২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


স্বাভাবিকীকরণের বিড়ম্বনা, দৃশ্যপট মধ্যপ্রাচ্য

স্বাভাবিকীকরণের বিড়ম্বনা, দৃশ্যপট মধ্যপ্রাচ্য - নয়া দিগন্ত

সংযুক্ত আরব আমিরাত ২০২০ সালে ইসরাইলের সাথে যখন সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সম্মত হয় তখন সবাই বলেছিল, আমিরাত ফিলিস্তিনিদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। চুক্তির নামকরণে একজন রাসূলের নাম দেয়া হয়, আব্রাহাম অ্যাকর্ডস। মুসলমানরা জাতির পিতা হিসেবে ইবরাহিম আ:-কে বোঝে, তাই এই নামে কোনো দর কষাকষি হয়নি। কিন্তু বর্তমান গাজা যুদ্ধকে অনেক সমালোচক ক্রুসেড-ক্রিসেন্টের যুদ্ধের প্রতিবিম্ব বলে মনে করছেন। পশ্চিমা নেতারা একত্রিত হয়ে ইসরাইলের পক্ষ নিয়েছেন। মুসলিম দেশগুলো কমবেশি হামাস বা ফিলিস্তিনিদের পক্ষ নিয়েছে। সুলতান মাহমুদ কনস্টান্টিনোপল জয় করতে গিয়ে দেখলেন, সব খ্রিষ্টান শাসক, তার সাথে বা তুর্কি সুলতানের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করে বিরোধী শিবিরে যোগ দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এখানেও বিষয়টি সেরকম।

আমিরাত বলে আসছিল, স্বাভাবিকীকরণে ইসরাইলের আঞ্চলিক সম্প্রসারণ রোধ হবে। সেটি কিন্তু হয়নি। চুক্তির পর ইসরাইল-আমিরাত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়েছে, আমিরাত প্রচুর অর্থ ব্যয়ে সামরিক অস্ত্র কিনেছে। বিভিন্ন আড়িপাতার সফটওয়্যার কিনেছে। বেশুমার ইসরাইলি আমিরাত ভ্রমণ করেছে। তাদের ব্যবহারে অতিষ্ঠ আমিরাতিদের অনেক ভয়াবহ চিত্র পত্র-পত্রিকায় বেরিয়েছে। বাহরাইনের কর্মকর্তারা সপ্তাহ ধরে তেলআবিবে অবসর কাটিয়েছেন। ফিলিস্তিনিদের কথা খুব কমই উচ্চারিত হয়েছে।

সম্প্রতি ওয়াশিংটনে আবুধাবির রাষ্ট্রদূত, ইউসেফ আল-ওতাইবা চুক্তির সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেছেন। আব্রাহাম অ্যাকর্ডের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে ওয়াশিংটনের একটি অনুষ্ঠানে আল-ওতাইবা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রশাসন কার্যকরভাবে পশ্চিম তীরকে সংযুক্ত করছে। এর ফলে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান আরো জটিল হয়ে পড়েছে। টাইমস অব ইসরাইলকে রাষ্ট্রদূত আরো জানান, ‘আমাদের চুক্তির একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা ছিল, যা প্রায় শেষ। সুতরাং, আমরা সেই সময়ের পরে নেয়া সিদ্ধান্তগুলো প্রভাবিত করতে পারি না।’ স্বাভাবিকীকরণকে সমর্থন জানালেও সংযুক্তকরণকে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের জন্য একটি গুরুতর হুমকি বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। ইসরাইল বলেছে, অনির্দিষ্টকালের জন্য সংযুক্তি বন্ধ করার বাধ্যতামূলক প্রতিশ্রুতি তারা দেয়নি। কূটনীতিকরা ইসরাইলকে সুবিধা দেয়ার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতকে দোষারোপ করেছে।

মার্কিন মধ্যস্থতায় সম্ভাব্য সৌদি-ইসরাইল স্বাভাবিকীকরণ চুক্তি সম্পর্কে চলমান আলোচনার মধ্যে আল-ওতাইবা এই বিবৃতি দেন। সৌদিরা পরমাণু অস্ত্র সমৃদ্ধকরণের বিনিময়ে স্বাভাবিকীকরণে রাজি বলে প্রাথমিক আলোচনায় প্রকাশ পায়।

ফিলিস্তিনের বিষয়ে ইসরাইল কোনো আপস করতে অস্বীকৃতি জানায়, ফলে আলোচনা স্থবির হয়ে পড়ে। সৌদিরা ফিলিস্তিনি ইস্যুকে স্বাভাবিকীকরণের সাথে যুক্ত করায় ইসরাইলি কর্মকর্তারা হতবাক হন বলে জানা যায়। প্রিন্স বিন সালমান যে রাজনৈতিক কলাকৌশল প্রয়োগে আগের চেয়ে বেশি প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন সেটি বোঝা যায়।

স্বাভাবিকীকরণের জন্য বাহরাইন, সুদান ও মরক্কোর পর সৌদি আরবের সাথে ইসরাইল আলোচনা চালায়। নেতানিয়াহু বলেছেন, সৌদি আরবের সাথে একটি স্বাভাবিকীকরণ চুক্তিতে পৌঁছাতে ইরান বাধা দেবে না।

ফিলিস্তিন ইস্যুটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও কিছু আরব শাসকদের হাতে বিভ্রান্তিতে পরিণত হয়েছে। ফিলিস্তিনিরা যখন জেগে ওঠে, তাদের রক্ত ও জীবন দিয়ে আরো মূল্য দেয় এবং বিশ্বকে সতর্ক করে যে তারা এখনো এখানে আছে। সুবিধাবাদী ও দখলদাররা বিভিন্ন কারসাজি করে। ৭০ বছর ধরে ফিলিস্তিনিরা নির্যাতিত হচ্ছে, বিচিত্র ধরনের নির্যাতন হত্যা, খুন, বোমাবর্ষণ তাও সাধারণ জনগণের ওপর তাতে কেউ ইসরাইলকে সন্ত্রাসী বলেনি। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে যারা নিজের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আক্রমণ চালাল তারা এক দিনেই ‘সন্ত্রাসী’ হয়ে গেল। ওয়াশিংটন মনে করেছে, সৌদি স্বাভাবিকীকরণ কেবল সময়ের ব্যাপার। তারা মনে করল, ফিলিস্তিনি জনগণের পিঠে আরেকটি আরব শাসনের ছুরিকাঘাত হবে, তারপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথা বলা হবে। জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ অনতিবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করতে বলেছে। আরব দেশগুলো একমত হলেও যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ বন্ধ করতে রাজি নয়; বরং সেনাসদস্য মোতায়েনের ব্যবস্থা করছে। নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তের পর গাজায় স্থল আক্রমণ শুরু হয়েছে। নেতানিয়াহু বলেছেন, এটি যুদ্ধের দ্বিতীয় ধাপ।

যারা দুই রাষ্ট্র পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে ফিলিস্তিন ইস্যুতে নতুন করে আগ্রহের ভান করেছে, জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তারা বুঝতে পারে যে, বর্তমান ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠী ও ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনিদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উত্থানের সম্পূর্ণ বিরোধী। দখলকৃত ভূখণ্ড থেকে ইসরাইলকে সরে যেতে বাধ্য করে সেখানে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসরাইলের ওপর চাপ সৃষ্টি করা বা নিষেধাজ্ঞা আরোপের কোনো অভিপ্রায় পশ্চিমা বা পূর্ব কোনো পক্ষেরই নেই। এখন অনেকেই সোচ্চার হয়েছেন, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে সমস্যা সমাধানের জন্য। আসলেই কি তাই? একটি হায়েনার সামনে বিড়াল কি স্বাধীনতা ভোগ করবে? স্বাধীন ফিলিস্তিনকে আগামী দিনগুলোতে হায়েনার সাথে যুদ্ধই করে যেতে হবে। সেটি হবে আরো ভয়াবহ। তাই ফিলিস্তিনি ইস্যুটি অনেক জটিল।

হামাস-ইসরাইল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের উদ্যোগ স্থগিত করেছে সৌদি আরব। এটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জন্য বড় ধরনের আঘাত। কেননা, তিনি মনে করেছেন, আগামী নির্বাচনে একটি রাজনৈতিক বিজয় বলে এটি প্রচার করা যাবে যা তার নিজের বা দলের জন্য সুবিধা বয়ে আনবে। কেননা, তিনি ইতোমধ্যে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার, ইউক্রেন যুদ্ধের দায়ভার, চীনাদের বিরুদ্ধে আাফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য পলিসিতে সুবিধা করতে না পারা, হরমুজ প্রণালীতে ইরানি জাহাজের ধাওয়া খাওয়া, হংকংয়ে উল্টো দৌড়, তাইওয়ান ও চিপস নিয়ে চীনের সাথে বিরোধে কোনো সুবিধা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় অনেক সমালোচিত হয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে সৌদি আরব যে বার্তা দিয়েছে তাতে বলা হয়, ‘ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের উদ্যোগ স্থগিত করা হয়েছে, বাতিল নয়।’ ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া স্থগিত করে সৌদি আরব ওই অঞ্চলে সহিংসতার বিস্তার প্রতিরোধে ইরানের সাথে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে। এটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল উভয়ের জন্য আরো বড় সঙ্কট।

ফিলিস্তিনের বাইরে, এমনকি আমেরিকাসহ পশ্চিমা জনমতের কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইসরাইলকে বর্ণবৈষম্যের অপরাধী হিসেবে বর্ণনা করছে, যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের মতো।

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দীর্ঘ ও অত্যন্ত সফল রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। সর্বোপরি, তিনি ইসরাইলের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সামরিক বিপর্যয় ডেকে এনেছেন। নেতানিয়াহু এই ধারণায় আতঙ্কিত যে, তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি ইসরাইলের ওপর ‘মিনি-হলোকাস্ট’ এনেছেন। হামাসের অতর্কিত আক্রমণে তিনি এতই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
সাধারণ ইহুদি, সেনা কমান্ডারদের সাথে নেতানিয়াহুর বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। তার বিরুদ্ধে তিন মাস ধরে লাগাতার ক্ষমতা ছাড়ার আন্দোলন হয়েছে। তার নিজের, তার স্ত্রী সারা ও ছেলের বিরুদ্ধে আদালতে ক্রিমিনাল মামলা করা আছে। এখন পর্যন্ত, কমপক্ষে দেড় হাজার ইসরাইলি প্রাণ হারিয়েছে ও সমপরিমাণ আহত হয়েছে। এক লাখের কাছাকাছি ইহুদি দেশ ছেড়েছেন। হামাসের হাতে ২২০ জন ইসরাইলি জিম্মি রয়েছে।

নেতানিয়াহু নিজেকে একজন ধর্মনিরপেক্ষ মসিহ হিসেবে দেখেন। হিটলার, মুসোলিনি, বুশ- এরাও নিজেদের ত্রাণকর্তা মনে করতেন। ইসরাইলের প্রয়াত প্রধান রাব্বি ওভাদিয়া ইয়োসেফ, নেতানিয়াহুকে ‘অন্ধ ছাগল’ বলে অভিহিত করেছেন। নেতানিয়াহু মনে করেন, তিনি কখনো ভুল করেন না, অন্তত তার নিজের চোখে তিনি একজন অনন্য, সর্বোচ্চ নেতা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আকারের একটি দেশ পরিচালনা করতে সক্ষম। নেতানিয়াহু এটিকে ‘অ্যাডেড ভ্যালু’ বলেছেন। এই উচ্চতর আত্মমূল্যায়ন বছরের পর বছর চলতে শুরু করে। তিনি নির্বাচনের পর নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সাথে সাথে নিজের মনের মধ্যে বৃহত্তর হয়ে ওঠেন, অবশেষে তার নিচের মাটি শক্তি হারিয়ে ফেলে।
যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে, নেতানিয়াহু কিভাবে হামাসের হামলার বিশাল রণসজ্জার তথ্য মিস করেছেন এবং কেন ইসরাইল অত্যন্ত শক্তিশালী সামরিক বাহিনী হামলার মোকাবেলা করতে সম্পূর্ণরূপে অপ্রস্তুত হয়েছিল সে বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের মুখোমুখি হবেন।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement

সকল