২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বিদেশী হস্তক্ষেপ যেভাবে আশীর্বাদ হলো

বিদেশী হস্তক্ষেপ যেভাবে আশীর্বাদ হলো। - ছবি : নয়া দিগন্ত

হস্তক্ষেপ শব্দটি সাধারণভাবে নেতিবাচক হলেও কিছু ক্ষেত্রে এটি আশীর্বাদ। দুই পক্ষ ঝগড়া বিবাদ করে নিঃশেষ হওয়ার বহু উদাহরণ রয়েছে। এ নিয়ে যুদ্ধ বেঁধে উভয় পক্ষ বিনাশ হয়, সাথে আরো বহু পক্ষের ক্ষতি করে দেয়। এই ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ উভয় পক্ষকে খামোশ করতে পারা লাভজনক। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপের আলাপ তোলার চেষ্টা হচ্ছে। এই হস্তক্ষেপ ক্ষতিকর কিছু এমন অর্থে। দেশের মিডিয়াতেও আমরা দেখলাম আয়োজন করে এসব বলা হচ্ছে। অথচ এই মিডিয়াই কোনো ধরনের টুঁ শব্দ করেনি যখন মানুষ গুম খুন হয়েছে, ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে, মতপ্রকাশের অধিকার হারিয়েছে। লুটপাট, মুদ্রাপাচারসহ সীমাহীন দুর্নীতির সাথে মিডিয়ার একটি অংশ জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এ অবস্থায় তাদের তোলা হস্তক্ষেপের অভিযোগ হালে পানি পাচ্ছে না।

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন প্রেস টিভি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমেরিকা হস্তক্ষেপ করছে বলে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। দেশটির প্রতি মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশের মানুষের বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে। পারস্য ও মুসলিম সংস্কৃতির মিশেলে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত সভ্যতার দাবিদার দেশটি বছরের পর বছর ধরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে ধুঁকছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের সহমর্মিতা দেশটির প্রতি রয়েছে। দেশটি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বড় শয়তান’ বলে গালি দেয়, তাদের এক নম্বর শত্রু বলে গণ্য করে। এ ধরনের শত্রুতার কারণ ভূ-রাজনীতি।

আমেরিকানদের অন্যায় নীতিকে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণ সমর্থন করে না। ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হোক, সেই প্রত্যাশাই এ দেশের জনগণ করে। বাংলাদেশ প্রশ্নে আমেরিকার নেয়া নানা পদক্ষেপকে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞার সাথে মিলিয়ে দেখা কোনোভাবে ন্যায়সঙ্গত হবে না।

প্রেস টিভির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়াশিংটন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানও এখন কার্যকর নেই। ফলে সরকার যা খুশি তা করতে পারছে। সম্ভবত বিষয়টি প্রেস টিভি জানে না। বাংলাদেশে ইরানের যে দূতাবাস রয়েছে তাদের সক্রিয়তাও দেখা যায় না। চোখ কান খোলা রাখলে তারা দেখতে পেত, এ দেশের প্রধান গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ সরকারের খায়েশ বাস্তবায়েনের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। দুদক সরকারের একটি দ্বিধারী তলোয়ার। এটিকে দিয়ে তারা বিরোধী দলের লোকদের হেনস্তা করে। এমনকি যারা সরকারের মনোপূত কাজ করবে না তাদেরও সাইজ করে প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে। অন্যদিকে নিজেদের লোকদের পরিচ্ছন্ন মানুষ হিসেবে প্রদর্শন করার জন্য এ প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ দেয়া হয়। সর্বশেষ খবরে প্রকাশ হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের আট সংসদ সদস্যকে দুদক ‘নির্দোষ’ মানুষের সনদ দিয়েছে। অথচ সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে এদের কারো কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতি অনিয়ম ক্ষমতার অপব্যবহারের তথ্য রয়েছে। আরো জানা যাচ্ছে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এই ধরনের এক পাল দুশ্চরিত্রের লোককে দুদক চরিত্র সনদ দিতে যাচ্ছে। একই কাজ প্রতিষ্ঠানটি বর্তমান সরকারের আমলে আরো বহু করেছে। এখানেই শেষ নয়, ভেতর থেকে যেসব কর্মকর্তা সত্যিকার অর্থে দুর্নীতি দমন করতে চায় তাদের চাকরিচ্যুত করার ঘটনা ঘটিয়েছে দুদক। আবার প্রতিষ্ঠানের নিজের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি করার বহু অভিযোগ উঠেছে। একজন কর্মকর্তার দুর্নীতির কারণে আদালত থেকে দণ্ড পাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ওই কর্মকর্তা আরেক পুলিশের কাছ থেকে চাঁদা চেয়েছে। এভাবে একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধসে যাওয়ার পেছনে অন্য কোনো দেশ নয়, নিজ দেশের সরকার দায়ী, প্রেস টিভি এ নিয়ে একটি তদন্ত চালাতে পারে।

নির্বাচন কমিশন নামের প্রতিষ্ঠনটি কী করছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইরানের লোকেরা এসে আমাদের কমিশনের কর্মকর্তাদের কর্মকাণ্ড দেখলে বিষম খাবেন। মিথ্যা বলা, ছলচাতুরী করতে এরা সিদ্ধহস্ত। এই প্রতিষ্ঠানের একমাত্র কাজ সরকারের রাবার স্ট্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া ছাড়া অন্য কিছু নেই। ক্ষমতাসীনরা যাকে ইচ্ছা তাকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণার জন্য যা যা দরকার তা তা সব কমিশন করে থাকে। নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীকে গুম করে রাখার পর সেই নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে বলে বড় গলায় প্রচার করেছে। বিরোধীদের মারধর করে এলাকা ছাড়া করা, এজেন্টদের বের করে দেয়া এগুলো একেবারে মামুলি ব্যাপার। সরকারি দলের লোকেরা প্রকাশ্যে এসব ঘটলেও তারা সেটা দেখে না। প্রেস টিভি কি আমেরিকার বিরুদ্ধে এই নির্বাচন কমিশনকে ক্ষতিগ্রস্ত করার অভিযোগ আনছে? যে নিজেই আগে থেকে শতভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আছে, তাকে আমেরিকা আবার কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে?
বিরোধীরা অব্যাহতভাবে অভিযোগ করে যাচ্ছে, তারা বিচার পাচ্ছে না। বর্তমান সরকারের শুরু থেকেই বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা বিতর্কিত হয়ে গেছে। তবে বিরোধীদের এই আহাজারি এখন সাধারণ মানুষের মধ্য থেকেও আসছে। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন চক্রের রোষানলে পড়ে সাধারণ মানুষরাও বিচার পাচ্ছে না। একটি গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশসহ নিরাপত্তা বাহিনী জনগণের জানমালের হেফাজত করার কথা, সেই বাহিনীর বিরুদ্ধে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে মৃত্যুর হাজার হাজার অভিযোগ উঠেছে। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী কিছু ক্ষেত্রে জনসাধারণের জন্য যমদূত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সীমান্তে বিএসএফ ও মিয়ানমারের বাহিনী যেভাবে বাংলাদেশের সাথে আচরণ করতে চায় আমাদের দেশের বাহিনীও কিছু ক্ষেত্রে সেই আচরণই জনগণের সাথে করেছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে, সরকারের পক্ষ হয়ে তারা শত্রুর মতো আচরণ করে যাচ্ছে তাদের সাথে।

প্রেস টিভির সাংবাদিকরা হয়তো জানে না, ২০২১ সালের শেষের দিকে আমাদের একটি বাহিনী ও তার কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন শুরু হয়। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যার বিভীষিকা কমে আসতে শুরু করে। বিদেশী একটি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে নাগরিক হত্যা বন্ধ হলে সেই হস্তক্ষেপে অভিনন্দন জানানো দরকার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরোধীদের জন্য কোনো স্পেস ছিল না। ওই হস্তক্ষেপ সরকারের সেই বজ্র আঁটুনিকে ঢিল করে দেয়। সর্বশেষ দেশটির ভিসানীতি ঘোষণা বাংলাদেশের দমবন্ধ হওয়া পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে যাচ্ছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এজন্য আমেরিকার প্রতি কৃতজ্ঞ। তারা আশা করছে, হারিয়ে ফেলা নাগরিক অধিকার আমেরিকার হস্তক্ষেপের কারণে উদ্ধার হতে যাচ্ছে।

ভিসানীতি আমেরিকার অভ্যন্তরীণ বিষয়। একটি দেশ কাকে তাদের দেশে প্রবেশ করতে দিবে সেটা একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার। দেশটি সারা বিশ্বে এখন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রমোট করছে। যারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষতিসাধন করবে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করবে, তাদের তারা ভিসা দেবে না। এটি কোনোভাবে অন্য দেশের ওপর হস্তক্ষেপ নয়। পৃথিবীর যেকোনো দেশ নিজেদের স্বার্থে ভিসানীতি প্রণয়ন করতে পারে। এ ধরনের একটি নীতি ইরান, রাশিয়া, চীন, ভারত যে কেউ করতে পারে।

বিদেশী হস্তক্ষেপের যে কথাটি প্রেস টিভি বলছে, সেটা আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা জনমতকে গলাটিপে ক্ষমতা গ্রহণ করছে। জান্তাকে কারা সাহায্য করছে? এরা তো রোহিঙ্গাদের হত্যা করে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশেরও অপূরণীয় ক্ষতি করছে। দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র দেশগুলোর ওপর প্রতিনিয়ত ছড়ি ঘোরানো হচ্ছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে প্রকাশ্যে সাহায্য দিয়ে কারা টিকিয়ে রেখেছে? এভাবে সারা বিশ্বে বিদেশী রাষ্ট্রের অসংখ্য হস্তক্ষেপ দেখা যায়। প্রেস টিভি বাংলাদেশে আমেরিকার যে হস্তক্ষেপের কথা বলছে তাতে আমেরিকারও লাভ আছে, এতে সন্দেহ নেই। এতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষেরও লাভ রয়েছে। সেটা হচ্ছে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাওয়া ও পুনরায় স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করার সুযোগ পাওয়া। তাই এই হস্তক্ষেপকে স্বাগত জানায় বাঙালি। গণতান্ত্রিক বিশ্ব ও মুক্ত মিডিয়ার নৈতিক দায়িত্ব এ ধরনের শুভ হস্তক্ষেপের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ।
jjshim146@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement