২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আমাকে ভোট দিন- সিসি

আমাকে ভোট দিন- সিসি - ফাইল ছবি

মিসরের রাষ্ট্রপতি আল সিসি আগামী নির্বাচনে তাকে ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এবং একই সাথে ভোটারদের সতর্কও করেছেন। তিনি বলেছেন, আমাকে ভোট দাও নতুবা পরিণতির জন্য প্রস্তুত হও! এই হলো মিসরের গণতন্ত্রের অবস্থা। আগের নির্বাচনগুলোতেও তিনি একই চেহারা দেখিয়েছিলেন। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে একমাত্র মুরসি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু আল সিসি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক ডিক্টেটরশিপ চালাচ্ছেন। আগামী ডিসেম্বরে মিসরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, তা নিয়ে সিসির অনেক পরিকল্পনা।
মিসরীয় আইনে, মিসরের রাষ্ট্রপতি প্রার্থীকে সংসদের ২০ জন প্রতিনিধির সুপারিশ সংগ্রহ করতে হয় নতুবা কমপক্ষে ১৫টি গভর্নরেট থেকে ২৫ হাজার জন নাগরিকের সমর্থনের প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করতে হয়, প্রতিটি গভর্নরেট থেকে কমপক্ষে এক হাজার জন থাকবে। একই ব্যক্তি দু’জনকে সমর্থন করতে পারেন না। মিসরে প্রশাসনিকভাবে ২৭টি গভর্নরেট রয়েছে।

১০ ডিসেম্বরের জন্য নির্ধারিত মিসরীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে একজন সম্ভাব্য প্রার্থীকে সমর্থন করার জন্য সমর্থনের চিঠিটি প্রত্যায়িত করতে দীর্ঘ সারিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে হয়। অপেক্ষা করার সময়, নিরাপত্তা ও আমলাতান্ত্রিক হয়রানির শিকার হতে হয় এবং অনেক সময় অফিসিয়াল সার্টিফিকেশন না পাওয়ার অভিযোগ ওঠে। মূলত এসব কর্মকাণ্ড অদৃশ্য অঙ্গুলির কারসাজি।
সাবেক সংসদ সদস্য আহমেদ তানতাভির (৪৪) সমর্থকরা দিনের পর দিন এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। তিনি চলতি অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে তার নির্বাচনী প্রচারাভিযান স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তানতাভির ২২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে- সমর্থনের প্রত্যয়ণ সংগ্রহ করতে তারা নিরাপত্তা এবং আমলাতান্ত্রিক হয়রানির শিকার হন। তানতাভি সোশাল মিডিয়াতে এসব কাজের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

সিসির রাজনৈতিক বিরোধীরা প্রশংসাপত্র সংগ্রহে অফিসের সামনে গুণ্ডাদের হয়রানির অভিযোগ করেছেন। তারা সোশ্যাল মিডিয়াতে জানান, প্রশাসনই সুষ্ঠু নির্বাচনের বড় বাধা। গণতন্ত্র তো দূরের বিষয়। এ কলাম লেখা পর্যন্ত তানতাভির চার আইনজীবী ও ৭৩ সমর্থককে গ্রেফতার করে জেলে ঢোকানো হয়েছে। তানতাভির আইফোনে নজরদারি করা হচ্ছে, দেয়া হয়েছে কাল্পনিক অপরাধের অনেক মামলা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেছেন, গত ২০০ বছরে মিসর সিসির মতো এমন ব্যর্থ রাষ্ট্রপতি প্রত্যক্ষ করেনি। তরুণ মিসরীয়রা তারপরও প্রচারণা চালাচ্ছেন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তাদের এই আশা যে, অন্তত ২০৩০ সালের নির্বাচনে যেন জয়ী হওয়া যায়। সিসি তো এতদিন থাকবেন না।

নেশন্স ফিউচার পার্টিসহ নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা পরিষেবাগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠতার জন্য পরিচিত দল, যারা সিসির সমর্থনের চিঠি জারি করছে, তাদের জন্য লাঞ্চ প্যাকেট সরবরাহ করা হচ্ছে। একই উদ্দেশ্যে সরকারি কর্মচারীদেরও একত্রিত করা হচ্ছে, নাচ ও গানের সিমুলেটেড কর্মসূচির মাধ্যমে মিসরীয় আধুনিক সাংস্কৃতিকে দৃশ্যমান করে জাঁকজমকপূর্ণ প্রচারণা চালিয়ে বার্তা দেয়া হচ্ছে যে, সামরিক অভ্যুত্থানের এই নেতাকে তৃতীয় মেয়াদের জন্য রাষ্ট্রপতি মনোনীত করা যেন চিত্তাকর্ষক বিনোদনের মতো কিছু। এর আগের নির্বাচনগুলোতে আল আজহারের গ্রান্ড মুফতিরা সিসির পক্ষে এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের বিপক্ষে ফতোয়া দিতেন। আজ পর্যন্ত গ্রান্ড মুফতিরা কারো পক্ষে কোনো নির্বাচনী ফতোয়া দেননি। তবে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিকরা সিসির সমর্থনে ব্যানার টাঙানোর চাপে রয়েছেন। জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিবারের সদস্যরা এই কাজে ভূমিকা রাখছেন বলে পত্রিকায় সংবাদ বেরিয়েছে। অনেকটা মাস্তানির মতো করে ব্যবসায়ীদের বল প্রয়োগ করছেন।

সিসির প্রশাসনব্যবস্থা নির্বাচনের জন্য একটি উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে, অথচ সত্য হলো, তারা চায় না জনগণ তাদের ভোট দিয়ে ইতিবাচকভাবে রাজনীতিতে জড়িত থাকুক, যেমনটি হয়েছিল জানুয়ারি ২০১১ সালের বিপ্লবের পর। বর্তমান নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে দেখা যায়, সিসির নির্বাচনী শিবির মনে করে, অন্তত তিনজন যোগ্য প্রার্থী ভোটে দাঁড়াক। তাহলে, বিরোধী ভোট বিভক্ত হবে, কেউ জিতবে না এবং গণতান্ত্রিক প্রত্যাশাও পূরণ হবে; আর কী দরকার? তানতাভি এমন বেহিসাবি প্রার্থী নন বিধায় সুবিধা করতে পারছেন না, মামলা হামলার সম্মুখীন হচ্ছেন। তবে কনস্টিটিউশন পার্টির প্রধান গেমেলা ইসমাইল এবং মিসরীয় সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির চেয়ারম্যান ফরিদ জাহরান তাদের প্রার্থিতা ঘোষণা করেছেন। সিসি তাদের পার্লামেন্টে বেশি সংখ্যক আসন ভাগাভাগি করে দেয়ার জন্য একটি চুক্তিতে এসেছেন বলে জানা যাচ্ছে। জনগণের বিরাট একাংশ ভাবছে, বিরোধিতা করে ডাণ্ডা পেটা হওয়ার চেয়ে ভাগাভাগি করে কিছু আদায় হলে মন্দ কী!

রিপাবলিকান পিপলস পার্টির প্রধান হাজেম ওমর প্রতিনিধি পরিষদের ৪৪ জন সদস্যের কাছ থেকে সুপারিশ পেয়েছেন, আর ওয়াফড পার্টির প্রধান আবদেল-সানাদ ইয়ামামা ২০ জন সদস্যের কাছ থেকে সুপারিশ পেয়েছেন। এর অর্থ হলো- আল সিসির বিরুদ্ধে পাঁচজন প্রার্থী দাঁড়াতে পারেন, যারা ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রায় ৯৭ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন। এটি লক্ষণীয় যে, ওমর পার্লামেন্টের দ্বিতীয় চেম্বার সিনেটের একজন সদস্য এবং তাকে ২০২০ সালের অক্টোবরে আল সিসি নিয়োগ করেছিলেন। রাষ্ট্রপতির ১০০ জন সিনেটর নিয়োগ করার ক্ষমতা রয়েছে। ইয়ামামাও মিসরের প্রেসিডেন্টের সমর্থক এবং টেলিভিশনে তার প্রতি নিজের সমর্থন ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। আল সিসি উচ্চকণ্ঠ ভাষণে বলেন, এরা সবাই তার সাথে আছেন!

এ ছাড়াও তিনজন রাষ্ট্রপতি প্রার্থী কারাগারে, যেমন- শক্তিশালী মিসর পার্টির প্রধান, আবদেল মোনেইম আবুল ফোতুহ; সুপরিচিত ধর্ম প্রচারক হাজেম আবু ইসমাইল এবং সাবেক সেনা কর্মকর্তা আহমেদ কানসওয়া। তারা মূলত রাজনৈতিক বন্দী এবং বছরের পর বছর ধরে কারাবন্দী। তদুপরি, প্রাক্তন চিফ অফ স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল সামি আনান এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শফিক উভয়কেই গৃহবন্দী করা হয়েছিল যখন তারা ঘোষণা করেছিল যে, তারা ২০১৮ সালের নির্বাচনে আল সিসির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
বর্তমান নির্বাচন বলয়ে ইসলামপন্থীদের অনুপস্থিতির সমালোচনা করছেন অনেকে। মিসরে ভোট ডাকাতি, কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই এসব দেখা যায় না। তাই বিরোধীদের অনেকে মনে করেন নির্বাচন বয়কট না করে কিছু প্রতিযোগিতা করা উচিত। হাতপা ছেড়ে পড়ে থাকার চেয়ে হাঁটাহাঁটি ভালো।

অর্থনৈতিক জীবনযাত্রার অবনতির কারণে মিসরের রাস্তায় হতাশা সত্ত্বেও, মানুষের একটি বড় দল আশা করে, শেষ মুহূর্তে একজন শক্তিশালী প্রার্থীর আবির্ভাব ঘটতে পারে, যারা সামরিক শিবিরের জন্য গ্রহণযোগ্য বিকল্প হবে। লিবারেল ফ্রি ইজিপ্টিয়ান পার্টির মুখপাত্র, এমাদ গাদ, সশস্ত্র বাহিনীর প্রাক্তন চিফ অব স্টাফ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহমুদ হেগাজিকে দেশ বাঁচাতে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহ্বান জানানো হয়েছে। সিসি ক্ষমতায় থাকলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ার বিষয়ে সামরিক শিবিরের মধ্যেও উদ্বেগ রয়েছে। আল সিসি কঠিন কোনো পরিস্থিতিতে এক লাখ মানুষ দিয়ে কায়রোতে অশান্তি সৃষ্টির হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, হয় আমি নতুবা ধ্বংস। সিসি কেন এমন কথা বললেন তা ভাবনার বিষয়। মিসরে এখন যা আছে সেসব তো তারই সাজানো বাগান! তিনি কি মনে করেছেন প্রচুর সুযোগ ও ক্ষমতা দেয়ার পরও সেনাবাহিনী তাকে পরিত্যাগ করবে? তার বিতর্কিত বক্তব্যের মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরে, ইসমাইলিয়া গভর্নরেট জাতীয় নিরাপত্তা পরিষেবার সদর দফতরে আগুন লেগে যায়। আগুন লাগার কারণ এবং সময় নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, যেহেতু সামরিক শিবির বা সেনাবাহিনী মূলত শাসক তাই প্রতিষ্ঠানটি নিরপেক্ষ নয়।

গত সেপ্টেম্বরে তিনি বিদ্যালয়ে মেয়েদের নেকাব পড়া নিষিদ্ধ করেছেন। নেকাব নিয়ে দীর্ঘ দিন মিসরে বিতর্ক চলে আসছে, প্রায় বছর খানিক। সরকারি পক্ষ বলছে, এই ইস্যুতে মুসলিম ব্রাদারহুড সমর্থকরা সুবিধা নেবে। নির্বাচনের আগে এই বিষয়টির সুরাহা হওয়া দরকার। তবে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে থেকেই লম্বা নেকাব পরা নিষিদ্ধ রয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মিসরে রাজনীতিকে সামরিকতন্ত্রে পরিণত করার কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং মন্ত্রীদেরকে জেনারেলদের এখতিয়ারে আনা কোনো নতুন বিষয় নয়। ২০১৩ সাল থেকে এই কাজ শুরু হয়ে এখন মসজিদের ঈমাম, স্কুলের শিক্ষক, আদালতের বিচারক ও বিদেশে কর্মরত দূতাবাস কর্তারাও রয়েছেন। কয়েক সপ্তাহ আগে মসজিদের ইমামদের একটি ব্যাচ কলেজ অব ইজিপশিয়ান রিজার্ভ অফিসার থেকে প্রশিক্ষণ লাভ করেছেন। এখন সব মসজিদে এই ‘প্রশিক্ষিত’ ইমাম ব্যতীত অন্যদের নিয়োগ দেয়া যাবে না। আল সিসি বর্তমান ধর্মীয় মন্ত্রী মোহাম্মদ মোক্তার গোমাহকে বলেন, আমাদের দেশে ‘আলোকিত ইমামের’ জেনারেশন তৈরি করা দরকার। সঙ্গীতেও সামরিকীকরণ হয়েছে, ‘তিসলাম আল আইয়াদি’ সামরিক অনুষ্ঠানের প্রধান সঙ্গীতরূপে গৃহীত হয়েছে। এই আরবি গানের উপজীব্য হলো সেনাদের সব কাজ প্রশংসনীয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, গভর্নরেট, শহর, ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল ও পাবলিক সেক্টর কোম্পানিতে সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের নিয়মিত পদায়ন করা হয়।

সিসি মিসরের আনাচে কানাচে তার সমর্থক বানিয়েছেন। বিরাট সেনাবাহিনীকে তিনি নির্বাচনে ব্যবহার করতে চান। সংবিধান সংশোধন করেছেন, এক শ’ সিনেটর নিয়োগ দিতে পারেন। ব্রাদারহুডকে আগেই ঠাণ্ডা করা হয়েছে। তিনি আরো দীর্ঘদিন প্রেসিডেন্ট থাকতে চান, এতসবের পরও জিততে না পারলে লঙ্কাকাণ্ড করবেন বৈকি?

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement