২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কানাডায় শিখ নিধনের অভিযোগ ভারত কি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র

কানাডা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী - ফাইল ছবি

এই মুহূর্তে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় চলছে। পট-পরিবর্তনের নানা জল্পনা ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। এমন সময়ে সীমান্তের বাইরে নজর দেয়ার সুযোগ কম। কিন্তু সেখানে এমন কিছু ঘটনা ঘটছে যা উপেক্ষা করা অসম্ভব। আমরা তাই কানাডা-ভারত সম্পর্কের বিষয়ে আজ কিছু কথা বলতে চাই।
বিশ্বের শিল্পোন্নত ২০টি দেশের জোট জি-২০-এর সম্মেলনে এসেছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। সেখানে কিছু অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা পেয়েছেন তিনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে তার সংক্ষিপ্ত বৈঠক সুখকর ছিল না। মোদি কানাডার মাটিতে ভারতীয় শিখ সম্প্রদায়ের স্বাধীন খালিস্তান আন্দোলনের কর্মকাণ্ড বন্ধের দাবি জানিয়েছিলেন, যেটি কানাডার ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। বিষয়টি কানাডার পক্ষ থেকে আগেও জানানো হয় ভারতকে। কিন্তু ভারত আশ্বস্ত হয়নি।

পরিস্থিতি জটিল হয়েছে যখন ট্রুডো তার দেশে একজন শিখ নেতা হত্যায় ভারতের হাত থাকার বিষয়ে মোদিকে আভাস দেন। তিনি চান ভারত এ ধরনের কাজে জড়ানো থেকে সরে আসুক। ওই সম্মেলনের অবকাশেই ট্রুডো বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথেও শেয়ার করেন। এতেই ভারত ক্ষুব্ধ হয়। শেষ ঘটনা হলো- সম্মেলন শেষে দেখা যায়, ট্রুডোর বিমান অচল। দীর্ঘ ৩৬ ঘণ্টা দিল্লিতে আটকে ছিলেন ট্রুডো। সেটি সমস্যা নয়। সমস্যা হলো, ট্রুডোর বিমান নাশকতার শিকার কি-না সেই প্রশ্ন উঠেছে। কানাডা সরকার এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করলেও সে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়া নাশকতার সংশয় প্রকাশ করেছে। কিন্তু বিমান নিয়ে জটিলতার চেয়েও বড় ঘটনা ঘটেছে পরে। সেটি হলো- কানাডায় ফেরার পর ট্রুডোর বিস্ফোরক ঘোষণা।

কানাডার হাউজ অব কমন্সে ট্রুডো ঘোষণা করেন, গত ১৮ জুন কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার একটি শিখ মন্দিরের বাইরে খালিস্তানপন্থী শিখ নেতা হরদিপ সিং নিজ্জর হত্যায় ভারতের এজেন্টরা জড়িত।

এটি মারাত্মক অভিযোগ। অভিযোগ সত্য হলে ভারত বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ বলে আপাতদৃষ্টিতে নিজের যে পরিচিতি গড়ে তুলেছে, সেটি ধসে পড়বে। যেমনটি এরই মধ্যে বলেছেন চিরবৈরী পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান বিলাওয়াল ভুট্টো।
বিলাওয়াল ভুট্টো নিজ্জর হত্যায় ভারতের হাত থাকার অভিযোগ প্রসঙ্গে লাহোরে সাংবাদিকদের বলেছেন, ভারত দুর্বৃত্ত ও হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। শিখ নেতা হত্যার মধ্য দিয়ে শুধু যে কানাডার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হয়েছে তা নয়, এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক আইনও লঙ্ঘন করেছে ভারত। বিলাওয়াল ভুট্টো মনে করেন, এ কথাটি অর্থাৎ ভারত যে দুর্বৃত্ত দেশ সেটি মেনে নেয়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

পাকিস্তানি রাজনীতিক যা-ই বলুন, ঘটনাটি এতটা সহজ নয়। পশ্চিমা বিশ্বের, বিশেষ করে কানাডার ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের প্রতিক্রিয়া এবং আচরণে সেটি স্পষ্ট। এই চারটি দেশ ও কানাডা একটি নিরাপত্তাবিষয়ক জোটের সদস্য যেটি ‘ফাইভ-আইজ’ নামে পরিচিত। এই জোট বিশ্বে গোয়েন্দা নজরদারি করে এবং নিজেদের মধ্যে তথ্য ভাগাভাগি করে। সুতরাং কানাডায় শিখ নেতা হত্যার বিষয়ে ট্রুডোর কাছে যে তথ্য আছে সেই তথ্য সংশ্লিষ্ট অন্য দেশগুলোর কাছেও আছে। তারা সত্যটি জানে। কিন্তু এত বড় একটি অভিযোগ নিয়ে তাদের যে প্রতিক্রিয়া তা একেবারেই শীতল ও নমনীয়।

আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে প্রায়ই মজার কিছু ঘটনা ঘটে। তুরস্কের মাটিতে সৌদি ব্যবসায়ী আদনান খাশোগিকে হত্যার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড মারমুখী হয়ে ওঠে। কিন্তু অর্থনৈতিক কারণে ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির কলকাঠি নাড়ানোর সুযোগ হারানোর শঙ্কায় শেষে সৌদির সাথে সখ্য আবার মেরামত করে। একই ঘটনা ঘটে ভারতের ক্ষেত্রেও। সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় মদদ দেয়ার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র সে দেশে ভারতের গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে। তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষিদ্ধ করে। কিন্তু মোদি যখন গোটা দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন তখন সেসব নিষেধাজ্ঞা শুধু উল্টে গেল তাই নয়; বরং মোদিই হয়ে উঠলেন ইন্দো-প্যাসিফিক পলিসি কার্যকরে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ শরিক।

কানাডার মিত্রদের শীতল প্রতিক্রিয়ার পেছনে আছে ভূ-রাজনীতিতে ভারতের এই গুরুত্বের বিষয়টি। যার অন্তত দু’টি কানাডার নেই। শিল্পোন্নত ও বিশাল ভূখণ্ডের দেশ হলেও কানাডার জনসংখ্যা নগণ্য। তার অনেকটাই আবার অভিবাসী। নেই সামরিক শক্তি, নেই বৈশ্বিক প্রভাব। ফলে কথিত মিত্রদের সমর্থন পাওয়া তো দূরের কথা, ভারতের নিন্দা করার ন্যূনতম চাওয়াটুকুও পূরণ হয়নি কানাডার।

এর বিপরীতে ভারত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বশক্তি হয়ে ওঠার চেষ্টায় মরিয়া। ভৌগোলিক আয়তন, জনসংখ্যা, সামরিক শক্তি ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দিক থেকে বিশ্বশক্তি হওয়ার যোগ্যতা ভারতের আছে। জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার তার আকাক্সক্ষা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে প্রভাববলয় সম্প্রসারণে তার ভূমিকা অস্বীকারের উপায় নেই। গত মাসের ব্রিকস সম্মেলনে চীনা প্রেসিডেন্টের সমান প্রটোকল না পেয়ে বিমান থেকে নামতে মোদির গাঁইগুঁই অনেকের কাছে কৌতুককর মনে হলেও তা কিন্তু উপেক্ষা করা যায়নি। সেই সম্মেলনে ব্রিকসের নতুন সদস্যপদ দেয়ার ক্ষেত্রে ভারত জোরালো ভূমিকা রেখেছে। দেশটির সবচেয়ে বড় সাফল্য জি-২০ সম্মেলন, যেখানে একটি সর্বসম্মত ঘোষণাপত্র গ্রহণে সফল কূটনীতি চালিয়েছে ভারত। আরো বড় সাফল্য, খোদ বাইডেনকে মিডিয়ার সাথে কথা বলতে না দেয়া। সুতরাং কানাডায় দু’জন, লাহোরে একজন বা লন্ডনে একজন শিখ নেতাকে খুন করালেই তাকে ইরান, সিরিয়া বা উত্তর কোরিয়ার মতো সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের তকমা এঁটে দেবে যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্য, তেমন মনে করার কারণ নেই। এ জন্য সময় লাগবে।

তবে, ভারতের গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা যে নিছক বাইরের খোলসে, আর অন্তরে সে যে চরম হিন্দুত্ববাদী ও চরমপন্থী মৌলবাদী রাষ্ট্র সেটি আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে স্পষ্ট হওয়ার সূচনা হলো ট্রুডোর দ্বিধাহীনভাবে অভিযোগ সামনে আনার মধ্য দিয়ে।

