০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫
`


রাজা-বাদশাহদের অমরত্ব লাভের বাসনা!

-

রাজা-বাদশাহদের বিরাট অংশ মরতে চান না। অনেকে অমরত্ব লাভের জন্য শেষ নিঃশ্বাস অবধি চেষ্টা-তদবির করে গেছেন। মহাচীনের প্রথম সম্রাট শি হুয়ান টি মরতে চাননি। আজ থেকে দুই হাজার ২০০ বছর আগে তিনি যখন মারা যান তখন বেঁচে থাকার জন্য তার যে আকুতি এবং মৃত্যুপরবর্তী জীবন সম্পর্কে তার যে আতঙ্ক তা আজ অবধি বিশ্ব ইতিহাসের কিংবদন্তির দলিল হয়ে আছে। সম্রাট শি হুয়ান-এর মতো কুবলাই খানও মরতে চাননি। চেঙ্গিস খানের পৌত্র অর্থাৎ নাতি কুবলাই খান অমর হতে না পারলেও দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন। ৮০ বছরের সুদীর্ঘ বর্ণাঢ্য জীবন এবং ৩০ বছরের গৌরবময় রাজত্বকালে পৃথিবীর মানচিত্রের বিশাল অংশে তিনি যে সুশাসন-ন্যায়বিচার এবং প্রজাদের কল্যাণে যেসব যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন তার দ্বিতীয় নজির মহাকালের ইতিহাসে নেই।

চীনের প্রথম সম্রাট শি হুয়ান টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা না গেলেও কুবলাই খানের ইতিহাস আজও জীবন্ত হয়ে আছে মূলত বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পলোর কারণে। মার্কো পলোর লিখনী থেকেই আমরা জানতে পারি, মধ্য যুগের দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসকদের কুবলাই খান তার রাজধানীতে জড়ো করেছিলেন অমরত্ব লাভের উপায় উদ্ভাবনের জন্য। কুবলাই খানের মতো মিসরীয় ফেরাউনরাও চেষ্টা করেছিলেন অমরত্ব লাভের জন্য। কিন্তু তারা যখন দেখলেন, নশ্বর জীবনে দেহজাত অমরত্ব অসম্ভব তখন তারা মৃত্যুর পর নিজেদের দেহকে অমরত্ব দানের জন্য মমি তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেন এবং সেসব মমি সংরক্ষণ করে অনাগত দুনিয়াকে নিজেদের সুনাম-সুখ্যাতি-বল-বীর্য সম্পর্কে জানান দেয়ার জন্য একের পর এক পিরামিড নির্মাণ করতে থাকেন।

আদিকালের রাজা-বাদশাহদের মতো হালআমলের ক্ষমতাধর মন্ত্রী, এমপি, প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতিরা তাদের নশ্বর দেহ নিয়ে আজীবন বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেন না। তবে ক্ষমতায় বসে তারা মৃত্যুর কথা বেমালুম ভুলে যান- এমনকি তাদেরকে যদি নিশ্চিত জান্নাত দেয়া হবে এমন প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়, তবুও তারা মরতে চান না। এখন প্রশ্ন হলো- ক্ষমতাধর লোকদের মধ্যে পার্থিব জীবনের প্রতি কেন লোভ-লালসা প্রবল থাকে এবং কেনই বা তারা মৃত্যুর কথা ভুলে গিয়ে দুনিয়াকে জীবনের সব সফলতার চাবিকাঠি মনে করেন? বিষয়টি নিঃসন্দেহে জটিল এবং ক্ষমতাধরদের মন-মানসিকতা, শিক্ষা, জন্ম, ক্ষমতা লাভের প্রেক্ষাপট, কর্মচিন্তা ইত্যাদি বহুবিধ বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। মানুষের দেহজাত ভোগ-বিলাস, আরাম-আয়েশ, ক্লান্তি, দুর্ভোগ, রোগ-শোকের মতো মন ও মস্তিষ্কের মাধ্যমেও মানুষ নিদারুণভাবে তাড়িত হয়। মানুষের পাঁচটি ইন্দ্রিয় দ্বারা যেমন মানুষ সুখ-শান্তি সন্তুষ্টি ভোগ করে তদ্রূপ ইন্দ্রিয়জাত জুলুম-অত্যাচার-রোগ-শোক ইত্যাদি দ্বারা মানুষের আত্মা-শাস্তি পেতে থাকে। আমাদের স্বাভাবিক জীবনের প্রায় সব কিছুই অঙ্কের মতো। ভালো কাজের ভালো ফল- মন্দ কাজের মন্দ পরিণতি। অন্য দিকে মন ও মস্তিষ্ক সাধারণত অঙ্কের চেয়ে রসায়ন দ্বারা বেশি প্রভাবিত। মানুষের শুভ কর্ম দ্বারা মন ও মস্তিষ্কে এক ধরনের রস সৃষ্টি হয় যা তাকে সৃষ্টির সেরা জীবে পরিণত করে। অন্যদিকে, মন্দ কর্মের দ্বারা যে বিষ মন ও মস্তিষ্কে জমা হয় তা মানুষকে প্রকৃতির নিকৃষ্ট কীট-পতঙ্গ, জন্তু-জানোয়ার এবং ইবলিসে পরিণত করে ফেলে।

মানুষ যখন পরিশ্রমের কাজ করে তখন তার মধ্যে অঙ্ক এবং রসায়ন যেভাবে কাজ করে তা সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে যায় যখন সে অলসের জীবনযাপন করে। একইভাবে সফলতা এবং ব্যর্থতর কারণেও জীবনের অঙ্ক উলটপালট হয়ে যায়। ভোগের কারণে ভোগী এবং ত্যাগের কারণে যোগী প্রকৃতির মানুষ তৈরি হয়। মানুষের পেশা-শিক্ষা-দীক্ষা-বংশ ও আঞ্চলিকতার প্রভাবও তার জীবনে অনেক কিছুর নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। মানুষ যখন তার নিজের প্রয়োজনে ব্যবসায়-বাণিজ্য কিংবা অন্য কোনো পেশায় নিয়োজিত থাকে তখন তার জীবনে উল্লিখিত বৈজ্ঞানিক সূত্রগুলো মোটামুটি প্রযোজ্য হয়। কিন্তু মানুষ যখন রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করে তখন তার জীবনে শরীরের ক্ষেত্রে কেবল জীববিদ্যা প্রযোজ্য হয় অর্থাৎ বেশি খেলে পেট খারপ- কম খেলে দুর্বল, পরিশ্রম করলে ক্লান্তি- অলস থাকলে নির্জীব ইত্যাদি ঘটনা ঘটতে থাকে। কিন্তু তার মন-মস্তিষ্ক ও ইন্দ্রিয়জাত কর্মকাণ্ড দুনিয়ার স্বাভাবিক নীতি-নৈতিকতা-বোধ, বুদ্ধি-বিজ্ঞান অথবা ধর্ম-কর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন রাজা-বাদশাহদের মন-মানসিকতায় এমন একটি অপার্থিব অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত বিষয় ভর করে যার কারণে তারা বেশির ভাগ সময় পৃথিবীর নির্মম বাস্তবতা ভুলে যান।

উল্লিখিত কারণে আমরা কোনো কোনো রাজা-বাদশাহকে দেখি চীনের মহাপ্রাচীর, আগ্রার দুর্গ, কুতুব মিনার অথবা ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগান নির্মাণ করতে। কাউকে দেখি মানুষের খণ্ডিত মস্তক দিয়ে পিরামিড তৈরি করতে। কেউবা মানুষের রক্ত পান করেছেন- আবার কেউ কেউ মানুষের যকৃৎ বা কলিজা খেয়ে অমরত্ব লাভের চেষ্টা করেছেন। কারো কারো বাসনা অর্থের প্রতি এতটা প্রবল ছিল যে, তামাম দুনিয়ার ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করে একত্রে জড়ো করার মধ্যে অমরত্ব খুঁজে বেড়িয়েছেন। কাম দ্বারা তাড়িত হয়ে হাজার হাজার তরুণীকে হেরেমে বন্দী করেছেন। যারা মদ-জুয়া-পাশায় আসক্ত ছিলেন তারা দুনিয়ার সব কিছু ভুলে কেবল ওসবে মত্ত থেকেছেন। আর যারা জুলুম-অত্যাচারে আসক্ত হয়েছিলেন তাদের কাছে মানুষের আর্তচিৎকারের চেয়ে চিত্তবিনোদনের অন্য কোনো উপায় অবশিষ্ট ছিল না।

