২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


জাতীয় নির্বাচন : জনগণের প্রত্যাশা

লেখক : তৈমূর আলম খন্দকার - ফাইল ছবি

আমাদের রাষ্ট্রে নির্বাচন নামক একটি খেলা এখনো প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর হচ্ছে বটে, কিন্তু ‘নির্বাচন’ বলতে যা বুঝায় সত্যিকার অর্থে তা হয় কি? নির্বাচনের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পছন্দ করা অর্থাৎ নিজ কাক্সিক্ষত প্রার্থীকে ভোট দেয়ার মাধ্যমে দেশ পরিচালনার সুযোগ কাউকে করে দেয়া।

প্রার্থী ও ভোটারের মধ্যে একটি গভীর যোগসূত্র না থাকলে পছন্দের মাপকাঠি সৃষ্টি হতে পারে কিভাবে? সে যোগসূত্রের ধারাবাহিকতা কিভাবে রক্ষা হতে পারে? প্রবাদ রয়েছে- আমাদের দেশের রাজনীতি জোয়ারে ভাসে। ‘জোয়ার’ যেদিকে যায় অর্থাৎ যে দল বা প্রার্থী ‘শক্তি’ প্রদর্শন করতে পারে গণমানুষ সে দিকেই তাড়িত হয়। বাস্তবতা হলো এই যে, বেশির ভাগ ভোটার চিন্তা করে যাতে তার ভোটটা যেন ‘নষ্ট’ বা ‘ব্যর্থ’ না হয়। অন্য দিকে, ভোটার তার নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেই ভোটদানের সিদ্ধান্ত নেয়। সে কারণেই যার শক্তি বেশি তার দিকেই ভোটাররা বেশি মনোনিবেশ করে। ফলে ‘পছন্দ’ বা ‘ইচ্ছা’ যাই হোক না কেন শক্তির কাছেই এ দেশের ভোটাররা মাথা নত করতে বেশি আগ্রহী।

‘শক্তির’ উৎস্য কী সেটিই এখন পর্যালোচনার বিষয়। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হতে পারলেই সেখানে ‘শক্তি’ সৃষ্টি হয়। ফলে জনগণ যেমন যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে ১৯৫২ সালে একবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, যেমনি হয়েছিল ১৯৭০-৭১ স্বাধিকার/স্বাধীনতার আন্দোলনে বা ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সিপাহি জনতার ঐক্য, আবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে। এখন দেখা যায় যে, সব দলের কর্মসূচিতেই জনসমাবেশের কমতি নেই। কথিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মভিত্তিক দলগুলোও অনেক বড় বড় জনসমাবেশ ঘটাতে পারে, কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না বা ঐক্যবদ্ধ করার কোনো উদ্যোগ এখনো পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনজীবন অতিষ্ঠ করে ফেলেছে। মানুষ গোপনভাবে হলেও এ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তায়নের ওপর যারপরনাই নাখোশ। ২৮ মার্চ ২০২২ বামপন্থী ঐক্যজোট দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে হরতাল ডেকেছিল, পত্রিকার ভাষ্যমতে হরতাল সফল না হলেও বামপন্থী দলগুলো মাঠে ছিল, ঝুঁকি নিয়ে মিছিল করেছে, পুলিশকে মোকাবেলা করেছে হরতাল সফল করার জন্য কিন্তু হরতালের সফলতা বলতে যা বুঝায় সে ধরনের হরতাল পালিত হয়নি। জনস্বার্থে আহূত হরতালে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পাওয়া যায়নি। অন্য দিকে, বৃহৎ বিরোধী দল বিএনপি হরতালে সমর্থন জানানোর ইচ্ছা প্রকাশ করলেও বাম দল তা প্রত্যাখ্যান করে।

বিএনপির একটি ব্যাপক কর্মীবাহিনী আছে জেনেও বামদল কর্তৃক আহূত হরতালে বিএনপির সমর্থন গ্রহণ না করার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? হতে পারে তারা মনে করে যে, ১. বিএনপির সাথে বামদের আদর্শিক কোনো মিল নেই অথবা ২. বিএনপির সমর্থন নিলে হরতালের ক্রেডিট বিএনপির পক্ষে চলে যেতে পারে। ফলে দৃশত ভবিষ্যৎ ঐক্যের অর্থাৎ ২০২৩ সালের নির্বাচনে বাম ডানদের ঐক্যের প্রাথমিক লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অন্য দিকে ডানপন্থী দলের মধ্যে ধর্মভিত্তিক প্রতিটি দলই আলাদা আলাদা কর্মসূচি পালনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আলাদা প্রার্থী দাঁড় করিয়ে জেনে শুনে সরকারি দলের প্রার্থীর জয় লাভের পথ সুগম করে দিচ্ছে। বিষয়টি পরিষ্কার যে ডানদের মধ্যেও জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগ এখনো পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

২০১৮ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের সাথে ড. কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন ঐক্যফন্টের ঐক্যের ফল ছিল প্রায় শূন্য। তখন যে প্রশ্ন উপস্থাপিত হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছু দিন পূর্বে ভোট চাওয়ার প্রারম্ভে সে একই প্রশ্ন উপস্থাপন করে বলেন যে, বিরোধী দল নির্বাচিত হলে কে হবে দেশের প্রধানমন্ত্রী? অন্য দিকে ড. কামাল হোসেনের দলও এখন বিভিন্ন উপদলে বিভিক্ত হয়ে নেতৃত্বের প্রশ্নে তিনিও শূন্যের কোঠায় চলে গেছেন। ফলে সর্বজনীন ঐক্যের প্রশ্নে বিরোধী দল কতটুকু হাঁটতে পারবে এটিই এখন পর্যালোচনার বিষয়।

জনগণের ‘ঐক্যবদ্ধতা’ যেমন সরকার হটানোর জন্য একটি অন্যতম প্রধান শক্তি হতে পারে, তেমনি পাক-ভারত উপমহাদেশের রাজনীতিতে একমাত্র ভারত ছাড়া অন্যান্য রাষ্ট্রে সরকার পরিবর্তনে সেনাবাহিনী অনেক ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। পাকিস্তান মিয়ানমার কোনো সময়ই সেনা প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি। বাংলাদেশে বিগত ৫০ বছরে তিনবার সরকার পরিবর্তনে সামরিক হস্তক্ষেপ কার্যকর হয়েছে (খন্দকার মোশতাক, জেনারেল এরশাদ, জেনারেল মইনইউ আহাম্মদ)। জেনারেল এরশাদ সামরিক আইন জারির পর রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিলে বিভিন্ন দলের নেতারা একযোগে তার দলে যোগদান করে, রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় স্থান করে নেয়। এরশাদের যখন পতন আসে গণবিদ্রোহের কারণে তখন আটরশির পীর সাহেবসহ অনেকেই তাকে ছেড়ে চলে যায় এবং সুযোগ মতো বিভিন্ন দলে আত্মনিয়োগ করে।

কথিত আছে যে, তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নূরউদ্দিন যদি প্রেসিডেন্ট এরশাদকে সাপোর্ট করতে সম্মত হতো তবে এরশাদের পতন হয়তো তখন হতো না। জেনারেল নূরউদ্দিন পরে আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ফলে প্রতীয়মান হয়, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সেনাবাহিনী অন্যতম আর একটি প্রধান শক্তি যদি তারা প্রয়োগ করে। জেনারেল মইনইউ আহাম্মদ ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার সুযোগ করতে না পারায় রণে ভঙ্গ দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে সমঝোতা করে তার শেষ রক্ষা হয়। তবে ড. ইউনুস বা ফেরদৌস কোরেশীর মাধ্যমে কিংস পার্টি গঠন করার চেষ্টা করলেও পরবর্তীতে পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় সরকার সমর্থিত রাজনৈতিক দল গঠন করা যায়নি, ফলে তাদের উচ্চ আকাঙ্ক্ষা এমনিতেই আগুনে পোড়া অবশিষ্ট ধোঁয়ার মতো বাতাসে মিশে গিয়েছিল।

বাংলাদেশের ইলেকশন কারসাজিতে আমলা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে পুলিশ বাহিনী অনৈতিকভাবে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। নির্বাচনে ওতপ্রোত ভূমিকা রাখে তারা। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমলাদের কারসাজিতেই বিরোধী দল মাঠে নামতে পারেনি। দিনের ভোটে রাত্রে হওয়ার অভিযোগ ছাড়াও গায়েবি মামলা, মামলায় অভিযুক্তদের রিমান্ড এবং জজ কোর্ট পর্যন্ত জামিন পেতে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় শেখ হাসিনা সরকার সহজেই বৈতরণী পার হতে পেরেছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে আমলা, পুলিশ ও নিম্ন আদালত যদি সরকারের প্রতি গোপন সমর্থনে অনুরূপ ভূমিকা রাখে তবে শক্তি প্রদর্শনে বাকি দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই, যার পূর্বাভাস এখনো দেখা যাচ্ছে না।

অনেকের ধারণা পৃথিবীর বৃহৎশক্তি বা জাতিসঙ্ঘ বাংলাদেশের নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোনো ভূমিকা রাখতে পারে। তবে স্মরণ রাখা দরকার যে, পৃথিবীতে সংগঠিত কোনো অমানবিক গণহত্যা বন্ধের বিষয়ে জাতিসঙ্ঘ বা বৈদেশিক শক্তি কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখেনি। সামরিকজান্তা মিয়ানমার রোহিঙ্গা গণহত্যা বা তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার অমানবিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘ বা বড় বড় রাষ্ট্রগুলো ত্রাণ দিলেও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখেনি।

পৃথিবীতে কোনো রাষ্ট্রই কোনো রাষ্ট্রের বন্ধু নয়; বরং সম্পর্ক রয়েছে কোথাও সঙ্ঘাত দ্বন্দ্ব অথবা কোথাও আপসের। এক রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের সাথে স্বার্থ ছাড়া সম্পর্ক রাখে না। ফলে কোনো রাষ্ট্রে নির্বাচন সুষ্ঠু হলো কি হলো না মর্মে কোনো রাষ্ট্রের মাথাব্যথা নেই। বর্তমান আন্তর্জাতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতীয়মান যে, বিশ্ব এখন অর্থনৈতিক যুদ্ধে লিপ্ত। ফলে অর্থনৈতিক স্বার্থে ব্যাঘাত না ঘটলে কোনো রাষ্ট্র কারো বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ভূমিকা নেয় না। ফলে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন কতটুকু নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে, নাকি আগের ধারাই অব্যাহত থাকবে তা এখনো নিশ্চিত নয়।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail : taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
পূর্ব কালুরঘাটে বেইলিব্রিজে টেম্পু চাপায় কলেজশিক্ষার্থী নিহত কুবি শিক্ষকদের ওপর হামলায় নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রলীগের ৮ নেতাকর্মী শনাক্ত দিনাজপুরে পরাজিত প্রার্থীর সমর্থক-পুলিশ সংঘর্ষ, গুলিতে নিহত ১ ভারতে মসজিদের ভেতর ইমামকে পিটিয়ে হত্যা তীব্র গরমে কাঁঠালিয়ায় এক শিক্ষার্থী অসুস্থ উল্লাপাড়ায় গৃহবধূর লাশ উদ্ধার, স্বজনদের দাবি পরিকল্পিত হত্যা রাজশাহীর পদ্মায় ডুবে তাবলীগ জামাতের সদস্যের মৃত্যু রাজশাহীতে চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড বাংলাদেশ থেকে আম নিতে চায় চীন দেশ থেকে আইনের শাসন উধাও হয়ে গেছে : মির্জা ফখরুল রুশ অগ্রযাত্রার মধ্যেই ভারী হামলা প্রতিহত করল ইউক্রেন

সকল