ভারত কতটা জাতিবিদ্বেষী সেটি ভালো জানে সংখ্যালঘু মুসলমান ও শিখরা। কিন্তু দেশটির মুসলমানদের অবস্থা ও অবস্থান এখন দলিতদের মতোই হীন, নগণ্য। বা তার চেয়েও খারাপ। দলিত মেয়েদের যখন তখন ধরে ধর্ষণ ও হত্যা করা যায়, মুসলমানদের ইচ্ছা করলেই যেকোনো অজুহাতে প্রকাশ্যে খুন করে ফেলা যায়। কখনো গরুর গোশত ফ্রিজে রাখার অজুহাতে, কখনো স্র্রেফ ট্রেনের ফার্স্টক্লাস কমপার্টমেন্টে ওঠার অপরাধে (যদিও টিকিট কেটেই উঠেছিল হতভাগা)। তা ছাড়া হিটলারের ইহুদি নিধনের মতো ভারতজুড়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর একটি সুপরিকল্পিত প্রচারণা এই মুহূর্তে চলছে। বিষয়টিকে অনেকে নির্বাচনে ভোট আকর্ষণের সাথে যুক্ত করে দেখেন। সেটি ঠিক আছে, কিন্তু বৃহত্তর হিন্দু জনগোষ্ঠীর মনে মুসলিমবিদ্বেষের যে দাবানল ওরা জ্বালিয়ে দিচ্ছে, তা নিভবে কী দিয়ে? রামের জন্মস্থান সম্পর্কিত আলোচনা যে উত্তেজনা তৈরি করে তা নিভেছিল উন্মত্ত হিন্দুদের হাতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে। মুসলিমবিদ্বেষ নেভার জন্যও একটি মহাযজ্ঞের দরকার হবে। আর আমাদের গভীরতর শঙ্কা এই, ভারতের আসন্ন নির্বাচনে বিরোধীদের ইন্ডিয়া জোট বিজেপিকে হঠাতে ব্যর্থ হলে ওই মহাযজ্ঞ শুরু হতে পারে মুসলিম নিধনের মধ্য দিয়ে।

যাই হোক, আলোচনার ডালপালা ছেড়ে আমরা মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। মুসলিমরা ছাড়া হিন্দুবাদী ভারতের চেহারা চেনে শিখরা।

১৯৮৪ সালে জারনাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের ‘খালিস্তান’ আন্দোলন দমনের জন্য শিখদের পবিত্র স্বর্ণমন্দিরে হামলা চালায় ভারতীয় বাহিনী। ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ নামে সেই অভিযানে মন্দির অক্ষত রেখে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় মহাপবিত্র ‘আকাল তখত’। মন্দিরের ভেতর হত্যা করা হয় অন্তত ৫০০ শিখকে। পরিণাম ভালো হয়নি। তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে জীবন দিতে হয় তারই সুশিক্ষিত শিখ দেহরক্ষীদের গুলিতে। ‘সুশিক্ষিত’ শিখ দেহরক্ষী শব্দটি বলে যে, সাধারণ শিখ যারা কঠোর সামরিক শৃঙ্খলায় বেড়ে ওঠেনি, যারা নিছকই ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ তারা কতটা ভারতবিরোধী হতে পারে। এক ইন্দিরা হত্যার জেরে সারা ভারতে হত্যার শিকার হয় প্রায় দুই হাজার শিখ। সেই ধর্মীয় অবমাননা ও নিপীড়ন শিখরা কখনো ভোলেনি। বর্তমান বিশ্বে শিখদের খালিস্তান আন্দোলন সেই চেতনায় উজ্জীবিত। এটি শুধু কানাডাতেই চলছে এমন নয়, তারা সংগঠিত হচ্ছে ইউরোপের দেশে দেশে।

আজ ট্রুডো হয়তো ভারতের অবস্থানটা পুরো উন্মোচন করতে পারবেন না। ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে লুকানো ধর্মীয়বিদ্বেষের কদাকার চেহারা আড়ালেই থেকে যাবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই মুহূর্তে চীন ঠেকানোর চেয়ে বড় কোনো ইস্যু নেই। কিন্তু ট্রুডো শুরুটা করে দিয়েছেন। আজ বা কাল অন্য দেশগুলোকেও বিষয়টি গণনায় নিতে হবে। এটি এ জন্য হবে যে, নরমাংসের স্বাদ পাওয়া বাঘ কখনোই মানুষ শিকারের নেশা ছাড়তে পারে না। বিদেশের মাটিতে অন্তত গোটা পাঁচেক খালিস্তান নেতাকে হত্যা করে রেহাই পেয়ে গেলে ভারত আরো বেপরোয়া হবে এবং তার বীভৎস চেহারা বেরিয়ে আসতে পারে।

mujta42@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement