২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বাবার নাম ভুলে যাওয়া বাবা দিবসের ইতিকথা

লেখক গোলাম মাওলা রনি। - ছবি : নয়া দিগন্ত

বাবার নাম ভুলে যাওয়া নিয়ে আমার জীবনে এ যাবৎকালে দুটো ঘটনা ঘটছে। প্রথমটি ঘটেছিল আমার জ্যেষ্ঠ পুত্রের ক্ষেত্রে। ছেলেটি যখন দশম শ্রেণীতে পড়ত তখন হঠাৎ একদিন রাস্তায় মহা মুসিবতে পড়েছিল- আর তখন অনেক চেষ্টা করেও সে পিতা হিসেবে আমার নামটি মনে করতে পারেনি। আজ সে পরিপূর্ণ যুবক সম্প্রতি বিয়েও করেছে। এবারের বাবা দিবসে আমি যখন মহাবিপত্তিতে ছিলাম এবং নিজের বাবার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম ঠিক তখন আমার পুত্রটি শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। নইলে ২০২৩ সালের জুন মাসের ১৮ তারিখ রোববার যে বাবা দিবস ছিল তা হয়তো জানতেই পারতাম না। বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত বলার আগে আমার বাবা এবং হালফ্যাশনের বাবা দিবস নিয়ে কিছু বলা আবশ্যক।

ব্যক্তিগত জীবনে আমি খুবই কাঠখোট্টা প্রকৃতির মানুষ। কথায় কথায় নীতিকথা, উঠতে বসতে নিয়ম-কানুন এবং যাপিত জীবনে মিতব্যয়িতা ও নিয়মানুবর্তিতা নিয়মিত চর্চার কারণে আমার আপনজনরা যে আমার প্রতি মহাবিরক্ত তা আমি বিলক্ষণ টের পাই। নিজের নির্মম অভিজ্ঞতা ও দ্বীন-দুনিয়ার নিষ্ঠুর বাস্তবতার কারণে আমি খুব ছোটবেলা থেকেই অপ্রয়োজনীয় খোশগল্প-আমোদ-প্রমোদ-আহার-বিহার থেকে শত যোজন দূরে থাকি। মা দিবস-বাবা দিবস, বিয়ে দিবস- জন্মদিবস ইত্যাদি আমার একদম পছন্দ না। ফলে পরিবারের অনেকেই মনে করে যে, আমি পোশাক-আশাকে আধুনিক হলেও মন মানসিকতায় বড্ড সেকেলে। আমার মিতব্যয়িতা নিয়ে আপনজনদের মিছরির ছুরির খোঁচা আমাকে হালফ্যাশনের বেহিসেবি জীবনযাত্রার অনুরক্ত বানাতে পারেনি। আমি আমার মতো ছুটে চলেছি এবং আমার বাবার শেখানো নীতি আদর্শ ধারণ করে পিতৃধর্ম পালনে রত আছি।

আমার বাবা বয়সে আমার চেয়ে বড়জোর ১৫ কিংবা ১৬ বছরের বড় ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার তেমন ছিল না কিন্তু তিনি ছিলেন সফলতম জ্ঞানী-বুদ্ধিমান-চরিত্রবান এবং ধার্মিক মানুষ। তিনি ছিলেন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, সমাজের নেতা এবং সংবেদনশীল হৃদয়ের মানুষ। আত্মীয়পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবার প্রতি তার দরদ ও দায়িত্ববোধের কথা স্মরণ করলে আমি আজও হতবাক হয়ে যাই। তার সবচেয়ে বড় সফলতা ছিল নিজের চিন্তা, কর্ম এবং আদর্শ আমার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া। ফলে আজও আমি ফজরের সময় তার গলার সুর শুনতে পাই এবং জীবনের সব সুখ-কিংবা দুঃখের সময় তার বদনখানি আমার সামনে ভেসে ওঠে। আমি একান্তে যখন বাবাকে নিয়ে ভাবি তখন মনে হয় তিনি আমার চেয়ে বুদ্ধিমান-চৌকস এবং শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তিনি ক্ষণজন্মা ছিলেন এবং মৃত্যুর আগে ১২ বছর শয্যাগত ছিলেন। তার রোগশয্যায় প্রাণান্ত সেবা করেছি। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে তার কামরায় গিয়ে সালাম করেছি। আবার অফিস থেকে ফিরে সবার আগে তাকে সালাম করে অন্যদের সাথে সাক্ষাৎ করেছি। আর এখন সর্বদা তার জন্য আল্লাহর শেখানো দোয়া করছি।

উল্লিখিত অবস্থায় বছরের নির্দিষ্ট দিনকে আমার কখনোই বাবা দিবস মনে হয়নি। আমার কাছে দিন-রাতের প্রতিটি ক্ষণই বাবার জন্য নিবেদিত এবং সেই নিবেদন আমার বিশ্বাস-কর্ম-আহার-নিদ্রায় প্রতি মুহূর্তে প্রতিফলিত হতে থাকে। ফলে বাবা দিবস কবে তা কোনো দিন আমার জানতে ইচ্ছে হয়নি- প্রয়োজনও পড়েনি, আর কেউ আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়নি। কিন্তু এবারের বাবা দিবসটি ছিল নানা কারণে আমার জীবনের একটি কষ্টকর বিষাদময় দিন। ঘটনার রাতে আমি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমার বড় ছেলেটি আগে কারণে-অকারণে আমার সেবা করত। পরে মেয়ে এবং সবার শেষে ছোট ছেলেটি। বড় ছেলের বিয়ে হয়েছে, মেয়েরও হয়েছে- আর ছোট ছেলেটি কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে এবং আগামী সেপ্টেম্বরে চলে যাবে। ফলে অসুস্থ বোধ করলে অথবা আমোদ আহলাদে থাকলে শরীর ম্যাসাজ করার দীর্ঘদিনের অভ্যাস যা একসময় আমার ছয়টি ভাই করত এবং পরে যা আমার তিন সন্তান করত; তা হালআমলে আমার জন্য দুরূহ ও দুষ্পাপ্য হয়ে পড়েছে। ফলে এবারের বাবা দিবসের সন্ধে বেলায় আমি ভারি বিপদে পড়ে গেলাম।

ঘটনার দিন ক্লান্ত-বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত ও পরিশ্রান্ত অবস্থায় যখন বাসায় ফিরলাম তখন মাগরিবের আজান দিচ্ছিল। কোনোমতে মাগরিব পড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। সারা দিনের ক্লান্তি ও অবমাননাকর স্মৃতি শরীর-মনকে এতটা বিষাক্ত করে তুলেছিল যে, বিছানায় যাওয়ার পর মনে হচ্ছিল- এখনই বমি হবে, এখনই হৃদযন্ত্র বিকল হবে, এখনই মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হবে এবং নাকমুখ-পশ্চাৎদেশ দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসবে। আমি অসহায়ভাবে পরিবারের সবাইকে ডাকতে চাইলাম কিন্তু কারো নাম মুখে এলো না। আমার চোখ বন্ধ ছিল আর শরীর ছিল অর্ধ অবশ। কিন্তু কান ছিল সজাগ। রান্নাঘর থেকে স্ত্রীর কর্মব্যস্ততার শব্দ শুনছিলাম। পাশের কামরা থেকে প্রিয় কন্যার শরীরের গন্ধ আমার হৃদয়ে ভালোবাসার ফুল ফোটাচ্ছিল আর আদরের ছোট সন্তানটি যে কিনা বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর জন্য বাইরে ছিল তার আগমনী ঘণ্টার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলাম। অন্য দিকে, বড় ছেলেটি শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে পিতার পরিণতি দেখ কি ভাববে তা নিয়েও চিন্তা করছিলাম।

২০২৩ সালের বাবা দিবসের প্রথম প্রহরে আমি কেন উল্লিখিত দুরবস্থার মধ্যে পড়েছিলাম তার কিঞ্চিৎ বর্ণনা না দিলে বিষয়টি পাঠকদের কাছে ধোঁয়াশা মনে হতে পারে। আমি সেই ২০১২ সাল থেকেই জীবনের উল্টো স্রোতে নৌকা বেয়ে চলছি- আর আমার চারপাশের লোকজনের আশা-আকাক্সক্ষা আমার জীবনের ভরা জোয়ারের ২০ বছরের মতোই রয়ে গেছে। ফলে ব্যক্তিগত-পারিবারিক-সামাজিক লেনাদেনার বিশাল অংশজুড়ে গত ১৩ বছর ধরে পাওয়া-না পাওয়ার বেদনা, হিসাব-নিকাশের শুভঙ্করের ফাঁকির রেশ আমাকে বহন করতে হচ্ছে। চলমান সময়ে আমার শত্রুরা আমার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে, আপনজনরা অবুঝ হয়ে পড়েছে এবং প্রতিদ্ব›দ্বীরা বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলা কিংবা সামাল দেয়ার জন্য কখনো গাল ফুলিয়ে, কখনো সিনা ফুলিয়ে অথবা মাথা উঁচু করে নিজের অস্তিত্ব বহাল রাখতে গিয়ে কী ধরনের ফেতনা-ফ্যাসাদের মধ্যে শক্ত পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি তার একটি ছোট উদাহরণ দিচ্ছি।

ঢাকার সাভারে আমার একটি বড়সড় কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল ছিল। ২০১২ সালে আমি সেটি আর চালাতে পারছিলাম না। ব্যাংকের দায়দেনা শোধ এবং অন্যান্য ঝামেলা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য মেশিনপত্রসহ ভবনটি ভাড়া দিই। ভাড়াটিয়া আমার ভরা যৌবনে কোনো সমস্যা করেনি কিন্তু বিএনপিতে যোগদানের পর তার মনে হয়েছে- আমি হয়তো দুর্বল হয়ে গেছি। ফলে চুক্তির শেষ পর্যায়ে এসে দেখলাম আমি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। বিষয়টি সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। পরিশেষে ফৌজদারি দণ্ডবিধি মতে ভাড়াটিয়ার বিরুদ্ধে আমলি আদালতে মামলা করে বাবা দিবসের দুপুর বেলায় ভবনের দখল গ্রহণ করলাম। তালা ভেঙে ভবনে ঢুকে দেখলাম সব কিছু লুটপাট করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মেশিনপত্র জানালা-দরজা-বাথরুমের কমোড-বেসিন থেকে শুরু করে সব কিছু।

উল্লিখিত দৃশ্য দেখার পর আমার শরীর-মন-নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লে সারা শরীর ঘামতে আরম্ভ করল, মাথা ঘুরতে থাকল এবং বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করতে থাকলাম। আমি তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার জন্য গাড়িতে চেপে বসলাম। কিন্তু সাভারের নবীনগর থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত রাস্তায় সীমাহীন ট্রাফিক জ্যামের কারণে পুরো তিনটি ঘণ্টা অপেক্ষা করতে গিয়ে জ্ঞান হারানোর পর্যায়ে পৌঁছে গেলাম। ইচ্ছে ছিল ধানমন্ডির বাসায় ফিরে দুপুরের খাবার খাবো, কিন্তু গাবতলী পৌঁছাতেই বিকেল ৫টা বেজে গেল। আর যখন বাসায় ঢুকলাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ফলে শুধু নামাজ পড়ে কোনো কিছু মুখে না দিয়েই শুয়ে পড়লাম।

বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করলাম স্ত্রী-ছেলে-মেয়েকে ডাকতে। কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দ বের হলো না। হঠাৎ লক্ষ করলাম আমার মেয়ে নন্দিতা আমার হাত-পা টিপছে। রুমের লাইট বন্ধ। বাবার সেবা করতে করতে মেয়ে বলল বাবা! আজকে তো বাবা দিবস। তোমার কী কী খেতে ইচ্ছে করছে। বাবা দিবসে মেয়ের আকুতি শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। কী জবাব দেবো মাথায় আসছিল না। খাওয়া তো দূরের কথা নড়াচড়ার শক্তিটুকু ছিল না। মেয়ের সেবাযত্নে কোন ফাঁকে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। সকালে ঘুম থেকে জেগে জেনেছিলাম যে, বাবা দিবস উপলক্ষে আমার বাসায় পিজার অর্ডার হয়েছিল। সবাই খেয়েছে এবং আমার জন্য কিঞ্চিৎ রেখে দিয়েছে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement