২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


দ্য ঘোস্ট রাইটার ও দেশের বাস্তবতা

দ্য ঘোস্ট রাইটার ও দেশের বাস্তবতা - নয়া দিগন্ত

অ্যাডাম ল্যাঙ ব্রিটেনের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন প্রধানমন্ত্রী। তিনি অসম সাহসী এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি পারেন না এমন কাজ নেই। তার অভিধানে ব্যর্থতা শব্দটি নেই। দেশের রাজনীতিতে তিনি চমক সৃষ্টি করতে পারেন দিনকে রাত এবং রাতকে দিন করে দিয়ে। পারেন বিশ^রাজনীতির জোয়াল নিয়ন্ত্রণ করতে। তার রাজনীতির অভিধানে জোরালোভাবে আছে গুম, খুন, হত্যার মতো জনপ্রিয় শব্দগুলো।

না, এটি ব্রিটেনের কোনো বাস্তবের প্রধানমন্ত্রীর বিবরণ নয়। ব্রিটেনে অ্যাডাম ল্যাঙ নামে কেউ কোনোকালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন না। কিন্তু সারাবিশ্ব প্রধানমন্ত্রী অ্যাডাম ল্যাঙ-এর নাম জানে। কারণ, তিনি এক জনপ্রিয় ও বেস্ট সেলার উপন্যাসের নায়ক। ক্ষমতা, রাজনীতি, দুর্নীতি এবং হত্যার মতো অপরাধের ওপর এই বইটির লেখক ব্রিটিশ সাংবাদিক ও ঔপন্যাসিক রবার্ট হ্যারিস- যিনি পম্পেই ও এনিগমার মতো দুর্ধর্ষ উপন্যাসের জন্য বিখ্যাত। আর হলিউডের অন্যতম সেরা চিত্র পরিচালক রোমান পোলানস্কি ‘দ্য ঘোস্ট রাইটার’ নামের ওই রাজনৈতিক থ্রিলার (২০০৭) নিয়ে সাড়া জাগানো ছবি তৈরি করেছেন (২০১০)।

হ্যাঁ, ঘোস্ট রাইটার। ভুতুড়ে, ভাড়াটে অথবা বেনামি লেখক। সম্প্রতি দেশে বহুল আলোচিত বিষয়। গত ৭ সেপ্টেম্বর বার্তা সংস্থা এএফপির অনুসন্ধানী রিপোর্ট ‘নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের সরকারের প্রশংসা করে মিডিয়ায় লিখছেন ভুয়া বিশেষজ্ঞরা’ প্রকাশের পর আলোচনার সুনামি বয়ে যায় রাজনৈতিক অঙ্গন ও মিডিয়া জগতে। লেখা হয় অনেক সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ। সামনে আসে সরকারের গত এক বছরে প্রচারণা খাতে নেয়া বিভিন্ন কর্মসূচির ফিরিস্তি, যার মধ্যে অন্যতম ছিল, ‘অভিবাসী কূটনীতি’ নামে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নতুন একটি অধিশাখা গঠন এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে ‘ইতিবাচক’ আর্টিকেল লেখানোর জন্য সরকারি বাজেট থেকে সম্মানী দিয়ে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কলামিস্ট ভাড়া করার মতো বিষয়গুলো।

আমরা সে প্রসঙ্গে যাব না। বরং উপন্যাসের কাহিনীটা দু’চার কথায় দেখে নিই। ব্রিটিশ রাজনীতির অবিকল্প ক্রীড়নক এবং চরম বিতর্কিত প্রধানমন্ত্রী অ্যাডাম ল্যাঙ পদত্যাগের পর স্মৃতিচারণমূলক বই লিখতে চান। এজন্যে তিনি ভাড়াটে লেখক জোগাড় করেন। ভাড়াটে লেখকের দায়িত্ব কী? তিনি ক্লায়েন্টের দেয়া রেখাচিত্রের ওপর কাজ করে সেটিকে এমন এক বইয়ের রূপ দেবেন যা ক্লায়েন্টকে একজন চমৎকার মানুষ হিসাবে জনসমক্ষে তুলে ধরবে। তার সুনাম বাড়িয়ে দেবে।

উপন্যাসের ভাড়াটে লেখকের জন্য অ্যাডাম ল্যাঙ-এর মতো রাজনীতিকের জীবনী লেখা ছিল বিরাট সুযোগ, কারণ সম্মানীর পরিমাণ অকল্পনীয়। এমন সুযোগ জীবনে একবারই আসে। লেখক প্রচণ্ড শীতের ঋতুতে অ্যাডাম ল্যাঙের সাথে কাজ করতে প্রত্যন্ত উপকূলীয় দ্বীপে উড়ে যান- যেখানে তিনি পরিচিত সব মানুষ থেকে, গোটা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন।

লেখক জানতে পারেন, তার আগে আরেকজন ভাড়াটে লেখক একই দায়িত্ব পালন করতে এসে মর্মান্তিকভাবে নিহত হয়েছেন। বিচ্ছিন্নতা এবং আগের লেখকের অস্বাভাবিক মৃত্যু দ্বিতীয় লেখকের অস্বস্তির একমাত্র কারণ ছিল না। তিনি জানতে পারেন, তার ক্লায়েন্টের অতীত জীবন গভীর গোপনীয়তার চাদরে মোড়া, তিনি এমন এক ব্যক্তি যার আছে ইতিহাসের সত্য পাল্টে দেবার ক্ষমতা। যদিও জীবনে কিছু ভুলভ্রান্তিও তিনি করেছেন। যেমন, বিতর্কিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে বিশ^শক্তি আমেরিকার সঙ্গে যোগ দেয়া। এই ভুলের কারণে শেষ পর্যন্ত তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। লেখক উপলব্ধি করেন তিনি সম্ভবত জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছেন।

দ্য ঘোস্ট রাইটার প্রকাশ পায় ২০০৭ সালে। তার আগে ২০০৩ সালে ব্রিটেন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমেরিকার সঙ্গী হয়ে ইরাক আক্রমণ করে। সচেতন পাঠকের কি বুঝতে বাকি আছে, অ্যাডাম ল্যাঙ আসলে কে?

আমরা জানি, টনি ব্লেয়ার ক্ষমতায় থাকতেই মিডিয়ার বিচারে যুদ্ধাপরাধী সাব্যস্ত হন। সেটি ঘটেছিল নাট্যমঞ্চে, টেলিভিশনের সিরিয়ালে এবং সবশেষে হ্যারিসের উপন্যাসে। পরে সরকারি তদন্তেও টনি ব্লেয়ার চরম মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হন।
যা হোক, ঘোস্ট রাইটারের আইডিয়া কিন্তু নতুন নয়। এরা যে খুব অস্পৃশ্য বা নিন্দিত তা-ও না। অনেক দেশেই বেনামি লেখকের তালিকা থেকে লেখক খুঁজে নেয়া যায়। তার মানে বিষয়টি লুকোছাপার কিছু নয়। অস্ট্রেলিয়ার লেখক সমিতি অঁংঃৎধষরধহ ঝড়পরবঃু ড়ভ অঁঃযড়ৎং (অঝঅ) এ ধরনের লেখকের তালিকা অনলাইনে দিয়েছে। বাংলাদেশেও অনেক টাকাওয়ালা লোক ভাড়াটে লেখক দিয়ে আত্মজীবনী লেখান। এমন কিছু লেখকের নামও অনেকে জানেন। সেবা প্রকাশনীর ভাড়াটে লেখকেরা কাজী আনোয়ার হোসেনের স্মরণীয় সৃষ্টি মাসুদ রানা সিরিজ লেখায় যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন সেটি তুঙ্গ স্পর্শ করে।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডাম ল্যাঙের কাহিনী নিছকই কল্প-কাহিনী, ফিকশন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার যা করেছে সেটি অভিনব। গোয়েবলসের প্রপাগান্ডা কৌশল বিশ্বসেরা হলেও তার সময়ে রাষ্ট্রের তথা জনগণের কষ্টের টাকা খরচ করে কলামিস্ট ভাড়া করার নজির নেই। সেদিক থেকে বাংলাদেশ সরকার সম্ভবত একটি নতুন বিশ্বরেকর্ড করেছে, ইতিহাস যার মূল্যায়ন একসময় নিশ্চয়ই করবে।
সরকারিভাবে বলা হয়েছে, বিদেশে বসে যারা বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে তাদের দাঁতভাঙা জবাব দেবেন ভাড়াটে কলামিস্টরা। দেশের বাইরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে তাদের দিয়ে ‘গঠনমূলক ও ইতিবাচক প্রবন্ধ, অনুচ্ছেদসহ নানা ধরনের লেখা’ প্রকাশের ব্যবস্থা করা হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমিন ২০২২ সালের আগস্টে অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বলেছিলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে আর্টিকেল লেখার মতো দক্ষ জনবল না থাকায় আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কলামিস্টদের দিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক আর্টিকেল লেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বৈঠকে কমিটির সদস্য নাহিম রাজ্জাক বলেছিলেন, ইদানীং দেশের বাইরে বিভিন্ন ডায়াসফোরাগুলো ব্যাপকভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে। এর মোকাবিলায় মিশনগুলোর জোরালো ভূমিকা রাখা উচিত।

সাংবাদিক হিসাবে বিদেশের কোথায় কে কী ধরনের প্রচারণা চালাচ্ছেন সেটি অনুসরণ করা আমাদের স্বাভাবিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এজন্যে প্রায়শ বিশেষ করে লন্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্কের প্রবাসী বাংলাদেশী অ্যাকটিভিস্টদের সোশ্যাল মিডিয়া ফলো করতে হয়। সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বিদেশে যারা সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেন তাদের কেউই কোনোভাবেই ‘বাংলাদেশবিরোধী’ প্রচারণার সঙ্গে সামান্যও জড়িত নন। তারা যেটি করেন তা হলো, তাদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সরকারের নানা অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা এবং ভুলভ্রান্তি তুলে ধরা। এটি মত প্রকাশের অধিকারের আওতাভুক্ত।
তবে হ্যাঁ, এটাও সত্য যে, সরকারের কাজের সমালোচনা করতে গিয়ে কেউ হয়তো অসত্য তথ্যও উপস্থাপন করেন। সেটি সব সময় অসদুদ্দেশ্যে করেন এমন না। বিদেশ থেকে তথ্যের সত্যতা শতভাগ নিশ্চিত হওয়া কঠিন। যখন এ দেশে তথ্য শেয়ার করতে গেলে প্রায়শ মৃত্যুর ঝুঁকি পর্যন্ত থাকে।

আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলে নয়। বিদেশ থেকে যারা অ্যাকটিভিজম করেন তাদের কেউ কেউ ভাষা ব্যবহারে এবং প্রকাশ ভঙ্গিতে অনেকটাই অমার্জিত, অসংযত এবং ক্ষেত্রবিশেষে অশালীনও। সেটি তাদের রুচিবোধের ব্যাপার বলে এড়িয়ে যেতে পারলে খুশি হওয়া যেতো। সে সুযোগ নেই। যারা বিদেশে বসে সরকারের কথিত অপকর্মের সমালোচনা করছেন তাদের অনেকে দেশে অন্যায়, অত্যাচার ও জুলুমের শিকার হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হন। কেউ বা জীবনের ঝুঁকির মুখে কোনোরকমে পৈতৃক প্রাণটা হাতে নিয়ে পালিয়ে বাঁচেন। তাদের ক্ষোভ কি খুব অস্বাভাবিক? আবার বিদেশে বসে সমালোচনার কারণে যদি কারো দেশে বসবাসরত পরিবারের ওপর জুলুম হয়, তার জবান সংযত রাখা দুঃসাধ্য। অসংযত রসনা তার ক্ষোভ প্রশমন করে। তখন এমনকি সত্যমিথ্যা, বৈধ অবৈধ কোন অস্ত্রে আপনাকে ঘায়েল করবে তা দেখার সুযোগও কমই থাকে। আল্লামা সাঈদীর মৃত্যুতে শোক জানানোর কারণে যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি গবেষণারত শিক্ষার্থীর মাকে পুলিশের ধরে নিয়ে যাবার টাটকা কাহিনী তো কেউ ভুলে যায়নি। ভুলে যায়নি প্রবাসী এক সাংবাদিকের বোনকে অত্যাচার করার কাহিনীও।

ছেলেবেলা থেকে প্রবাদবাক্য শুনে আসছি, চুরিবিদ্যা বড় বিদ্যা, যদি না পড়ে ধরা। সচরাচর পরীক্ষায় নকল বা ঘুষ খাওয়ার মতো প্রসঙ্গে কথাটা বলা হয়। আমাদের মনে হয়, ভাড়াটে লেখকদের আউটসোর্সিং-এর নামে সরকার যে অস্তিত্বহীন তথাকথিত ‘বিশেষজ্ঞ-বিশ্লেষক’ মাঠে নামিয়েছে এটি এক অর্থে চুরি-জোচ্চুরির পর্যায়েই পড়ে। কারণ, লেখকের যেখানে অস্তিত্ব নেই, সেখানে এ খাতে বরাদ্দ করা অর্থ (শোনা যায়, বিপুল পরিমাণ) কোথায় কে কিভাবে পকেটে পুরলো সে প্রশ্ন উঠবেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তো ব্যয়ের খাত দেখাতে হবে একদিন।

mujta42@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement