২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


মানবাধিকার লুণ্ঠিত

-

মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য। অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও শাসকদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেই ‘রাজনীতির’ জন্ম। দুর্বলের ওপর সবলের প্রভাব সর্বকালের একটি প্রবণতা। দুর্বলকে সবলের আজ্ঞাবহ থাকার নিয়মনীতি আগেও ছিল, বর্তমানেও আছে, এখন তা প্রতিষ্ঠিত নিয়ম ও সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।

যার শক্তি যত বেশি, সে পেশিশক্তির বলে দখল করে নিত অন্য কোনো গোষ্ঠীকে। এ ধারা অনুপাতে ‘যুদ্ধ’ নামক একটি পার্থিব নেশা পৃথিবীতে জন্ম নেয়। যুদ্ধের নেশা সমুদ্র-মহাসমুদ্র ছাড়িয়ে পৌঁছেছে দেশ থেকে দেশান্তরে। বনজঙ্গল ও পাহাড় পর্বত ছেড়ে মানুষ যখন সভ্যতার ছোঁয়ায় কথিত সামাজিক জীবনে প্রবেশ করতে শুরু করে এবং পর্যায়ক্রমে বিজ্ঞান বিকশিত হতে থাকে, তখন কিছু ব্যক্তি বিবেকের তাড়নায় অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। মানুষের অধিকারের কথা বলতে শুরু করেন। রাজা-বাদশাহ বা শাসনকর্তাদের প্রণীত বিবর্তনমূলক আইন-কানুনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন। ফলে অনেক রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে সময়ে সময়ে অর্জিত হয়েছে গণমানুষের অধিকার, যার মধ্যে কয়েকটি অধিকার সনদ উল্লেখ করা যেতে পারে।

ইংল্যান্ডের রাজা জন ১২১৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘ম্যাগনা কার্টা’ নামক একটি নাগরিক অধিকার সনদে স্বাক্ষর করেন, যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল- ‘‘No Freeman shall be taken or imprisoned or be deprived of his liberties, or free custom or outlawed or exiled or any otherwise destroyed, nor will be pass upon him nor condemn him, but by the lawful Judgement of his peers or by the law of the land.”

পরবর্তীতে মানবাধিকার বা মানুষ হিসেবে প্রাপ্ত জন্মগত অধিকার নামান্তরে Natural Right বাস্তবায়নের জন্য ১৬২৮ সালে স্বাক্ষরিত হয় Petition of Rights, ১৬৮৯ সালে স্বাক্ষরিত হয় Bill of Rights, ১৭৮৯ সালে French Declaration of the Rights of Man and the Citizen, ১৮০৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে দাস প্রথা বিলোপ করা হয় এবং এমনিভাবে পর্যায়ক্রমে অগণিত মানবাধিকার সনদ প্রণীত হয়েছে। কাগজে-কলমে দাস প্রথা বিলুপ্ত হলেও দাসত্ব বন্ধ হয়নি, বরং বৃদ্ধি পেয়েছে মানসিক দাসত্ব। জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে নিম্নবর্ণিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ প্রণীত হয়। যথা- ১. Universal Declaration of Human Rights, 1948, ২. International Covenant on Civil and Political Rights’ 1966, ৩. International Covenant on Economic, Social & Cultural Rights, ৪. Universal Declaration on the Eradication of Hunger and Malnutrition, ৫. Convention Against Tourture & other cruel, Inhuman or Degrading Treatment on Punishment, ৬. Convention of the Preveantion and Punishment of the crime of genocide, ৭. Convention or the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women, ৮. Convention on the Rights of the Child.

দেশে মহাদেশে মানবাধিকার বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গঠিত হয়েছে মহাদেশভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠন/প্রতিষ্ঠান। যেমন- ১. Council of Europe (ইউরোপ), ২. Organisation of American States (আমেরিকা), ৩. Organisation of African Unity (আফ্রিকা), ৪. The ASEAN Intergovermental Commission on Human Rights (AICHR) (এশিয়া)।

অনুরূপ বাংলাদেশেও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে জাতীয় পর্যায়ে ২০০৯ সালে গঠিত হয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। এত কিছুর পরও পৃথিবীতে বা আমাদের সমাজে প্রভাববিহীন বিচারব্যবস্থা ও মানবাধিকার কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে?

পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষ পাতালপুরী থেকে নভোমণ্ডল, উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু সর্বক্ষেত্রে বিচরণ করছে, নভোমণ্ডলে বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা করছে, বিভিন্ন গ্রহে প্রাণীর সন্ধান পেতে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু মানবাধিকারসংক্রান্ত সনদ বাস্তবায়ন হয় না কেন বা ভাগ্যহত মানুষ তার অধিকার থেকে কেন বঞ্চিত, কেন বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে?

মোগল সাম্রাজ্যের শেষ অধিপতি বাহাদুর শাহ জাফরকে কারাবন্দী করে সাজানো রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিচার এবং বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদৌল্লাহকে হত্যা করে ব্রিটিশ সরকার এ উপমহাদেশে ক্ষমতা পরিবর্তনে বিচার বিভাগকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে প্রতিহিংসার রাজনীতির জন্ম দেয়।

মানবাধিকারের আনুষ্ঠানিক প্রথম ঘোষণা ম্যাগনা কার্টার সনদে উল্লেখ করা হয়েছিল, একটি ল’ফুল জাজমেন্ট ছাড়া কারো জীবন, স্বাধীনতা, সম্পদ, সম্মানসহ সর্বোপরি কোনো অধিকার থেকে কোনো নাগরিককে বঞ্চিত করা যাবে না। অথচ এখন শাসকদল কর্তৃক আইন পাস করাই হয় মানুষের অধিকার হরণের উদ্দেশ্যে। বিচারক নিয়োগ হন দলীয় বিবেচনায়। এ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনার পরও পুরোনো ধারা আরো জোরদার হচ্ছে। কোর্ট প্রাঙ্গণে জনশ্রুতি রয়েছে, উচ্চ আদালতের বেঞ্চ গঠন হয় দলীয় বিবেচনায়, এ অভিযোগ দীর্ঘ দিনের হলেও আইনাঙ্গনে বর্তমানে তা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বিবর্তন এবং অধিকার হরণের হাতিয়ার অর্থাৎ তল্পিবাহক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দুর্নীতি দমন ব্যুরো পরবর্তীতে দুর্নীতি দমন কমিশন নিজেরাই সর্বসময়ে বিরোধী দলকে নির্যাতনের প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দুদকে উপস্থিত হওয়ার জন্য কোনো নোটিশ ইস্যু করলে, সে নোটিশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বাড়িতে পৌঁছার আগেই দুদকের দালাল বা কর্মচারীরা ঘুষের টাকার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়, ওই ব্যক্তি জেলে থাকলে আত্মীয়স্বজনকে টাকার জন্য চাপ দেয়। এ ধরণের কিছু অসৎ কর্মচারী ধরা পড়েছে, অনেকেই রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। দুদককে অনেক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এবং বিচার বিভাগ দুদকের দেয়া তথ্যনুযায়ী কিছু ভিন্নতা ছাড়া বিরোধী দলকে একতরফাভাবে সাজা দিয়ে দেয় বলে পাবলিক পারসেপসন।

দুদকের মামলায় বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সব রাজনীতিবিদকে দুর্নীতিবাজ মনে করতেন, তার কথায় মনে হতো তিনিই একমাত্র সাধু এবং দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার একমাত্র দায়িত্বই যেন ছিল তার একার। এখন সিনহা বাবু নিজেই দুদকের বেড়াজালে আটকে গেছেন অথচ তিনিই সময়ে সময়ে দুদক আইনকে শক্তিশালী করেছেন এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১ক ধারা মোতাবেক প্রদত্ত ন্যায়বিচারের স্বার্থে হাইকোর্টের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা সঙ্কুচিত করেছেন। এখন তিনি বলছেন, সরকার তার কাঁধে বন্ধুক রেখে শিকার করেছে এবং এখন তিনি যা প্রকাশ করছেন তা শপথ ভঙ্গেরই নামান্তর। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি যদি কারো রক্তচক্ষুকে সমীহ করে বা সরকারের তল্পিবাহক হয়ে রায় দেন তবে ম্যাগনা কার্টার সনদের ল’ফুল জাজমেন্ট নির্ভরতা থাকে কোথায়?

জনগণের স্বার্থের প্রটেকশন দেয়ার জন্য সংবিধানে সৃজন করা হয়েছে কিছু সাংবিধানিক স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু নিরপেক্ষ থাকার শপথগ্রহণ করে দায়িত্বপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা যখন নগ্ন হয়ে মানসিক দাসত্ব করে তখন অধিকারবঞ্চিত মানুষ ল’ফুল জাজমেন্ট খুঁজবে কোথায়? ন্যায়বিচার এবং আইনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার মাধ্যম হলো ‘বিবেক’। এই বিবেককে ধ্বংস করে দাসত্ব, কার্যত মানসিক দাসত্ব। সে মানসিক দাসত্ব থেকে নিরাপদ থাকার উপায় কি বা এর সমাধান কোথায়?

দুদক আইন-২০০৪ বিএনপির ক্ষমতাকালে পার্লামেন্টে অনুমোদিত হয়। সামরিক সমর্থিত ওয়ান-ইলেভেন সরকার সংসদ ভবনে কোর্ট বসিয়ে টাস্কফোর্স কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ভুয়া কাগজপত্রের ওপর ভিত্তি করে জাতীয় সংসদ ভবনে প্রতিষ্ঠিত বিশেষ আদালতে বিচার করত। প্রধানমন্ত্রী তখন ওই আদালতকে ক্যাঙ্গারু কোর্ট বলে আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, তাদের প্রদত্ত রায় অন্য জায়গা থেকে লেখা হয় এবং ক্যাঙ্গারু আদালতে পাঠ করে শোনানো হয় মাত্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন আরো বলেছিলেন, এগুলো হলো ‘ফরমায়েসি রায়।’ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় বসার পর তারেক রহমানকে যে বিচারক খালাস দিয়েছে দুদকের নোটিশে সে বিচারক এখন দেশান্তরী এবং যে বিচারক বিএনপি চেয়ারপারসনকে সাজা দিয়েছে তার হয়েছে প্রমোশন। এমতাবস্থায়, কোনটি ল’ফুল জাজমেন্ট এবং কোনটি ফরমায়েসি রায়- এগুলো একদিন অবশ্যই হয়তো প্রকাশ পাবে, তবে বিষয়টি সময়সাপেক্ষ হতে পারে, আবার এতে কালক্ষেপণ নাও হতে পারে, এটিই এখন পাবলিক পারসেপশন।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement