাব দ্বারা ইহুদিবাদীদের জন্য বরাদ্দ করা দেশের তুলনায় অনেক বড় অংশ নিজেদের দখলে নেয়।
এটি ছিল অমানবিক শক্তির ফল, যা জাতিসঙ্ঘের সনদ, মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা এবং সেই রেজ্যুলিউশনের নীতি লঙ্ঘন করে তৈরি করা হয়েছিল যার অধীনে ইসরাইলিরা এখন সার্বভৌমত্ব দাবি করে। ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের ঘোষণার মাত্র ১৫ মিনিট পর, হোয়াইট হাউজ থেকে স্বীকৃতি আসে। ক্রেমলিনও ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

নির্মম পরিহাস, ইসরাইলি বাহিনীকে প্রতিরোধ না করে আরব সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনিদের নিরস্ত্র করতে শুরু করে। সিরিয়া, জর্দান, লেবানন ও ইরাকি সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত সম্মিলিত আরব বাহিনী ২৪ হাজারের বেশি ছিল না। সেনা দলগুলো সব কয়টি বিশৃঙ্খল এবং তাদের অস্ত্র ছিল পুরোনো। প্রয়োজনের সময় অনেক অস্ত্র কাজ করত না।
আরব বাহিনীর বিপরীতে ইহুদি সেনাবাহিনীর সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার। এরা ইউরোপীয় ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রশিক্ষিত ও সুসজ্জিত। সব দিক দিয়েই এটি অসম যুদ্ধ ছিল। সেই সময়ে ব্রিটিশ সমর্থিত ইসরাইলি বাহিনীর নিষ্ঠুর অভিযান সত্ত্বেও ৮২ শতাংশ ভূখণ্ড ফিলিস্তিনিদের হাতে ছিল।

১৯ মে, ইসরাইলিরা পুরোনো জেরুসালেম দখল করে। কিন্তু জর্দানি বাহিনী এবং জর্দান মুসলিম ব্রাদারহুডের হস্তক্ষেপের কারণে, ইসরাইলি বাহিনী বিশেষ সুবিধা পায়নি।
২২ মে, জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়। পরাশক্তিগুলো এই বিরতি মেনে নিতে আরব দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করে। জেরুসালেমের অভ্যন্তরে অবরুদ্ধ এক লাখ ইসরাইলি সেনার সাথে যুদ্ধবিরতি আহ্বান করা হয়েছিল। এভাবে আরব লিগের পৃষ্ঠপোষকতায় প্যালেস্টাইনের স্যালভেশন আর্মি পিছু হটলেও ইসলামী সেনা ও স্বেচ্ছাসেবকরা যুদ্ধ চালায়।

মিসরীয় বাহিনী বিরসেবা, গাজা ও নেজেভের কিছু অংশ দখল করে, তখন মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের বাহিনী জেরুসালেম অবরোধে অংশ নিয়েছিল। ইরাকি সেনাবাহিনী জেনিন পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়, জর্দানের সেনারা পশ্চিম সেক্টরে ইসরাইলি বাহিনীকে ঘিরে ফেলে পুরোনো জেরুসালেম নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। তারা জেরিকো মুক্ত করে, জেরুসালেম আক্রমণ করে এবং লিড্ডা ও রামাল্লার কাছে শিবির স্থাপন করে। যুদ্ধবিরতির পর ব্রিটিশ জেনারেল বলেছিলেন : আরবরা যদি তাদের বাহিনীকে কাজ শেষ করতে দিত (অর্থাৎ যুদ্ধ বিরতি না হতো) ১৫ মে যুদ্ধ চালিয়ে যেত তাহলে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারত না।
এরপর থেকে ইসরাইল বারবার যুদ্ধ, গণহত্যা, নিপীড়ন, আক্রমণের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যকে হত্যাযজ্ঞের মঞ্চে পরিণত করে। ১৯৫৬ সালে ইসরাইল, ব্রিটেন ও ফ্রান্স শক্তিশালী মিসর আক্রমণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনে ইসরাইল ১৯৬৭ সালে সিনাই, গাজা, দক্ষিণ লেবানন, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুসালেম ও গোলানহাইট আক্রমণ করে দখল করে নেয়।

এর পর থেকে ইসরাইল জাতিসঙ্ঘের সব রেজ্যুলিউশন লঙ্ঘন করছে এবং এটি বিশ্বের সবচেয়ে নিন্দিত দেশ। জাতিসঙ্ঘের নিযুক্ত কমিটি নিজেই ইসরাইলকে যুদ্ধাপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করেছে। ইরাক, লিবিয়া ও ইরানের মতো ইসরাইলের ওপর জাতিসঙ্ঘের কোনো নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়িত হয়নি। এবারো নিরাপত্তা পরিষদ যখন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস করে তখন নেতানিয়াহু বললেন, গাজায় স্থল আক্রমণ শুরু হবে এটি যুদ্ধের দ্বিতীয় ধাপ। আরো দুঃখের বিষয় ইসরাইলের ওপর কি ব্যবস্থা নেয়া হবে এ বিষয়ে আরব দেশগুলোও ঐকমত্যে পৌঁছেনি। বিগত ৭০ বছর ধরে এই নাটকই বারবার মঞ্চস্থ হচ্ছে।

আমেরিকা ও ইউরোপের প্রকাশ্য সমর্থনে ইসরাইল সব অপরাধ ও অনাচার থেকে বেরিয়ে আসে। মুখে নিন্দাবাদ জানালেও কাজের সময় সবাই এক। তারা সবাই মনে করে এখন দরকার ইসরাইলের নিরাপত্তা, তাদের বেঁচে থাকার অধিকার, ফিরে আসার অধিকার ইত্যাদি। ফিলিস্তিনিদের বিভিন্ন সংস্থা বহু বিশ্ব সভার সংস্থায় প্রবেশের অনুমতি নেই। এই সব বিদেশী ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সামগ্রিক ইহুদি স্বার্থের জন্য কথা বলে। ফিলিস্তিনিদের হত্যা, বাড়িঘর ধ্বংস, জমি দখল এগুলো ইসরাইলিদের রুটিন কর্মসূচি।
ইসরাইল, জাতিসঙ্ঘের ১২৫টির বেশি রেজ্যুলিউশনসহ সবচেয়ে নিন্দিত দেশ। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও বাইরের অনেক অঞ্চলে অস্থিতিশীলতার একমাত্র উৎস হয়ে উঠেছে ইসরাইল ও জিয়নিজম। মার্কিন ও ইউরোপীয় সমর্থনের কারণে ইহুদিবাদী অপরাধের মুখে জাতিসঙ্ঘ অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

ফিলিস্তিনিদের কাছে যাওয়ার মতো কেউ কি আছে? আরব রাষ্ট্রগুলো ইসলামী বাহিনী গঠন করে যুদ্ধ করতে না চাইলে তাদের অস্ত্র দিতে পারে। যুদ্ধের সরঞ্জাম দিতে পারে। ৭০ বছর ধরে ফিলিস্তিনি যুবকরা পাথরের টুকরা নিক্ষেপ করেছে। তাদের অস্ত্র দিলে পরিস্থিতি অন্য দিকে গড়াত। দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য যারা লড়াই করছে তারা আজ সন্ত্রাসী আর যারা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ কায়েম করেছে তারা হিরো। তাদের অস্ত্র সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement