০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫
`


দেশ জাতি রাষ্ট্র

সঙ্কট উত্তরণে প্রধানমন্ত্রীর ঔদার্য প্রয়োজন

সঙ্কট উত্তরণে প্রধানমন্ত্রীর ঔদার্য প্রয়োজন - নয়া দিগন্ত

মার্কিন ভিসানীতির প্রায়োগিক পর্যায়ে এসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট আরো ঘনীভূত হয়েছে। নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ সরকার মেঘ থেকে বৃষ্টি আশা করেছিল, বজ্রপাত আশা করেনি। ওবায়দুল কাদেরের সেলফি-সন্তোষ উবে গেল। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালীন সময়ে ি ভসা নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলো। একটি বিব্রতকর অবস্থার মোকাবেলা করতে হলো তাকে। নিউ ইয়র্কে অবস্থান করা সত্ত্বেও তিনি ছেড়ে কথা বলেননি। ‘বাংলাদেশের জনগণও ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করতে পারে। বাইর থেকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র হলে বাংলাদেশও স্যাংশন দেবে’-এমন কথা বলে তিনি আত্মতুষ্টি লাভ করেছেন। যদিও বাস্তবতা অন্যরকম।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ক্ষমতাসীনদের আপসরফার যে আকার ইঙ্গিত ইতোমধ্যে যারা দিচ্ছিলেন তাদের মুখ শুকিয়ে গেছে। তবে এ কথা সত্য, স্বাভাবিক অবস্থায় একটি স্বাধীন দেশের উপর এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা স্বাভাবিক ও সিদ্ধ হতে পারে না। একজন কূটনীতিক এর যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নাজিবাদ ও ফ্যাসিবাদের মতো নাগরিক অধিকারবিরোধী ধ্যান-ধারণা ও সরকারকে আইনি আওতায় আনার জন্য ১৯৪৮ সালে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা জাতিসঙ্ঘে গৃহীত হয়। উদ্দেশ্য ছিল জাতিরাষ্ট্রসমূহে মানবাধিকার রক্ষায় জাতিসঙ্ঘ তথা অন্যের নজরদারি সিদ্ধ করা। অভ্যন্তরীণ বিষয় হস্তক্ষেপের বাহানা দিয়ে স্বৈরাচারী নেতৃত্ব ও সরকার যাতে পার পেতে না পারে সে জন্য এই ব্যবস্থা।

সব রাষ্ট্রই স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের কথা বলে অথচ কেউ কেউ ভেতরে ভেতরে নাগরিক অধিকার হরণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তীকালে জাতিসমূহের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের বিশ্বজনীন প্রবক্তা হয়ে দাঁড়ায়। এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার উপনিবেশ উচ্ছেদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রগতিশীল ভূমিকা রাখে। তবে বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদের মোড়ল হওয়ার পর তাদের সে ভূমিকা বিপরীতে পর্যবসিত হয়। এরপরও ডেমোক্র্যাটিক পার্টি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিষয়টিকে তাদের পররাষ্ট্রনীতির অনিবার্য ধারা হিসেবে অনুসরণ করে আসছে। ট্রাম্পের পরে বাইডেনের শুরুতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার এই হলো পটভূমি।
আরোপিত ভিসানীতি নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম থেকেই অসঙ্গত, অসামঞ্জস্যশীল ও উল্টাপাল্টা মন্তব্য করে আসছে। মুখে তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ নিষেধাজ্ঞার পরোয়া করে না। এবার ভিসানীতি প্রয়োগের পরও একই ধরনের উল্টাপাল্টা মন্তব্য আঁটছে শাসকদল থেকে। ওবায়দুল কাদের ২৪ সেপ্টেম্বর সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে দেয়া এক বিবৃতিতে বলেন, আওয়ামী লীগ কোনো ভিসানীতির প্রয়োগ বা নিষেধাজ্ঞার পরোয়া করে না। পরোয়া করে দেশের জনগণকে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন আল-জাজিরাকে বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করতে বাংলাদেশ সক্ষম। অনেকবার অনেক সংলাপে আওয়ামী লীগ আশ্বস্ত করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। অবশেষে ঘোষিত ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রমাণ করেছে, তারা আশ্বস্ত হয়নি। প্রথমদিকে সরকার মনে করেছিল, ভিসানীতি বিরোধী দলের জন্যও প্রযোজ্য হবে। এখন তা না হয়ে বরং সরকারের বিভিন্ন অংশীদারের ওপর তা প্রায়োগিক হচ্ছে।

অপ্রকাশিত সূত্র অনুযায়ী, এটি তথাকথিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টির একাংশের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে। বাদ যায়নি সরকারের হয়ে কাজ করা গণমাধ্যমগুলোও। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্ষমতাচ্যুতির কোনো আশঙ্কায় পড়তে চায় না আওয়ামী লীগ। নিপীড়নের সব স্তর অতিক্রম করে যে করেই হোক নির্বাচন করতে চায় আওয়ামী লীগ। বিরোধী দল বলছে, ভিসানীতি কার্যকর হওয়ায় সরকারের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। অপর দিকে, বিএনপিকে ৩৬ দিনের আলটিমেটাম দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সন্ত্রাস-ষড়যন্ত্র বন্ধ না করলে বিএনপির কালো হাত গুঁড়িয়ে দেবে তারা। সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই নিজ নিজ অবস্থানে অটল।

আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধান মোতাবেকই নির্বাচন হবে। বিএনপিসহ সব বিরোধী দল এক কাতারে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যতীত তারা কোনো মতেই নির্বাচন মেনে নেবে না। এ অবস্থায় ডিসেম্বরের শেষে বা আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোট গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। নভেম্বরে তারা তফসিল ঘোষণা করতে চায়। নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে। হালনাগাদ ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করার কাজ করছে তারা। সারা দেশে ভোটকেন্দ্রের খসড়া তালিকা তৈরি করা হয়েছে। অভিযোগ শুধু আওয়ামী লীগের লোকজন নিয়ে এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল লক্ষ করছে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সরকার ও আওয়ামী লীগ অভিন্ন কার্যক্রমে এগোচ্ছে। নির্বাচন কমিশন সরকারের সব সহায়তা পাচ্ছে বলে প্রচার করছে। অপর দিকে, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বিএনপির শীর্ষ নেতারা সরকারের হামলা-মামলা ও নিপীড়নের মধ্যে রয়েছেন। একটি নির্বাচনকালীন সরকারের বাইরে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করে- অভ্যন্তরীণ আন্দোলন, বহিস্থ চাপ ও জনমতের বিপরীতে নির্বাচন কমিশনের অবস্থান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে জটিলতর করে তুলছে।

মার্কিন ভিসানীতি দৃশ্যত নির্বাচন প্রস্তুতির বিপরীত ব্যবস্থা। কূটনৈতিক সৌজন্য ও প্রায়োগিক পররাষ্ট্রনীতি যে এক নয়, মার্কিনিরা তা আওয়ামী লীগকে বুঝিয়ে দিয়েছে। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। নির্বাচন প্রস্তুতির ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বক্তব্য এই- এটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এগোচ্ছে না। অন্যান্য দেশ থেকে পর্যবেক্ষক আসার ক্ষেত্রে মার্কিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দৃষ্টান্ত অনুসৃত হবে, এটিই স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্রের এই কঠিন পদক্ষেপের পর সরকারের যে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ভূমিকা থাকা উচিত তা দৃশ্যমান হচ্ছে না। সরকারকে অনেকটা বেপরোয়া ভাবার কারণ রয়েছে। সরকার ও আওয়ামী লীগ যে একাকার হয়েছে সেই উপলব্ধি আগেকার। এখন সরকারের পতন হলে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক হত্যার সম্মুখীন হবে এ রকম আশঙ্কা প্রকাশিত হয়েছে। চিরকালীন ক্ষমতা কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য চির রক্ষাকবচ হতে পারে না। বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ যদি জনগণের হয়ে কাজ করে থাকে তাহলে অবশ্যই তারা নন্দিত হবে। আর যদি তারা নিপীড়ন-নির্যাতন ও দুর্নীতি-দুঃশাসনের অংশীদার হয়ে থাকে তাহলে তা নিন্দিত হবে না কেন। আওয়ামী লীগের এই আশঙ্কার বিপরীতে বিএনপি ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে, তারা রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় বিশ্বাস করে না। সামনে যে সঙ্ঘাতময় পরিবেশ-পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে যাচ্ছে তা নিরসনে রাজনৈতিক সমঝোতা অপরিহার্য।

যেকোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নেতৃত্ব একটি বড় বিষয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের ওপর দেশের ভালো-মন্দ নির্ভর করে। এ সময় বাংলাদেশে যে সঙ্ঘাতের রাজনীতির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসনেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিরোধী ও সরকারি উভয় রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অবশ্যই জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও সুশাসনের বিষয়ে আপস করা যায় না। তাই আজকে দেশপ্রেমের পরীক্ষায় উভয় নেতৃত্বকে উত্তীর্ণ হতে হবে। বিশেষত সরকারব্যবস্থা যারা পরিচালনা করেন তাদের দায় অনেক বেশি। একটি দেশপ্রেমিক সরকারের নীতি হবে সমঝোতা, সঙ্ঘাত নয়। মনে রাখতে হবে- শক্তি নয়, সম্মতি হচ্ছে গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র। গণতন্ত্রের এই মূলমন্ত্র নিয়ন্ত্রিত হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সব ব্যাকরণে সংযম, সহিষ্ণুতা ও সৌজন্যকে রাজনীতির আকর বলা হয়েছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবেশ যতই জটিল ও কুটিল হোক না কেন সমঝোতার মাধ্যমে এবং একমাত্র সমঝোতার মাধ্যমেই সব বিরোধের অবসান হতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির কর্ণধার। তার নেতৃত্বের কর্মকুশলতার ব্যাপারে কারো কোনো অবিশ্বাস নেই। তা ছাড়া তিনি এই জাতির স্থপতির কন্যা। এই জাতির প্রতি তার দায় ও দায়িত্ব রয়েছে। তিনি দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় রয়েছেন। জনগণের নাড়ির খবর তিনি রাখেন বলেই আমাদের ধারণা। ইতোমধ্যে তার রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার কথা। কোনো চাপ বা আন্দোলনে নয়, তার ঔদার্যই দেশকে রক্ষা করতে পারে। সে লক্ষ্যে তিনি জাতীয় সংলাপের আয়োজন করতে পারেন এবং তার মাধ্যমেই নির্বাচনকালীন সরকার তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো সাংবিধানিক ইস্যুগুলো মীমাংসিত হতে পারে। গোটা জাতি বিশ্বাস করে, ক্ষমতার মোহ ও লোভ-লালসাকে অতিক্রম করে ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেয়ার নৈতিক ক্ষমতা তার রয়েছে। অবশেষে উভয়পক্ষকে ঔধসবং ঋৎববসধহঈষধৎশব -এর সেই বিখ্যাত উক্তি মনে করিয়ে দেই- ‘A politician thinks of the next election; a statesman thinks of the next generation.’

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
গাজীপুরে নিখোঁজ পোশাকশ্রমিকের লাশ উদ্ধার চলচ্চিত্রে সমস্যা ও উত্তরণে গোলটেবিল বৈঠক হ্যাটট্রিক হারে সিরিজ হাতছাড়া বাংলাদেশের নয়া দিগন্তে সংবাদ প্রকাশে বন্ধ হলো সেই বিলের মাটি কাটা বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষায় বৃত্তি বাড়াতে আগ্রহী রাশিয়া উখিয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশী ১০ জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে জামায়াতের উদ্বেগ এমপি-মন্ত্রী-সচিবের আত্মীয় এগুলো দেখার প্রয়োজন নেই : ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের ইসি সচিব বগুড়ায় শজিমেক ছাত্রলীগের ২ গ্রুপে সংঘর্ষ, আহত ১৩ স্বর্ণের দাম ভরিতে আরো কমলো ১৮৭৮ টাকা গাজায় হামাস যোদ্ধা ও ইসরাইলি বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ

সকল