রাজা-বাদশাহদের উল্লিখিত মন্দ দিক ছাড়াও যেসব কল্যাণকর দিক রয়েছে তা নিয়ে আজকের নিবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করব না। রাজা-বাদশাহদের শুভ কর্মের কারণেই আজকের দুনিয়া আধুনিক সভ্যতার চূড়ান্ত শিখরে যেমন পৌঁছেছে তদ্রূপ তাদের কুর্মের জন্যই কখনো কখনো মানব সভ্যতা হাজার বছর পিছিয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ সভ্যতার চাকাটিকেই উল্টো পথে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। যারা ভালো কাজ করেছেন তারা সবাই অমরত্ব লাভের জন্যই করেছেন। অন্য দিকে, মন্দ রাজা-বাদশাহরাও অমরত্ব লাভের লালসায় সব কিছু তছনছ করেছেন। ভালো শাসকদের অমরত্ব এবং মন্দ শাসকদের অমরত্বের মৌলিক পার্থক্য হলো- ভালোরা মরে গিয়ে অমরত্ব লাভের চেষ্টা করে আর মন্দরা মরার কথা ভুলে গিয়ে আজীবন বেঁচে থাকার দুঃস্বপ্নের মধ্যে অমরত্ব খোঁজে।

আমরা আজকের আলোচনার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এবার শিরোনাম নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করে নিবন্ধের ইতি টানব। রাজা-বাদশাহদের যে অংশটি মৃত্যুর কথা ভুলে যায় এবং পার্থিব জীবনকেই নিজের অমরত্বের চাবিকাঠি মনে করে তাদের মন-মানসিকতা, চিন্তা-চেতনা, পঞ্চ ইন্দ্রিয় এবং পরিবেশ প্রতিবেশের মধ্যে পৃথিবীর যা কিছু মন্দ, যা কিছু নিকৃষ্ট এবং যা কিছু নিন্দিত তার সব কিছুই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংযুক্ত হয়। মানবরূপী দানবরা এসে তাদের উজির নাজিরে পরিণত হয়। তারা নিজেদের জন্য এমন একটি বদ্ধ ঘর তৈরি করে যেখানে মহাশূন্যের মতো পরিস্থিতি বিরাজ করে। অর্থাৎ আলো-বাতাস মাধ্যাকর্ষণ-মহাকর্ষণের মতো পৃথিবীর কোনো মৌলিক বৈশিষ্ট্য সেখানে থাকে না। ফলে তারা শব্দহীন বায়ুহীন পরিবেশে ওজনহীন হয়ে ফোলানো ফাঁপানো বেলুনের মতো ভাসতে থাকে। সেখান থেকে তারা যেসব অবাস্তব নিষ্ঠুর নির্মম মৃত্যুপরোয়ানা জারি করে তা তাদের দোসরদের মাধ্যমে লোকালয়ে এসে যে বিপর্যয় সৃষ্টি করে তার কোনো শব্দ তারা শুনতে পায় না। কোনো দৃশ্য তারা দেখতে পায় না এবং তাদের তৈরি করা আয়নাঘরের বাইরের দুনিয়ার কোনো কিছুই তারা আন্দাজ করতে পারে না। ফলে তাদের চিন্তা-চেতনা থেকে মৃত্যুভয় রহিত হয়ে যায় এবং পার্থিব জীবনের মধ্যেই নিজেদের অমরত্ব খুঁজে বেড়ায়।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement